করেন ফুল ফরেন ফুল ৷৷ নতুন ফুল আবিষ্কারের গল্প

ফুটপাথে চায়ের দোকান।
দোকানের সামনে ফুলের স্টল।
বাঁপাশে ছবি বাঁধানোর দোকান।
ডান পাশে সিগারেটের স্টল।
তার পাশে শনিঠাকুরের ঘর।
আমি চায়ের দোকানে।
চা হচ্ছে।
আমার চিনি ছাড়া।
তাই, 'বসতে হবে।'
বসে আছি।

এই দোকানগুলোতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভিড় থাকে। এই দোকানগুলো কেবলমাত্র চায়ের দোকান নয়। এখানে ভাত, রুটিও মেলে। এই দোকানগুলোতে দোকানি আর কাস্টমারের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। এ, ও-র বাড়িতে অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণও পায়। এখানে, এই দোকানে, যেখানে আমি বসে আছি, ফুটপাথে, কাস্টমারের অধিকাংশই হচ্ছে রিকশাচালক। ফুটের অন্যান্য দোকানের লোকেরাও আসে। আমার মতো ঘরেরও না, ফুটেরও না গোছের পাবলিকও আসে। ঘুরতে ঘুরতে কোনও ভাগ্যবান বা অভাগা বাচালও মাঝেমধ্যে এসে পড়ে। দুই এক পিস শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি লাইনের লোকজনেরও দেখা মেলে সপ্তাহে একদিন অন্তত।

চায়ের দোকানে দুটো উনুন জ্বলছে।
একটায় তো চা। অন্যটায় ভাত।
ফুটছে।
বড় বড়। বেলফুলের কুঁড়ির মতো।
চায়ের দাম কাগজের ছোট কাপে পাঁচ টাকা।
একটা প্রজাপতি বিস্কুট তিন টাকা।
তার মানে মোট আট টাকা।
এই যদি ব্রেকফাস্ট হয়, লাঞ্চ কী হবে?
ভাত আর ডিমের ঝোল পঁয়ত্রিশ টাকা।
সঙ্গে অবশ্য ডাল-তরকারিও দেবে।
লেবু নেই। লঙ্কা আছে।
আমার কাছে মোট পঞ্চাশ টাকাই আছে।
তবে, চায়ের খুচরোটা হয়ে যাবে। খবরের কাগজও কিনতে হবে।
মনে পড়ল, বাড়িতে দুটো ডিম আছে।
শুধু ভাত কিনে নেব?
ভাবছি।

চা।
হ্যাঁ।
বিস্কুট দেব?
না।

ফাল্গুন মাসের প্রথমদিককার রোদ্দুরের রংটা ঠিক ফরসা মেয়েদের উরুর মতো হয়।
ওই রংটাই আলো হয়ে ফুলের স্টলের গোলাপের তোড়ার ওপর এসে পড়েছে।
লাল রংয়ের গোলাপগুলো যেন মড়া মাছের মতো সার সার সাজিয়ে রাখা রয়েছে। কেমন যেন মাথা কাটা মাছের চোখের মতো বোবা দৃষ্টি। যেন আমার দিকেই চেয়ে আছে। আমিও যেন তাদেরই দেখছি। ঠায়।

ভাত হয়ে গেছে।
ফ্যান গালছে দোকানি।
একটু ফ্যাকাশে রংয়ের এবং একটু তরল বীর্য যেন। হড়হড়িয়ে পড়ছে নর্দমায়। এই ফ্যানের এখন আর কোনও উৎপাদনক্ষমতা রইল না। নর্দমার জলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ ফ্যান গড়িয়ে গেল আরও বড় নর্দমার উদ্দেশে। বক্স-এ গান বাজছে, 'বুকের মধ্যে সুজন আছে'। এটা রামপ্রসাদী। আজ শনিবার।

চায়ের দোকানে চিনি-ছাড়া-লিকার খুব তিক্ত। এ তো আর দক্ষিণাপনের ডলি'র চায়ের দোকান নয় কিংবা দার্জিলিংয়ের নাথমলস্! কালো ঘন 'তিতা' চা। চুমুক দিলেই 'সাড়ে চুয়াত্তর'-এ ভানু-র মুখটা মনে পড়ে যায়। তিন চুমুকেই শেষ হয়েছে সবটুকু। জীবনপাত্রও একদিন এভাবেই সুড়ুৎ করে শেষ হয়ে যাবে। দোকানের শোরগোল, হিসেব কষাকষি, খুচরো নিয়ে বচসা, লেনদেন— একদিন থেমে যাবে সব, মানুষের মতোই।
তবুও এই দোকানগুলো ঠিক থেকে যাবে মহাকাল হয়ে। একেকটা নাটমন্দির হয়ে।

খালি কাগজের কাপটা হাতে নিয়েই বসে আছি গোলাপের তোড়ার দিকে চেয়ে। রোদ্দুরের একটা ধারালো রেখা মনে হয় ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে আপতিত হয়েছে তোড়ার ওপর। ফুলের ওপর জলের ছিটে দিচ্ছে স্টলের ছেলেটা। ভাতের গামলার ঢাকনা সরিয়ে দিয়েছে চা-দোকানি‌। ধোঁয়া উঠছে। সেই ধোঁয়াকে ধরেছে ওই ধারালো রোদ্দুরের ফলা। সোঁওও করে ধোঁয়া ওই ফলায় ছড়িয়ে পড়ছে ঠিক আমার অভাবের মতো— তার একদিকে একতোড়া গোলাপ, আরেকদিকে রোদ্দুরের সোর্স। আমি কি একটা প্রজাপতি বিস্কুট খাব?

মাঝে মাঝে মাথাটা পেছনের দিকে বিছিয়ে দিতে বেশ আরাম লাগে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে এই কাজটা করতে আরও ভাল লাগে। মাথার ওজনটাও যেন টের পাওয়া যায়–
তেমন করেই বসে আছি। শনিঠাকুরের ছোট ঘরে গান বাজছে,'অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি'। মনে হয় রাঘব চ্যাটার্জি গাইছে। আমি একটা বেঞ্চ-এ বসে আছি। চা-দোকানি বলল, আর চা দেব?
আমি বললাম, না।
দোকানি বলল, এবার উঠতে হবে, ওরা ভাত খেতে আসবে। বলে, রাস্তার দিকে তাকাল সে। এখন সকাল সাড়ে দশটা। এবার আমার কাজ কী? কোথায় যাব এখন? গোলাপের তোড়ার ওপর রোদ্দুর আর কতক্ষণ পড়বে? গামলার ভাতও ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে। সবই এক সময় শেষ হয়। আমার পকেটের পঞ্চাশ টাকা অবশ্য এখনও আছে। পয়সা দিয়ে আমি উঠে পড়লাম।

ফুলের স্টলে সাদা মালা ঝুলছে এক গোছা।
এমন ফুল আমি সচরাচর দেখি নি। মনে হয়, সাদা ফুলে রঙ লাগিয়ে কতগুলোকে আবার রঙিনও করা হয়েছে। তুলতুলে মোলায়েম মালাগুলো। বেশ লম্বা লম্বা। খুব সুন্দর।
দোকানের ছেলেটাকে বললাম—
এটা কী ফুল রে?
সে বলল, করেন ফুল। করেন ফুল।
করেন ফুল?
বলল, হ্যাঁ।
করেন ফুল!
এটা কী ফুল?

এমনিতে আমি অনেক অনেক লোকের মতো গাছ-ফুল এসব খুব একটা চিনি না।
তবুও করেন ফুল নাম শুনিনি কখনও।
আবার জিজ্ঞেস করলাম, কী ফুল?
বলল, করেন ফুল। করেন। করেন।
আমি ভাবছি,
জীবনানন্দ দাশ তো কত ফুলের নাম লিখেছেন। এই নাম তো চোখে পড়েনি।
কে জানে, আমি হয়তো জানি না। করেন ফুল বোধহয় ফরেনে হয়।
ছেলেটাকে শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করলাম, করেন ফুল?
বলল, হ্যাঁ।
রিপিট করল, হ্যাঁ।
তার দ্বিতীয় হ্যাঁ বলার মধ্যে প্রচণ্ড একটা দৃঢ়তা টের পেলাম। যাই হোক, মনটা খচখচ করছিল, তবুও আর কোনও কথা না বলে হাঁটা দিলাম।

পরে শুনলাম, ওটা ভুট্টা ফুল। CORN থেকে করেন হয়েছে। কলকাতার ফুলের দোকানে এই ফুল এখন যাকে বলে, একেবারে সুপারহিট।
আক্ষেপ!
একটা নতুন ফুল তৈরি হতে হতেও ঝরে গেল।

More Articles