লক্ষ্মী সরার ইতিকথা
কথাতেই আছে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তাই তো ঘরের মেয়ে দুর্গার কৈলাসে ফিরে যাওয়ার দুঃখ, বাঙালি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ঘরে ঘরে হাজির হন লক্ষ্মীদেবী। বাঙালি ঘরে লক্ষ্মী পুজো হয় দুইভাবে, কেউ কেউ পুজো করেন সরাতে আবার অনেকে আরাধনা করেন লক্ষ্মী মূর্তির। আজ বলব লক্ষ্মী সরার বিষয়ে।
লক্ষ্মী আসলে কোন বৈদিক দেবী নন , তাঁর জন্ম পুরাণেই। সমুদ্র মন্থনের সময় লক্ষ্মীর আবির্ভাব, তারপর দেবীকে বিবাহ করেন নারায়ণ। পুরাণ অনুযায়ী লক্ষ্মী সৌন্দর্যের প্রতীকও বটে। কেনই বা এই বৃত্তাকার সরার উপর লক্ষ্মীকে আঁকা হয়? গোলাকৃতি এই অবয়বের উপর লক্ষ্মীর প্রাচীনতম নিদর্শনটি দেখা যায় ভারতস্তুপের উপরে বেদিকার গায়ে গোলাকার এক বৃত্তে খদিত ‘অভিষেক লক্ষ্মী’ তে। লক্ষ্মী যখন সমুদ্র থেকে উত্থিত হন তখন দুইটি হস্তি তাঁকে গঙ্গা জলে সিঞ্চন করে পবিত্র করে তোলে, লক্ষ্মীর এই রূপটিকে বলা হয় ‘অভিষেক লক্ষ্মী’। এইখানে দেখা যায়, তিনটির পদ্মের মাঝখানের পদ্মটিতে অবস্থান করেছেন স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী এবং দুইপাশের দুই পদ্মতে অবস্থান করেছে দুই হস্তি। এই হস্তি যুগল তাদের শুড় দিয়ে লক্ষ্মীর মাথায় গঙ্গাজল ঢেলে দিচ্ছে। এই ‘অভিষেক লক্ষ্মী’ আসলে প্রতিনিধিত্ব করেছে উর্বরা শক্তির দ্যোতক হিসাবে। লক্ষ্মীর একটি রূপ আবার বসুন্ধরা। বসুন্ধরা শব্দটি শুনেই বোঝা যায়, এর সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রের এক নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। তাই তো কৃষিপ্রধান বাংলায় এবং বাংলাদেশে লক্ষ্মী ধন, ঐশ্বর্যের পাশাপাশি পুজিত হয়ে থাকেন ফসলের দেবী হিসাবেও। সমগ্ৰ রাঢ় অঞ্চলে দেবীর একটি রূপ স্থান পায় টুসু কিংবা ভাদু হিসাবে। ভাদ্র মাসে ফসল কাটার সময় একমাস ধরে চলে এই ভাদ্র লক্ষ্মী বা ভাদু দেবীর আরাধনা। কৃষিপ্রধান দেশে যদি ফসলই না ফলে তবে আর আর্থিক যোগ ঘটার সম্ভবনা কোথায়? তাই বাংলায় লক্ষ্মীকে নানারূপে পুজো করা হয়। লক্ষ্মীর এই বসুন্ধরা রূপটিই বাংলায় আসে ধান্যলক্ষ্মী হিসাবে। মাটির সরায় লক্ষ্মীর যে অবয়ব দেখা যায়, তা আসলে ধান্য লক্ষ্মীরই। তাই সরায় দেবীর পাশাপাশি আঁকা হয় ধানের ছরার ছবিও।
লক্ষ্মীর সরার আগমণ মূলত ওপার বাংলা থেকে। এ দেশীয় লোকেরা বরাবর দেবীর প্রতিমা পুজোতেই অভ্যস্ত। এখন যারা সরা তৈরির কাজ করেন , তাদের প্রত্যেকেরই কোথাও না কোথাও ভীত গাঁথা রয়েছে ওপার বাংলায়। দেশভাগের সময় কিংবা পরবর্তী সময়ে তাঁরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছেন। ওপার বাংলার ফরিদপুর এবং ঢাকা, মূলত এই দুই জায়গাতেই সরার প্রাচুর্য চোখে পড়ে। ঢাকা এবং ফরিদপুরের শিল্পীদের সরা তৈরির ধরনও আলাদা। যে সরাগুলির প্রান্তভাগ সমান্য উত্থিত, সেগুলি ঢাকার। এদেশেও বহু সরায় এখনও এই চল দেখা যায়। শিল্পীরা নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসলেও, সঙ্গে করে ঐতিহ্যটুকু নিয়ে আসতে ভুলে যাননি। আবার ফরিদপুরের সরায় এরকম কোন উত্থিত অংশ থাকে না।
এবার আসা যাক সরার প্রকারভেদে। এই সরা অনেক রকমের হয়ে থাকে যেমন ফরিদপুরি সরা, ঢাকাই সরা, সুরেশ্বরী সরা এবং আচার্যী বা গণকাসরা। আগে প্রায় তেরো ধরনের সরা তৈরির রেওয়াজ ছিল কিন্তু সময়ের সঙ্গে তার আর অল্পই অবশিষ্ট রয়েছে। যদিও এখনো এপার বাংলা অপেক্ষা ওপার বাংলার সরার প্রাচুর্য এবং বৈচিত্র্য উভয়ই বেশি। অঞ্চলভেদে এবং পরিবারভেদে সরা আবার বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমন একচোখা লক্ষ্মী সরা ( এই সরায় লক্ষ্মী একপাশ ফিরে থাকেন। ফলে তাঁর একটি চোখ দেখা যায় ), দুই পুতুল সরা (এখানে আবার লক্ষ্মীর সাথেই একই ফলকে আসেন সরস্বতীও। শোনা যায়, আগে যাঁরা সরা বানাতেন তাঁদের মূর্তি বানানোর শিল্পীরা খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের চোখে দেখতেন। তারা সরার উপর আঁকা ছবিগুলিকে ‘পুতুল’ বলতেন। সেইখান থেকেই এইধরনের সরার নামে উঠে এসেছে পুতুল কথাটি), তিন পুতুল, পাঁচ পুতুল এবং সাত পুতুল সরা (এই সরাতে লক্ষ্মীকে বেষ্টন করে থাকেন তাঁর সখীরা), এছাড়াও রয়েছে দুর্গা সরা এবং রাধাকৃষ্ণ সরা। দুর্গা সরাতে উপরে চার সন্তানকে নিয়ে অবস্থান করেন স্বয়ং দুর্গা এবং নীচে আলাদা করে এক ছোট্ট অংশে থাকেন দেবী লক্ষ্মী। বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে দুর্গা সরার এক বৈশিষ্ট্য হল গণেশ এবং কার্তিকের স্থান পরিবর্তন অর্থাৎ দুর্গার বাঁদিকে অবস্থান করে কার্তিক এবং ডানদিকে অবস্থান করে গণেশ। এই সরা অনুযায়ী ওপার বাংলায় আবার দুর্গা পুজোর মূর্তিতেও কার্তিক এবং গণেশের স্থান পরিবর্তিতই থাকে। মূলত দুর্গা সরা পুজো করে থাকেন শাক্ত ধর্মের আরাধনাকারীরা এবং রাধাকৃষ্ণ সরা পুজো করেন বৈষ্ণব ধর্মের মানুষেরা। গণকা সরার আবার বৈশিষ্ট্য হল সরার মূল পটভূমিটি হয় লাল রঙের। ফরিদপুরের সুরেশ্বরী সরায় আবার সরার উপরে অবস্থান করে মহিষমর্দিনী এবং নীচে চৌখুপির মধ্যে থাকেন সবাহনে লক্ষ্মী । সরাতে দেবীরা অধিষ্ঠান করেন কখনো পদ্মফুলে আবার কখনো নৌকায় । এই নৌকা বাণিজ্যের প্রতীক হিসাবে চিত্রিত হয়ে থাকে।
চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক, এই সরা কীভাবে তৈরি করা হয়। সরা তৈরির কাজ যথেষ্ট শ্রমসাধ্য। সরা তৈরির মাটি মূলত কিনে আনা হয় । তারপর মাটি থেকে বেঁছে ফেলা হয় কাঁকড়। এরপর জল সহযোগে কাদা মাটি তৈরি করা হয় , লুচি তৈরির জন্য যেভাবে আগে লেচি প্রস্তুত করা হয় ঠিক সেভাবেই সরার ক্ষেত্রেও বানানো হয় বড়ো বড়ো লেচি । এরপর শিল্পীরা ঠিক লুচি প্রস্তুত করার মতোই লেচি থেকে এক তাল মাটি নিয়ে তা গোলাকৃতি ধাতব পদার্থ দ্বারা আঘাতের মাধ্যমে সরার গোল আকার প্রস্তুত করে থাকেন । এইসময় কিন্তু সরা তার আসল আকার পায় না । এরপরে কুমোরের চাকার মতোই একটি ছোট আকৃতির চাকার উপর মাটির গোলাকৃতি কাঠামোটিকে রেখে অন্তত নিপুণতার সঙ্গে কাঠামোটিকে প্রকৃত সরার আকৃতি দান করা হয়ে থাকে। এরপর সরাগুলিকে শুকাতে দেওয়া হয় এবং তারপরে সরা অনুযায়ী তার পটভূমি খরিমাটি কিংবা লালরঙে ভরিয়ে ফেলা হয় । তারপর সরা শিল্পীরা অন্তত দক্ষতার সঙ্গে সরায় লক্ষ্মী কিংবা দুর্গা অথবা রাধা-কৃষ্ণের ছবি এঁকে থাকেন।
নদীয়ার তাহেরপুর, নবদ্বীপ ,উত্তর চব্বিশ পরগণার নৈহাটি, সোদপুর দত্তপুকুর সহ বেশকিছু অঞ্চলে লক্ষ্মীর সরা আঁকা হয়ে থাকে। তবে যতদিন যাচ্ছে, সরার পরিবর্তে মানুষ প্রতিমাকে বেছে নিচ্ছেন এবং ক্রমেই বাংলায় সরার এতো বৈচিত্র্য আর চোখে পড়ছে না, সরা শিল্পীরাও ক্রমে চর্চা এবং বিক্রির অভাবে বৈচিত্র্যময় সরা তৈরিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন।