সাবমেরিনে ৯৭ দিন, নেতাজির জীবনের ভয়াবহ অ্যাডভেঞ্চার স্তম্ভিত করে আজও

Netaji Subhas Chandra Bose : ১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, নেতাজির সেবারের গন্তব্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া। তবে বিমানে নয়, সাবমেরিনে

১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি,মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসুর কাছে পাওয়া গেল সুভাষের চিঠি। তাতে লেখা, “আজ পুনরায় আমি বিপদের পথে রওনা হইতেছি। হয়তো পথের শেষ আর দেখিব না। যদি তেমন বিপদ পথের মাঝে উপস্থিত হয়, তাহা হইলে ইহজীবনে আর কোনও সংবাদ দিতে পারিব না।... আমার অবর্তমানে আমার সহধর্মিণী ও আমার কন্যার প্রতি একটু স্নেহ দেখাইবে, যেমন সারাজীবন আমার প্রতি করিয়াছ।’’ তখনও কেউই জানত না, আর মাত্র বছর দুই হাতে আছে দেশ নায়কের। কিন্তু নেতাজি কি আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন তাঁর অন্তর্ধানের বিষয়টা? এই চিঠিতে দুর্গম অভিযানের কথা লিখতে গিয়ে কেন দিলেন ইহজীবনের সমাপ্তির ইঙ্গিত? কেনোই বা ভবিষ্যতের যিনি অনুরোধ করলেন? এর আগেও তো অনেক দুর্গম পথে পাড়ি দিয়েছেন তিনি, তবে কেন ভিন্ন সেবারের সফর।

এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হয় আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে। এই ঘটনার ঠিক আড়াই বছরের মধ্যে চিরতরে হারিয়ে যান নেতাজি। নেতাজির সেবারের গন্তব্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া। তবে বিমানে নয়, সাবমেরিনে। আজকের সাবমেরিনের সঙ্গে অবশ্য অনেক তফাৎ তখনকার ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের। ইতিহাসের এক নজিরবিহীন যাত্রা ছিল এটি। সাবমেরিনটিও ছিল সাবেকি ধরনের। নাম ‘ইউ১৮০’। জার্মানির কিল নৌবন্দর থেকে শুরু হয় এই বিপদজনক যাত্রা। একটানা ৪৮ ঘণ্টার বেশি জলের তলায় ডুবে থাকতে পারত না জাহাজটি ফলে ব্যাটারি চার্জ করার জন্য উঠতে হতো জলের উপরে আর এখানেই ছিল শত্রুপক্ষের নজরে পড়ে যাওয়ার ভয়। নেতাজি নামটা ইতিমধ্যেই তখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশি শত্রুপক্ষের কাছে একটা বোমার মত। আওতায় পেলে মৃত্যু অনিবার্য। ফলত এ যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না, পরতে পরতে ছিল ভয়ংকর কিছুর ঝুঁকি।

আরও পড়ুন - নেতাজি ঘরে ফেরেননি, বারবার ফিরেছেন সিনেমায়, কোন কোন ছবি?

“সাবমেরিনটি যাত্রা শুরু করে কিল থেকে, নাবিকদের বলা হয়নি ওই দু’জন কোথায় যাচ্ছেন, তাঁরা শুধু জানতেন এই দুই মেশিনিস্টকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উত্তরে নিয়ে যেতে হবে। যাত্রার প্রাক্কালে সাবমেরিনে কিছু মালপত্র তোলা হল, আমার বাবা এবং তাঁর এডিসি আবিদ হাসান সাফরানিকে গোপনে নিয়ে আসা হল। আশঙ্কা ছিল, ব্রিটিশদের কাছে খবর পৌঁছে যাবে, সুদূর প্রাচ্যগামী একটি সাবমেরিনের একজন যাত্রীর নাম সুভাষচন্দ্র বসু।”, সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন অনিতা বসু পাফ।

সুভাষ যখন হারিয়ে যান তখন অনিতার বয়স মাত্র তিন, বাবার স্মৃতি বলতে তাই ভরসা আবিদ হাসানের স্মৃতিকথা। আবিদ হাসান, দুর্গম মেরিন যাত্রার একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী। টানা ৯৭ দিনের দুর্গম সফরের সব গল্প রয়েছে এই লেখায়। এই যাত্রায় নানারকম জরুরি কাজে মগ্ন থেকেছেন দুই সঙ্গী। কখনো বক্তৃতার জন্য লেখা তৈরি করছেন কখনো আবার সেই লেখা বারংবার রিহার্সাল করে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছেন নেতাজি। লক্ষ্য একটাই যুদ্ধ জয়, বিশ্বের দরবারে ভারতের সাম্প্রদায়িক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করা। তার জন্য প্রয়োজন প্রস্তুতি যার সবটুকুই নেতাজি ছেড়েছিলেন সাবমেরিন যাত্রায়। এত কাজের মাঝেই আবার কখনও ব্রিটিশ জাহাজ সুভাষদের ডুবোজাহাজকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে, বিষম বিপদ থেকে কোনও মতে রক্ষা পাচ্ছেন, এই জাহাজ থেকে ওই জাহাজে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। নেতাজি এমনই একজন নেতা, যাঁর সংযম, স্থৈর্য, কর্মোদ্দীপনায় অভিভূত থেকেছেন আবিদ হাসান। তবে প্রতি শ্রদ্ধাই স্মৃতিকথার পরতে পরতে উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন - নেতাজির অন্তর্ধানের পর চুরি যায় আজাদ হিন্দের ২৫০ কোটির সম্পত্তি! নেপথ্যে ছিলেন কারা?

ইতিহাস বলে, ১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন একটি জার্মান ইউ-১৮০ ডুবোজাহাজ অর্থাৎ সাবমেরিনে চড়ে সুদূর প্রাচ্যের পথে পাড়ি দেন নেতাজি, সঙ্গে আবিদ হাসান। মূলত ব্রিটিশ এবং মার্কিন সাবমেরিন পরিবৃত অত্যন্ত বিপদসংকুল সমুদ্রপথ পার হয়ে ম্যাডাগাস্কারে তাঁদের তুলে দেওয়া হবে একটি জাপানি সাবমেরিনে, এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।

অতি অত্যাধুনিক সাবমেরিনেও যে খুব হাত পা ছড়িয়ে থাকা যায় এমনটা নয়, তার ওপর তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়কার সাবমেরিন এর কথা একেবারেই আলাদা যেখানে প্রায় ৯৭ দিন কাটালেন নেতাজি সামনে দুরন্ত একটা সময়ের সফর। লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিলেন ওখানেই। অনিতাNetaji Subhas Chandra Bose : ১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, নেতাজির সেবারের গন্তব্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া। তবে বিমানে নয়, সাবমেরিনে
পাপ বারবার এ কথা স্বীকার করেছেন যে, তার বাবার জীবনে সবচাইতে দুর্গম যাত্রা ছিল এটি।পরবর্তীকালে জার্মান ভাষায় এই যাত্রার একটি বিবরণ লিখেছিলেন উইন, যা পড়লে বোঝা যায়, দুই রহস্যময় সহযাত্রীকে নিয়ে কী ধন্দে পড়েছিলেন সাবমেরিনের কর্মী। বার্গেনের কছে পৌঁছে জানতে পারেন আসল পরিচয়। ১৯৪৩ সালের মে মাস অবধি চলে এই দুরন্ত সফর। নেতাজির গোটা জীবনটাই ঐতিহাসিক, তবে এই সফরের তুলনা সর্বাগ্রে তা বলাই বাহুল্য।

More Articles