জাকির হুসেন থেকে জন ম্যাকলফলিন কীভাবে শুরু হয়েছিল বিখ্যাত ব্যান্ড 'শক্তি'?

History of Shakti Fusion Band : ১৯৭৩ সালে জন ম্যাকলফলিন, জাকির হুসেন, এল. শঙ্কর আর ভিক্কু বিনায়ক্রম গঠন করলেন নতুন ব্যান্ড 'শক্তি'।

AL

উপনিষদ বলছে চেতনার চারটে স্তর—জাগরণ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি (সুপ্তি) আর সেই অদৃশ্য তুরীয় অবস্থা—একটা রাগের মতো, ধীরে-ধীরে তীব্রতায় উঠে, আবার নীরবতায় মিলিয়ে যায়। জাগরণে আমরা ইনস্ট্যাগ্র্যামের ফিড স্ক্রল করি, স্বপ্নে দেখি বেহালার বো-এর ছায়া, সুপ্তিতে ঘুমিয়ে থাকে সমস্ত নোট, আর তুরীয়—সে যেন স্টেজের হঠাৎ নিস্তব্ধতা, যেখানে মিউজিশিয়ান আর শ্রোতৃবর্গ একই তালে মিশে যায়। এখানে সময় নেই, মিটার নেই, শুধু এক টানা সাউন্ডওয়েভ, যা শব্দব্রহ্মের মতো সবকিছুকে ঘিরে রাখে। এই অবস্থায় আপনি কনসার্টে নন, আপনি-ই স্বয়ং কনসার্ট, আর শঙ্খের ভেতর বাজছে অনন্ত ফিউশন।

আসলে মানুষের ভেতরে চারটি পর্দা টাঙানো—জাগ্রত, যেখানে রাস্তাঘাট, বিজ্ঞাপন, ক্যাপুচিনোর ধোঁয়া; স্বপ্ন, যেখানে পুরোনো প্রেমিকারা ফ্রিজের ছোটো ডিসপ্লের আলোয় দাঁড়ায়; সুষুপ্তি, যেখানে সব চ্যানেল বন্ধ, শুধু কালো স্ক্রিন; আর তুরীয়—যেটা বিজ্ঞাপনেরও বাইরে, মৃত্যুরও বাইরে, যেন কেউ রিমোট ছুড়ে ফেলে দিয়ে নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেছে। এই চতুর্থ অবস্থাতেই সময় থেমে যায়, আর বাকি সব শুধু স্লো-মোশনে পুনঃপ্রচার।

আরও পড়ুন-

বাংলা গানের ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়

তুরীয়ানন্দ সংগীত—শব্দটার ভেতরে যেন এক অদৃশ্য প্লেলিস্ট চলছে, যেখানে শব্দ নয়, ফ্রিকোয়েন্সি কাজ করছে। না, ওঁরা মনে এই সংগীতের পরিবেশকবর্গ কোনো ‘গডম্যান ব্যান্ড’ নন, বরং এক ধরনের সাউন্ড ফিলোজ্যফার, যাঁরা সেতার, তবলা, বেস গিটার, সিন্থেসাইজার—সবকিছুকে মিলিয়ে বানাচ্ছেন এমন একটা মিউজিক, যা শোনার সময় মনে হবে, আপনি বাস্তবতার চৌহদ্দি পার করে গিয়েছেন।

শ্রী চিন্ময় ঘোষ—যিনি নিউ ইয়র্কের রাস্তায় মেডিটেশন করেও এক্সপ্রেস ট্রেনের গতিতে ছবি এঁকেছেন, আবার ৩৫০ পাউন্ড বেঞ্চ-প্রেস করে বলে গেছেন ‘পিস ইজ পাওয়ার’। তাঁর কাছে সংগীত ছিল একেবারে কম্প্রেসড ইনফিনিটি—যেখানে একেকটা নোট মানে আলাদা ব্রহ্মাণ্ড। তুরীয়ানন্দ যেন সেই আধ্যাত্মিক বিটসের উত্তরাধিকারী, কিন্তু মিক্সটেপ বানাচ্ছে আপডেটেড সফটওয়্যার দিয়ে—যেখানে রাগ ভৈরবীর সঙ্গে ডিপ হাউস বিট, ভজনের সঙ্গে অ্যাম্বিয়েন্ট ইলেক্ট্রো, আর মেডিটেশনের সঙ্গে লো-ফাই গিটার লুপস।

‘তুরীয়ানন্দ সংগীত’, নামটা শুনলেই মনে হয় এক ধরনের বিমূর্ত সাউন্ডস্কেপ, যা ধ্রুপদী রাগের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থেকেও নিজের ভিতরে যেন এক অদ্ভুত মেটা-নারেটিভ তৈরি করে। এখানে ‘রাগ’ আছে, কিন্তু সেই রাগকে ডিকনস্ট্রাক্ট করে নতুন ইমোশনাল জিওমেট্রি বানানো হয়। ফলে, শ্রোতা একই সঙ্গে ফোক আর অ্যাভাঁ-গার্দে-র মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে—যেন আপনি বাউল গানের মাঝে হঠাৎ জন কেজ বা ফিলিপ গ্লাসের ছোঁয়া পাচ্ছেন, অথচ সবটাই বাংলা উচ্চারণে, বাংলা ভাবনায়।

তুরীয়ানন্দ সংগীতের মিউজিক্যাল আঙ্গিকে প্রায়শই একটা সুর মাঝপথে ভেঙে অন্য সুরে ঢুকে যায়, আবার সেই সুর পুরোনো ভাবনায় ফিরেও আসে না। তুরীয়ানন্দ সংগীত তাই শুধু একটি সঙ্গীতধারা নয়, বরং এক ধরনের অ্যাকুস্টিক ম্যানিফেস্টো।

১৯৭৩ সালে, এক স্থবির রাতের আকাশের নিচে যখন সুর আর নীরবতা এক হয়ে আলোড়ন তোলে, তখন জন্ম হয়েছিল একটি ব্যান্ডের—যার নাম ছিল তুরীয়ানন্দ সংগীত। এই নাম দিয়েছিলেন শ্রী চিন্ময়, যার অর্থ একরাশ আধ্যাত্মিকতা— সংগীতের আনন্দের সর্বোচ্চবিন্দু, কিংবা গভীরভাবে বুঝলে—যে সংগীত স্বচ্ছ, সত্য, চেতনাবোধ আর আনন্দকে সর্বোচ্চবিন্দুতে নিয়ে যায় ।

প্রারম্ভিক লাইন-আপে ছিলেন—জন ম্যাকলফলিন (গিটার), এল. শঙ্কর (বায়োলিন), রামনাদ ভি রাঘবন (মৃদঙ্গম), এবং ইভ ম্যাকলফলিন (তানপুরা ও শ্রুতি বক্স)। তুরীয়ানন্দ সংগীত ছিল শক্তির আদিম, নির্জন ও আধ্যাত্মিক গুরুদৈত।

তুরীয়ানন্দ সংগীতের পোস্টার, ১৯৭৫

পরবর্তীতে, ইভ চলে যান, জাকির হুসেন যোগ দেন (তবলা)— তখন নাম বদলে রাখা হয় ‘শক্তি’, কারণ সেই নাম পশ্চিমা শ্রোতারা সহজে উচ্চারণ করতে পারেন। একটু পিছিয়ে শুরুর গল্পে যাই, কারণ, শুরুটা যেন অন্য গ্রহের রেলস্টেশনে—যেখানে সময় নেই, আছে শুধু বাদ্যতরঙ্গ। জন ম্যাকলফলিন তখন লন্ডনের প্রগ রক, জ্যাজ-ফিউশন, আর গিটার-অভিনবত্বের কুয়াশায় গড়ে ওঠা এক বিদ্যুৎচমক। তবু তার ভেতরে কোথাও এক ধরনের অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা—যেন পশ্চিমা নোটের ফাঁকে-ফাঁকে কিছু অনুলিখিত শব্দ বাজছে, যেগুলো কেবল ভারতীয় সুরেই পূর্ণ হবে। সেই সময়েই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় শ্রী চিন্ময়ের—সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, নিউ ইয়র্কের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো এক রহস্যপুরুষ, যিনি ঈশ্বরকে কেবল ভাবনার নয়, সুরের মাধ্যমে ছুঁতে চেয়েছিলেন।

ম্যাকলফলিনের কাছে এই সাক্ষাৎটা ছিল যেন এক মেটাফিজিক্যাল শর্ট সার্কিট—পাশ্চাত্যের উন্মাদনা আর প্রাচ্যের ধ্যান হঠাৎ একই তারে বাঁধা পড়ে গেল। শ্রী চিন্ময় তাঁকে দিলেন নতুন এক নাম—‘মহাবিষ্ণু’। নামটার মধ্যে ছিল শাস্ত্রীয় গাম্ভীর্য, আবার রক বা পপ কনসার্টের অদ্ভুত ফ্লেয়ারও। এরপর তিনি গিটার হাতে নামলেন এমন এক সফরে, যেখানে প্রতিটি সুর ছিল ভৌগোলিক মানচিত্রের বাইরে।

এভাবেই তিনি এলেন ভারতীয় সংগীতে—শুধু অতিথি হিসেবে নয়, বরং এক অবাঞ্ছিত বাসিন্দার মতো, যিনি নিজেকে সেতার, বায়োলিন, মৃদঙ্গমের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন। ১৯৭৫ সালের তুরিয়ানন্দ সংগীত—যেখানে তিনি, এল শংকর আর আর. রাঘবান মিলে যেন চতুর্থ মাত্রার এক জ্যাম সেশন খেললেন। পোস্টারটার দিকে তাকালে বোঝা যায়, এটা কেবল একটা কনসার্ট ছিল না—এটা ছিল সময়, স্থান আর ধ্যানের সমান্তরাল মহাবিশ্বে প্রবেশের টিকিট।

জন ম্যাকলফলিন শ্রী চিন্ময়ের শিষ্য হওয়ার পর ‘মহাবিষ্ণু অর্কেস্ট্রা’ নামটি বেছে নেন, কারণ তিনি চান ব্যান্ডের সুর যেন একাধারে ধ্বংস, সৃষ্টি ও পুনর্জন্মের আধ্যাত্মিক শক্তি বহন করে। ১৯৭১-এ ব্যান্ডটি গঠিত হয়, জ্যাজ ফিউশনের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে ওঠে। মহাবিষ্ণু অর্কেস্ট্রা—নামটার মধ্যেই আছে এক রকম কসমিক কৌতুক। মহাবিষ্ণু, সেই চিরন্তন রক্ষাকর্তা, আর অর্কেস্ট্রা, যা মূলত পশ্চিমী ধ্রুপদী আর জ্যাজের পরিভাষা—দুই মহাদেশের শব্দদেহ মিলিয়ে যেন এক সাইকেডেলিক জন্ম। ম্যাকলফলিন চেয়েছিলেন সাউন্ডের মধ্যে দিয়ে এমন এক ফিউশন বানাতে, যা ধর্মীয় ধ্যানের মতোই বিস্তৃত, কিন্তু আবার জ্যাজের মতই অস্থির ও বিদ্রোহী।

মহাবিষ্ণু অর্কেস্ট্রা

তবু এই মহাজাগতিক ইলেকট্রিক ব্যান্ড বেশি দিন টেকেনি। কারণটা স্রেফ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা অর্থনৈতিক হিসাব নয়—বরং ছিল ‘ইগোর তাপপ্রবাহ’। প্রত্যেকেই ছিল আলাদা সুরের দেবতা, কিন্তু একসঙ্গে বাজাতে গেলে দেবতারা প্রায়শই ঝগড়া করে ফেলেন। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে ফিউশনের সেই ধ্যান ভেঙে গেল, সুরকাররা নিজের-নিজের গ্রহে ফিরে গেলেন। মহাবিষ্ণু অর্কেস্ট্রা থেকে রইল শুধু কিছু রেকর্ড—যেন মহাবিশ্বের ফিকে হয়ে যাওয়া তারার আলো, যা এখনও শুনলে মনে হয়, সাউন্ডও কখনো ধর্ম হতে পারে।

১৯৬৯ সালের নিউ ইয়র্ক, গ্রিনউইচ ভিলেজ—একটি ছোটো রেকর্ডের দোকান, বাতাসে ধূসর জ্যাজের ছোঁয়া। সেখানে প্রথমবার দেখা হলো জন ম্যাকলাফলিন এবং জাকির হুসেনের। ম্যাকলাফলিন তখন লন্ডন থেকে সদ্য স্থানান্তরিত, হাতে গিটার, মাথায় টনি উইলিয়ামসের ‘লাইফটাইম’ ব্যান্ডের তেজ। ১৯৭৩ সালে, জন ম্যাকলফলিন ও জাকির হুসেন একসঙ্গে একটি কনসার্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হুসেন-ম্যাকলফলিনের ‘মহাবিষ্ণু অর্কেস্ট্রা’ ব্যান্ডের পারফরম্যান্স দেখেছিলেন এবং এটি নিঃসন্দেহে তাঁর জন্য একটি চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা ছিল।

'শক্তি'-র গিটার

বিগত শতকের সত্তর দশক। নিউ ইয়র্ক, লাইটস, কনসার্ট হল আর স্ট্রিট কর্নারে জ্যাজের ছোঁয়া। ১৯৭৩ সালে জন ম্যাকলফলিন, জাকির হুসেন, এল. শঙ্কর আর ভিক্কু বিনায়ক্রম গঠন করলেন শক্তি। শুধু বৃন্দ সংগীতের দল নয়, শক্তি একটা ট্রান্স, যেখানে দক্ষিণ ভারতীয় বীণা আর কর্ণাটকী রিদম মিলে গেল পশ্চিমা জ্যাজের ভাঙা লাইন এবং ফ্রি ফ্লোয়। শক্তির স্টেজে চারটি ভিন্ন সাংগীতিক দুনিয়া একসঙ্গে নাচত। জন ম্যাকলফলিন তাঁর নিজস্ব নির্মাণ শক্তি গিটার নিয়ে বীণার স্পন্দন, সরোদের গভীরতা আর পশ্চিমা জ্যাজের ফ্রি ফ্লো একত্রিত করতেন, গিটারের প্রতিটি তার যেন আকাশের লাইন আঁকছিল। জাকির হুসেন তবলা দিয়ে লয়ের ঘূর্ণি তৈরি করতেন, কখনো ধীর, কখনো ঝড়ের মতো, কর্ণাটকী ধারার সঙ্গে জ্যাজের ইমপ্রোভাইজেশনকে এক লাইভ ট্রান্সে রূপান্তরিত করেছিলেন। এল. শঙ্করের বেহালা তখন এক এক্সপ্রেসিভ লেয়ার হিসেবে ফ্লোট করত, কর্ণাটকী রাগের সূক্ষ্মতা আর পশ্চিমা ফিউশন স্টাইলের সঙ্গে মিলিয়ে, শ্রোতাদের মনকে টানত অন্য এক ডাইমেনশনে। ভিক্কু বিনায়ক্রম ঘটম দিয়ে রিদমের ভিতরে গভীরতা যোগ করতেন, প্রতিটি ধ্বনি যেন মাটির সঙ্গে সঙ্গীতের স্পন্দন জুড়ে দিচ্ছিল। এই চারজন একসঙ্গে তখন এক লাইভ রিচ্যুয়াল তৈরি করতেন—যেখানে পূর্ব-পশ্চিমের সুর, আধ্যাত্মিক স্পন্দন আর অ্যাকুস্টিক ফ্রিলি ফ্লো একসাথে মিশে হাইপাররিয়াল এক ট্রান্স তৈরি করত, যা সত্তর দশকের সঙ্গীতপথকে পুরোপুরি নবদিগন্তে নিয়ে গেল।

শক্তি (প্রাথমিক লাইন আপ)

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে শক্তি তিনটি লাইভ অ্যালবাম প্রকাশ করে— শক্তি উইথ জন ম্যাকলফলিন (১৯৭৫), অ্যা হ্যান্ডফুল অব বিউটি (১৯৭৬), এবং ন্যাচারাল এলিমেন্টস (১৯৭৭)। ১৯৭১ সালের শুরু—ম্যাকলফলিন বীণার সুরে ডুবে আছেন, সেই দক্ষিণ ভারতীয় তার বাদ্যযন্ত্রের আঙুলের খেলা তাঁকে এমন এক খোলাসা দেখায় যা তাঁর গিটারের মধ্যে প্রবেশ করতে চায়। ডক্টর এস. রামানাথনের তত্ত্বাবধানে কনেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুশীলন, এবং বীণার আকাশবিভোর করা লয় তাঁকে নতুন গিটার খুঁজতে বাধ্য করে—যা বীণার স্পন্দন, সরোদের গভীরতা আর পশ্চিমা জ্যাজের ভাঙা রিদম একসঙ্গে ধরতে পারে। অ্যব্রাহাম ওয়েচ্টারের মিউজিক ল্যাব ও গিবসনের গবেষণা দলের হাত ধরে, উস্তাদ আলি আকবর খানের প্রেরণায় জন্ম নিল ‘শক্তি গিটার’, ১৯৭৫–৭৬ সালে মঞ্চের জন্য তৈরি। সাধারণ ছ’টি তার নয়, এখানে তেরোটি তার—সাতটি সিম্প্যাথেটিক ড্রোন, ফ্রেটবোর্ড বীণার মতো স্ক্যালপড, আঙুল স্পর্শ না করেই সুরকে লাফিয়ে ওঠবার সুযোগ করে দেয়। সাতের দশকের শেষ পর্যন্ত শক্তি কনসার্টে এই গিটার বাজল, কিন্তু ১৯৭৮ সালে ব্যান্ড ভেঙে যাওয়ায় তার স্টেজে দেখা শেষ। এই গিটার শুধু একটি বাদ্য নয়—এটা যেন সাউন্ডের ভ্রূণ, যা আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে জ্যাজের বিদ্রোহ মিশিয়ে নতুন দিগন্ত দেখায়।

১৯৭৮ সালে শক্তি ভেঙে যাওয়া ছিল এক ধরনের অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতার প্রতিফলন। সদস্যরা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষ, দীর্ঘ আন্তর্জাতিক ট্যুর আর ক্রমাগত পারফরম্যান্সের চাপের মধ্যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন বজায় রাখতে পারছিলেন না। প্রতিটি স্টেজে প্রাণবন্ত সাউন্ড এবং নিখুঁত ইম্প্রোভাইজেশন দেওয়ার প্রচেষ্টা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্তি জাগাচ্ছিল। তাছাড়া, ফিউশন সঙ্গীতের এই আন্তর্জাতিক জগতে সাফল্য থাকা সত্ত্বেও অ্যালবামের বিক্রয় ও অর্থনৈতিক চাপ দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বকে বাধা দিচ্ছিল।

১৯৮৪ সালে শক্তি একটু স্মৃতির ভেতর ফিরে এল—পুরনো নোট, তবলার স্পন্দন আর গিটারের সেই আধ্যাত্মিক লেয়ার নিয়ে তাঁরা ভারত সফরে নেমেছিলেন। প্রসঙ্গত, ম্যাকলফলিন তখন আর শক্তি গিটার ব্যবহার করেননি।শহর, স্টেজ, হল—সবকিছু যেন তাঁদের পুরনো ট্রান্সকে নতুন করে শোনবার সুযোগ দিচ্ছিল। কিন্তু এই পুনর্মিলন ছিল সাময়িক, পুরনো জ্যাজ-বীণা ফিউশন আবারও ছড়িয়ে দেওয়ার আগ্রহের ঝলক, এরপর ব্যান্ড আবার ভেঙে গেল। ১৯৯৭ সালে, জন ম্যাকলফলিন আর জাকির হুসেন এক নতুন রূপে ফিরে এলেন—‘রিমেম্বার শক্তি নিয়ে’, যেখানে এল. শঙ্করের জায়গায় বাঁশিতে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া যোগ দিলেন। নতুন মিশ্রণ, নতুন ট্রিপ, নতুন সাউন্ড—এবার পুরো বিশ্বব্যাপী স্টেজে হাইপাররিয়াল ট্রান্স ছড়িয়ে গেল। ১৯৯৭-এর লাইভ ট্রিপ থেকে ১৯৯৯ সালে ‘রিমেম্বার শক্তি’ সংকলন বের হয়। তবে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াকে পরর্বতী কোনও অ্যালবামে আর পাওয়া যায়নি।

রিমেম্বার শক্তি–দ্য বিলিভার—নামে ছিল কনফেশনাল বুথের বাইরের সেই অদ্ভুত, যেখানে গিটার, তবলা, ম্যান্ডোলিন, ঘটম মিলে চারজন সাউন্ড মঙ্ক একসাথে মন্ত্রোচ্চারণ করছে, অথচ কোনও দেবতার নাম উচ্চারণ না করেই। ২০০০ সালের অক্টোবরের শীতলতর দিনে ভার্ভ লেবল থেকে বেরিয়ে পড়া এই ডাবল লাইভ অ্যালবাম যেন একসাথে নিউইয়র্কের ধোঁয়াটে জ্যাজ ক্লাব আর তিরুবনন্তপুরমের মন্দির করিডর দখল করে নিল। ১৩৭ মিনিটের এই সাউন্ডস্কেপে ট্র্যাকের নামগুলো স্রেফ গানের শিরোনাম নয়, বরং একেকটা বিকল্প ইতিহাস, যেখানে লয়ের ভেতরে সময় ভেঙে গিয়ে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে আছে। বিলবোর্ড-এর টপ জ্যাজ অ্যালবামস চার্টে ২০তম স্থানে পৌঁছনোটা যেন একপ্রকার কসমিক রসিকতা—যেন ফিউশনের এই গোপন ধর্মটাকে হঠাৎ মূলধারার পণ্ডিতেরা সিলমোহর দিয়ে ফেলেছে। সমালোচকরা, সেই চিরকালীন ‘গেটকিপার’-রা, এখানে আশ্চর্যজনকভাবে মাথা নাড়লেন—অল অ্যাবাউট জ্যাজ-এর ভাষায় ‘ভেরি ফেভারেবল’, পেঙ্গুইন গাইড–এর গলায় সামান্য ধূপের গন্ধ, আর অলমিউজিক-এর রিভিউতে সেই চেনা ‘উই অ্যাপ্রুভ’ সুর। কিন্তু আসল গল্প? এই অ্যালবাম বাজলে শ্রোতা হঠাৎ বুঝে যান, ‘বিলিভার’ হওয়া মানে ঈশ্বরে বিশ্বাস নয়, বরং সেই মুহূর্তে সাউন্ডওয়েভের কাছে আত্মসমর্পণ করা—যেখানে রাগ ভৈরবীর নিঃশ্বাসে জ্যাজের হৃদস্পন্দন মিশে যায়, আর পুরো বিশ্ব সাময়িকভাবে হাইপারলিঙ্কড হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন-

বাংলা গানের ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়

রিমেম্বার শক্তি–স্যাটারডে নাইট ইন বম্বে—নামের ভেতরে যেন এক লাইট-পোস্টে ঝুলন্ত সাইনবোর্ড, যেখানে শহরের রাতের ভিজ্যুয়াল, তবলার লয় আর ইলেকট্রিক ম্যান্ডোলিনের শ্বাস একই ফ্রেমে ধরা পড়ে। ২০০১ সালের জুন মাসের উনিশ তারিখে ভার্ভ লেবল থেকে বেরোনো এই লাইভ অ্যালবাম যেন একসঙ্গে কোলাব আর কলিশন—জন ম্যাকলফলিন গিটার হাতে রাস্তায় হাঁটছেন, ইউ. শ্রীনিবাস ইলেকট্রিক ম্যান্ডোলিনে যেন ট্রাফিক লাইটের সুর বাজাচ্ছেন, জাকির হুসেন তবলা দিয়ে লোকাল ট্রেনের ছন্দ তুলছেন, আর ভিক্কু সেলভাগনেশ বিনায়ক্রমের ঘটম, কানজিরা, মৃদঙ্গমে রাতের আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যাপ এঁকে দিচ্ছেন। অতিথি লাইন-আপে আছেন শংকর মহাদেবন ভোকালে—যেন হঠাৎ এক মেট্রো স্টেশনে রাস্তার কবি হাজির, দেবাশীষ ভট্টাচার্য স্লাইড গিটার দিয়ে নিয়ন সাইন ছুঁয়ে যাচ্ছেন, আর শিভামনি ড্রামসে শহরের গলিপথের গোপন বিট টেনে আনছেন। মোট সময় ৬১ মিনিট ৫০ সেকেন্ড—যেন শহরের রাতের এক পূর্ণ চক্র, যা শেষ হলেও মনে হয় বাজছে, বাজছে, বাজছে…।

২০২৩ সালে ‘দিস মোমেন্ট’—শক্তির ৪৬ বছরের নীরবতার পর হঠাৎ যেন শহরের আকাশে ভেসে ওঠা এক সাউন্ডওয়েভ, যা রিহার্সাল নয়, বরং পূর্ণোদ্যমে ফিরে আসা এবং ঘটনাচক্রে এটি শক্তির এক এবং একমাত্র স্টুডিও অ্যালবাম। জন ম্যাকলফলিনের গিটার, জাকির হুসেনের তবলা, শংকর মহাদেবনের ভোকাল, গণেশ রাজাগোপালনের বেহালা আর সেলভাগনেশ বিনায়ক্রমের ঘটম-কানজিরা-মৃদঙ্গম মিলিয়ে এই সংকলন যেন একই সাথে নস্টালজিয়া আর নতুন শহরের স্পন্দন। ২০২৪-এ গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবাম জেতা যেন এই প্রত্যাবর্তনের আকাশে সিলমোহর, প্রমাণ করে দেয়—ফিউশন জীবিত, শুধু রূপ পাল্টেছে। এখানে রাগের ভেতর ব্লুজ, ধ্রুপদীর ভেতর শহুরে হট্টগোল, ধ্যানের ভেতর ডিজিটাল আলোর ঝলক—সবকিছুই টাইট, কিন্তু মুক্ত। দিস মোমেন্ট আসলে কোনও মুহূর্ত নয়, বরং শহরের প্রতিটি মুহূর্তের একত্রে বাজা—যেখানে শ্রোতা কনসার্টে নয়, কনসার্ট নিজেই শ্রোতার মধ্যে।

‘মাইন্ড এক্সপ্লোশন’ ( ২০২৫ ) শক্তির শেষরাতের মতো—যেখানে শব্দ, স্মৃতি আর আলো একসাথে মিশে একটা অদ্ভুত ক্র্যাশ তৈরি করেছে। ২০২৩ সালের ৫০তম বার্ষিকী ট্যুরের নানা শহরের লাইভ পারফরম্যান্স থেকে জন্ম নেয়া এই অ্যালবাম, আর জন ম্যাকলফলিন একে বললেন তাঁদের সবচেয়ে বড় অর্জন। জাকির হুসেনের মৃত্যুর পর যা হয়ে দাঁড়াল এক আবেগঘন বিদায়, যেখানে প্রতিটি ট্র্যাক তাঁর উপস্থিতির অনুরণন বহন করছে। এখানে কনসার্ট নেই—স্মৃতিই কনসার্ট, শ্রোতার হৃদস্পন্দনই আসল লয়। শক্তি হয়তো বিদায় নিচ্ছে , কিন্তু এই শেষ রেকর্ডে তাঁরা নিজেদের চিরকালীন করে রেখে গেলেন মহাকালের কাছে।

শক্তির গল্প এখানে এসে থেমে নেই, বরং অদৃশ্য হয়ে গেছে—যেমন হঠাৎ এক শীতের সন্ধ্যায় হোর্ডিংয়ের আলো নিভে গেলে দেখা যায়, আকাশটা আসলে এখনও জ্বলছে। মাইন্ড এক্সপ্লোশন তাই শেষ নয়, এটা একটা লুপড ভিডিও—যেখানে জন ম্যাকলফলিনের গিটার, জাকির হুসেনের তবলা, গানেশের বায়োলিন, শংকরের ভোকাল, সেলভাগনেশের ঘটম একসাথে বাজে, আবার থেমে যায়, আবার বাজে—যেন প্লে-লিস্টে রিপিট বোতাম চেপে রাখা হয়েছে। এই অ্যালবামে শহরের শব্দ ঢুকে পড়েছে অতর্কিতে—যেন ট্রাফিক লাইটের ফিসফিস, চায়ের কাপে চামচের ঠোকাঠুকি, ভিজে রাস্তায় হঠাৎ বেহালার সুর—সব মিলিয়ে এক রকম শব্দছবি।

শক্তি-র শেষতম সদস্যরা

এখানে শ্রোতা আর শিল্পীর ফারাক মুছে গেছে—দুই পক্ষই যেন বসে আছেন এক কল্পিত গলিতে, যেখানে সাউন্ডওয়েভ বাতাসের বদলে শ্বাস নিচ্ছে। এই উত্তরাধুনিক মঞ্চে গান শুধু শোনার জিনিস নয়—এটা মাংসপেশি, স্নায়ু, আর ব্রাউজারের এক ট্যাব। মাইন্ড এক্সপ্লোশন শোনার মানে পুরনো শক্তির অ্যালবাম রিলিজের তারিখ আর ইউটিউব লাইভস্ট্রিমের লিঙ্ক একই সার্চ রেজাল্টে পাওয়া। এখানে সময় আর ধারাবাহিকতা ভেঙে গেছে—১৯৭৬-এর এক বিকেল হঠাৎ ২০২৩-এর ভোরে এসে বসে পড়েছে।

জাকির হুসেনের জাগতিক অনুপস্থিতি শুধু শূন্যতা নয়, বরং এক ধরণের উপস্থিতির পুনর্গঠন—যেন প্রতিটি তবলার বোল তাঁর নাম ধরে ডাকে। সুরগুলো তাই স্মৃতির মধ্যে আটকে নেই, বরং স্মৃতিকে ছাড়িয়ে নতুন এক হাইব্রিড রিয়েলিটি তৈরি করছে। শক্তির এই শেষ রেকর্ডে কোনও ফাইনাল কর্ড নেই—শুধু এক লম্বা ডিক্রেসেন্ডো, যা কনসার্ট থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তার শব্দ শুনিয়ে দেয়। এখানে তালি দেওয়ারও কোনও মুহূর্ত নেই—কারণ গান শেষ হয় না, শুধু পরের শহরে চলে যায়। এই হল উত্তরাধুনিকতার শক্তি—শেষকেও শুরু বানিয়ে ফেলা, মৃত্যু থেকেও নতুন লুপ তৈরি করা। বোঝা যায়, শক্তি আসলে কোনও সময়ে বাস করেনি, বরং একসাথে সব সময়ে বাস করেছে। তাঁদের সুর এখন শুধু রেকর্ডে নেই—এটা মেমরি কার্ডে, ইন্টারনেটের ডেটাপ্যাকেটে, আর বুকের ধুকপুকে বাজছে। মাইন্ড এক্সপ্লোশন এইভাবে হয়ে দাঁড়ায় এক অসীম জ্যাম সেশন, যেখানে প্লে-লিস্টের শেষ সংগীত মাঝপথে থেমে যায়, আর ঠিক বোঝা যায় না—সত্যিই শেষ হয়েছে, নাকি এখনই আবার শুরু হবে।

More Articles