উন্নত চিনের মুখোশের আড়ালে ক্রীতদাস প্রথা? কতটা নির্মমতার শিকার সেদেশের কর্মীরা

China: চিনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিশিল্পে এত উন্নতি, এর মূলে রয়েছে ক্রীতদাস প্রথা?

বর্তমানকালে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থান হয়েছে চিনের। চাইনিজ প্রোডাক্ট নেই, এমন বাজার বিশ্বে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গত দুই দশক ধরেই চিনের অব্যাহত উন্নতি প্রত্যক্ষ করছে সারা বিশ্ব। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সামরিক উন্নয়নেরও সম্পর্ক আছে। দেশে অর্থনীতি শক্তিশালী হলে, যে কোনও রাষ্ট্রই সামরিক খাতে বিপুল ব্যয় করতে পারে। এর মাধ্যমেই তারা হয়ে ওঠে একটি শক্তিধর রাষ্ট্র। ঠিক যেমনটা হয়ে উঠেছে চিন। এর কারণে ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী এই দেশটি। সবের মূলে রয়েছে ওই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই। আসলে চিন অনেক আগে বুঝতে পেরে গিয়েছিল, যত সময় এভাবে মানুষ তত প্রযুক্তির দিকে ছুটবে। এই সঠিক অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই তারা টেকনোলজির ওপর জোর দিয়েছে এবং বর্তমানে প্রযুক্তিশিল্পে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে আমাদের প্রতিবেশী এই দেশটি। তবে এই যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিশিল্পে এত উন্নতি, এর মূলে রয়েছে ক্রীতদাস প্রথা। না, সেই আদিম যুগের টাকা দিয়ে ক্রীতদাস কেনা ঠিক নয়। ব্যাপারটা খানিকটা একইরকম, তবে একটু উন্নত মোড়কে প্রস্তুত করা হয়েছে। এই প্রথাটিকে ক্রীতদাস প্রথা না বলে ‘৯৯৬ প্রথা’ বলা যায়।

আলিবাবা, হুয়াওয়ে, টেনসেন্ট, শাওমি, ভিভো প্রভৃতি চিনা টেক কোম্পানিগুলো বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রবল প্রতাপে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এইসব কোম্পানিগুলোর মধ্যেই যেটি কমন বিষয়, সেটি হলো ‘৯৯৬’ ওয়ার্ক কালচার। প্রত্যেকটি কোম্পানিই নিজেদের কর্মীদের এই প্রথামাফিক কাজ করায়। ‘৯৯৬’ বলতে বোঝানো হয়, সকাল ন'টা থেকে রাত ন'টা পর্যন্ত সপ্তাহে ছ'দিন কাজ করা। অর্থাৎ, এই চিনা কোম্পানিগুলো কর্মীদের সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টা করে কাজ করতে বাধ্য করে। পৃথিবীর অন্য যে কোনও দেশের তুলনায় এই পরিমাণ অনেক বেশি। যেহেতু কর্মীরা বেশি কাজ করছেন, ফলত কোম্পানিগুলির আউটপুটের পরিমাণ অনেক বেশি হয়। বেশি আউটপুট মানে বেশি সেলস, মানে বেশি টাকা। তবে ইতিমধ্যেই চিনের সরকারের তরফে ওই কোম্পানিগুলিকে আইনি নোটিস ধরানো হয়েছে। পরিষ্কার কড়া ভাষায় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এই ধরনের ওয়ার্ক শিডিউল পরিবর্তন না করলে তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই নোটিসের বা এই কড়া বার্তাকে কতটা আমল দেবে কোম্পানিগুলো।

আরও পড়ুন: বাঁচতে চাওয়ার তীব্র আকুতি! বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে লাইফ জ্যাকেটের এই পাহাড়!

চিনের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, কোনও কর্মচারীকে দিনে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৪ ঘণ্টা কাজ করানো যাবে। এর বেশি কাজ করানো হলে তা ওভারটাইম বলে গণ্য করা হবে, এবং সেইমতো ওই কর্মীকে অতিরিক্ত বেতন দিতে হবে। কাগজে-কলমে এই আইন বলবৎ থাকলেও বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। প্রায় সমস্ত কোম্পানিই এই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বছরের পর বছর ধরে কর্মীদের বাড়তি সময় খাটিয়ে আসছে। কোনও বাড়তি অর্থ প্রদান করার তো প্রশ্নই নেই। এই ৯৯৬ প্রথার সমর্থনে আলিবাবার কর্ণধার জ্যাক মাহ বলেছেন, “ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এই নিয়ম দেশের জন্য একটি আশীর্বাদ। যদি তুমি বাড়তি সময় ও শ্রম না দাও, তাহলে কীভাবে সফল হবে ?” এছাড়াও আরেক চিনা ই-কমার্স প্ল‍্যাটফর্ম জেডডি ডট কম-এর সিইও রিচার্ড লিউ মনে করেন, যারা এই নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, তারা ‘অলস’। এই চিনা টেক জায়েন্টগুলি এভাবেই বিনামূল্যে কর্মীদের অতিরিক্ত খাটিয়ে বেশি বেশি মুনাফা অর্জন করছে। সেই কারণেই এই নিয়মকে তারা প্রকাশ্যে সমর্থন করছে।

এই প্রথার ফলে কোম্পানির উন্নতি হলেও কোম্পানির কর্মীদের কিন্তু স্বাস্থ্যের এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উভয়েরই ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপের কারণে তরুণ-তরুণীরা সন্তান নিতে চাইছেন না। ফলত চিনে জন্মহার তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাদের সমস্যাও অত্যন্ত স্বাভাবিক, অফিসেই যদি দিনের ১২ ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাবে কখন? ২০১৯ সালে কোড শেয়ারিং প্ল‍্যাটফর্ম গিটহাবে প্রথম ‘ওয়ার্কার্স লাইভস ম্যাটার’ নামক অনলাইন ক্যাম্পেন শুরু হয় এই ৯৯৬ নিয়মের প্রতিবাদে। কয়েকজন প্রোগ্রামার এই ক্যাম্পেন শুরু করেন। তাঁরা সেখানে এই নিয়মের কারণে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, সেগুলো লিপিবদ্ধ করেন এবং যেসব স্টার্ট আপ কোম্পানি এই নিয়ম অনুসরণ করে, তাদের ব্ল্যাকলিস্ট করেন। তাদের এই ক্যাম্পেন ক্রমেই জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও কোম্পানিগুলির কেশাগ্র-ও আন্দোলিত হয় না। কেননা, এই নিয়মের ওপর ভর করেই তারা বিশ্ববাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে হংকং পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটির অধ্যক্ষ জেনি চ্যান বলেন, “সময় এসে গিয়েছে এই অসহ্য প্রথাকে সরিয়ে ফেলার। মানুষ সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন কোম্পানির বেশ কয়েকজন কর্মচারী এই নিয়মের জাঁতাকলে পিষে মারা গিয়েছেন। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। কোম্পানিগুলিকে নিজেদের নিয়ম বদল করতেই হবে।"

996

এই অসহ‍্য প্রথার অবসান ঘটবে?

২০২০ সালে এক জনপ্রিয় কোম্পানির এক কর্মী কর্মরত অবস্থাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ওখানেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের এক চিনা ফুড ডেলিভারি অ্যাপের এক কর্মী রাস্তায় খাবার ডেলিভারি দিতে যেতে যেতে রাস্তাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এবছরের শুরুতে দু'জন কর্মচারী বাড়ি ফেরার সময় গাড়ি চালাতে চালাতেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, মৃতদের কোম্পানিগুলি ৯৯৬ প্রথা অনুসরণ করত এবং উক্ত কোম্পানির অনেক কর্মীই বর্তমানে মানসিক অবসাদে ভুগছেন। এই ঘটনাগুলি কয়েকটি উদাহরণমাত্র। এরকম বহু মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন এই নিয়মের কারণে। উপরন্তু একটানা কাজ করার ফলে এক পর্যায়ে কর্মীদের কাজের প্রতি মনঃসংযোগের অভাব দেখা যায়। ফলত, প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায় না। পরিমাণে অনেক হলেও মানে ভালো হয় না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেখানে নির্দিষ্ট সময় কাজ করিয়ে কর্মীর উৎকর্ষকে বেশি প্রাধান্য দেয়, সেখানে চিনের এই কোম্পানিগুলি পরিমাণকে বেশি প্রাধান্য দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই নিয়ম চলতে থাকে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে তা কোম্পানিগুলোরই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সম্প্রতি অবশ্য চিনের বিভিন্ন আদালত এই ৯৯৬ নিয়মটিকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে। কর্মীদের দাবি মেনে অনেক কোম্পানি এই নিয়মটিকে ৯৫৫-এ (অর্থাৎ সপ্তাহে পাঁচ দিন, প্রত্যহ সকাল ন'টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করতে হবে) পরিণত করেছে। এর থেকেই বোঝা যায়, কোম্পানিগুলো যেভাবে অমানুষের মতো কর্মীদের খাটাচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে আর করতে পারবে না।

More Articles