কৃষ্ণনগরের উচ্চাঙ্গ সংগীতের সভায় কেন অপমানিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ?

Rabindranath Tagore in Krishnagar : রবীন্দ্রনাথ কৃষ্ণনগরে সেবার প্রথম চৌধুরীর বাড়িতে ছিলেন তিন থেকে চারদিন। জানা যায়, প্রথম সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথের মনোমুগ্ধকর রূপ অবাক করেছিল প্রমথ চৌধুরীকে।

রবীন্দ্রনাথ কৃষ্ণনগরে সেবার প্রথম চৌধুরীর বাড়িতে ছিলেন তিন থেকে চারদিন। জানা যায়, প্রথম সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথের মনোমুগ্ধকর রূপ অবাক করেছিল প্রমথ চৌধুরীকে। বাঙালির রবি ঠাকুরকে তাঁর পঁচিশ বছর বয়সে কেমন দেখতে ছিল সে-উত্তরে প্রমথ চৌধুরী জানিয়েছেন,

তাঁর বর্ণ ছিল গৌর, আকৃতি দীর্ঘ, কেশ আপৃষ্ঠ লম্বিত ও কৃষ্ণবর্ণ, দেহ বলিষ্ঠ, চর্ম মসৃণ ও চিক্কন, চোখ নাক অতি সুন্দর।

তখন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গায়ে জামা পরতেন না, তাঁর পরিধানে থাকত ধুতি ও গায়ে একটিমাত্র চাদর।

প্রমথ চৌধুরীর ‘আত্মকথা’ থেকে জানা যায়, আশুতোষ, সত্যপ্রসাদ, রমণীমোহন এবং রবীন্দ্রনাথ, সকলেরই সময় কেটেছিল হাসি-ঠাট্টায়। তাঁদের আনন্দের মূলে শিখরে ছিল রবীন্দ্রনাথের গান। তিনি নিজকণ্ঠে গেয়েছিলেন হিন্দি গান, ‘জন ছুঁয়া মোরি বঁইয়া নাগরওয়া’। প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন,

তাহাকে গান গাহিতে অনুরোধ করা হইল, সাধাসাধি নাই, বনবিহঙ্গের ন্যায় স্বাধীন উন্মুক্ত কণ্ঠে অমনি গান ধরিলেন,... ‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না...।’

সে-সময়য় প্রথম চৌধুরীর অল্প বয়স। রবীন্দ্রনাথ কৃষ্ণনগরে আসার কিছুদিন আগে কলকাতায় একটি বক্তৃতায় সংগীতের তাল সম্পর্কে বলেছিলেন। সম্ভবত বক্তৃতাটির শিরোনাম ‘সংগীত ও ভাব’। এক সন্ধ্যায় সে-সম্পর্কেই আশুতোষ ও রবীন্দ্রনাথের ভেতর কথা চলছিল। বাড়ির ঢাকা বারান্দার অন্ধকারে তাঁদের সেইসব কথাবার্তা নিঃশব্দে শুনছিলেন কিশোর প্রমথ। পরে তিনি দাদা আশুতোষকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। প্রশ্নটি রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছলে তিনি জানতে চান ‘এ প্রশ্ন কে করলে ?’ উত্তর এল ‘আমার একটি ছোটো ভাই’ । রবীন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘তোমার ও-ভাইটি দেখছি অতি বুদ্ধিমান ও চতুর।' প্রমথ চৌধুরীর প্রশ্নটি ছিল এইরকম : রাস্তা দিয়ে ঘোড়া যদি সমান বেগে দৌড়ে যায়, তবে তার সমপদবিক্ষপের শব্দ কি কানে মিষ্টি লাগে না ? যদিচ তাঁর মধ্যে কোনও সুরাস্বর নেই, আছে শুধু সমান-সমান ব্যবধান।

আরও পড়ুন-

জোড়াসাঁকোতে অসমবর্ণ বিবাহ, সম্বন্ধ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ

তখন কৃষ্ণনগরে রামতনু লাহিড়ীর ভ্রাতুষ্পুত্র সত্য লাহিড়ীর বাড়িতে উচ্চাঙ্গ সংগীতের সভা বসত। রবীন্দ্রনাথ কৃষ্ণনগরে থাকাকালীন সেখানে যান। ইন্দিরা দেবীর ‘সংগীতস্মৃতি’ থেকে এ-তথ্য জানতে পারি। ইন্দিরা আমাদের এও জানিয়েছেন, ওই  সভায় ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এক অশোভন ঘটনা। সভার মানুষজন তাঁকে গান গাইতে বলায় তিনি স্বছন্দে গেয়ে ওঠেন ‘বাঁশরি বাজাতে চাহি বাঁশরি বাজিল কই’ গানটি। কিন্তু কৃষ্ণনগরের উচ্চাঙ্গ সংগীতের সেই সভা তাঁদের অভ্যস্ত সুরের ভেতরকার তানকর্তব তাঁর গাওয়া গানটিতে খুঁজে পাননি। ফলে শুরু হল বাক্যবান। শ্রোতারা তপ্ত ভাষায় কথা বলে চললেন। শেষে, রবীন্দ্রনাথকে এমনও শুনতে হয়,

‘হ্যাঁ, বাঁশরি অনেকে বাজাতে চায়, কিন্তু বাঁশরি বাজাতে চাইলেই কি বাঁশরি বাজে। বাঁশরি বাজাতে গেলে শিক্ষা চাই।’

ভাবলে লজ্জা হয়, কৃষ্ণনগরের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে এমন কথা সহ্য করতে হয়েছিল। পরবর্তীতে, সমগ্র বঙ্গদেশে তথা ভারতবর্ষে তাঁর মতো সংগীতবোদ্ধা ও বিস্ময়কর সুরস্রষ্ঠা আমরা আর ক-জনকেও পাবো?

রামতনু লাহিড়ী

১৮৮৬-তে যখন তিনি কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন, তাঁর বয়স পঁচিশ। ওই সামান্য বয়সেই রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত লেখার তালিকাটি দেখলে ঈর্ষা হয়। দুটি গল্প, ‘ভিখারিনী’, ‘করুণা’। আট’টি কবিতার বই, ‘কবিকাহিনী’, ‘বনফুল’, ‘ভগ্নহৃদয়’, ‘সন্ধ্যাসংগীত’, ‘প্রভাতসংগীত’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’, ‘ছবি ও গান’। একটি উপন্যাস, ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’। পাঁচটি নাটক, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘রুদ্রছন্দা’, ‘কালমৃগয়া’, ‘নলিনী’, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’। দুটি প্রবন্ধ সংকলন ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’, ‘আলোচনা’। তাঁর প্রবাসে থাকাকালীন লেখা চিঠির গ্রন্থরূপ ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’। পাশাপাশি তৈরি করেছেন অজস্র গান। প্রকাশিত হয়েছে গানের সংকলন ‘রবিচ্ছায়া’। এরই মধ্যে বেথুন কলেজে পূর্বোক্ত ‘সংগীত ও ভাব’ নামক মেধাবী বক্তৃতায়, বক্তব্যের পাশে-পাশে অজস্র গান গেয়ে সংগীতে কী-কী সুর বিন্যাসে কীরকম ভাবের জন্ম হয়, তার নমুনা রেখেছেন। 

আরও পড়ুন-

দেবব্রত বিশ্বাসের গান কেন পছন্দ করতেন না অন্যান্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীরা?

কলকাতার গুণীজনের সমাবেশে তখনই তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। বিশেষত তাঁর গান। সেইসময়কার ‘ভারতী’ ও ‘বালক’ পত্রিকাতে পাঠকের অনু্রোধে প্রায়শই দেখা মিলত রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপির। এমনকি, স্বামী বিবেকানন্দ নিভৃতে, বাহ্মসমাজের পরিধির বাইরে শ্রীরামকৃষ্ণ-কে রবীন্দ্রনাথের গান শুনিয়েছিলেন এবং ‘সংগীত কল্পতরু’-তে সংকলন করেছিলেন। 

প্রমথ চৌধুরী

এত অল্প বয়সে এরকম দানবীয় অর্জন যার, তাঁকে কিনা কৃষ্ণনগরে এসে নিজের সংগীত সম্পর্কে অশিক্ষার কটাক্ষ শুনতে হল! প্রমথ চৌধুরী আমাদের বলেছেন, গানের অনুরোধ এলেই তিনি গেয়ে উঠতেন। কোনও আড়ষ্টতা বা ভণিতা করতেন না। অর্থাৎ তাঁর অন্তরে সবসময় স্রোতস্বিনী অবস্থায় থাকত সুর। সত্য লাহিড়ীর সংগীত সভাতেও তেমনই নির্ঝরে বাহির হয়ে এসেছিল সেই সুরের ধারা। কিন্তু প্রত্যুত্তরে যে আক্রমন তিনি সেদিন সহ্য করেছিলেন, তা ছিল যেমন অপ্রত্যাশিত, ততোধিক অপমানজনক। এরপর তাঁর সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ আর কোনওদিন কৃষ্ণনগরে আসেননি।

More Articles