অন্ধদের শহরের রূপকথা!
মাত্র ৮ বছর বয়সেই লিওন পোর্জ ক্রমাগত তার চোখের দৃষ্টি খোয়াতে শুরু করেছিল কোনও এক জন্মগত কারণে | রোগটি প্রথম ধরা পরে যখন তাকে একটি কম্পিউটার দেওয়া হয় চর্চা করার জন্য | সেই কম্পিউটার মেশিন নির্গত যে সমস্ত শব্দ ও স্বর তাকে বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং ইলেকট্রনিক টেক্সটের পাঠ নিতে সাহায্য করত, তাদের গতিকে দ্রুততর করার কায়দা লিওন যখন আয়ত্ত করে নিয়েছিল তখন তার বয়স মাত্র ৯ | এরফলে ওয়েবসাইটগুলি থেকে পাওয়া যায় এমন সমস্ত তথ্য সে অত্যন্ত দ্রুত করে ফেলতে পারত | বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সাধারণত যে গতিতে শব্দ ও স্বরের মাধ্যমে তথ্যগুলির পাঠ দেওয়া হয় তার তুলনায় পাঁচগুণ গতির তথ্যপাঠ লিওন এখন তার শ্রবণশক্তিতে ধারণ করতে পারে, যা একটি অপ্রশিক্ষিত ও সাধারণ মানের শ্রবণশক্তিযুক্ত মানুষের কাছে বোধগম্য নয় |
লিওনের বেড়ে ওঠা মধ্য জার্মানির একটি শহরে | সেখান থেকে কাছেই রয়েছে আরেকটি গাছপালা ও শ্যামলিমায় ঘেরা শহর, নাম মার্বার্গ | এই মধ্যযুগীয় শহরটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিখ্যাত | অন্ধ ছেলে-মেয়েদের বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত করার কাজে বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন একটি স্কুল আছে এই মার্বার্গ শহরে | সেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিজ্ঞান চর্চার প্রতি লিওনের আগ্রহ সত্যি সত্যি বেড়ে ওঠে | এই আগ্রহ এবং ওই স্কুলের শিক্ষা লিওনকে নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে দেয় |
এই স্কুল আজ মার্বার্গ শহরের গর্ব | অন্ধ এবং ক্ষতিগ্রস্ত দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষদের আশ্রয় এবং সেবাদানে বিশেষ দক্ষতা ও নিষ্ঠার কারণে মানুষ এই শহরটির নাম রেখেছে 'ব্লাইন্ডেনস্টাট' বা 'ব্লিস্টা' | প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবে যে সমস্ত তরুণ ছেলে - মেয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিল, মূলতঃ তাদের সাহায্যার্থেই এই স্কুলটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল | সেই থেকে অন্ধ মানুষদের শক্তি জোগানোর উদ্দেশ্যে এই স্কুল একের পর এক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে |
এই সব গবেষণার পাশাপাশি গোটা মার্বার্গ শহরটাকে এমন ভাবে আধুনিক সরঞ্জামে সাজানো হয়েছে যা সর্বার্থে অন্ধ মানুষদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার কাজে প্রতি পদে সাহায্য করে | চতুর্দিকে নানা রকমের পথনির্দেশক যন্ত্রের ঠকঠক ঠনঠন শব্দ অন্ধ মানুষদের পথ চলতে ইশারা দিয়ে সাহায্য করে | ফুটপাথের ওপরকার বাম্পগুলি এবং কিনারাগুলি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে অন্ধ মানুষেরা স্পর্শের মাধ্যমেই বুঝে নিতে পারে কোথায় বাধা আছে | শহরের বিভিন্ন বাড়ির নকশা এবং ফ্লোর-প্ল্যান বাড়ির সামনে এমনভাবে সাজিয়ে রাখা আছে যে অন্ধ মানুষেরা স্পর্শেন্দ্রীয়ের মাধ্যমে সেগুলি বুঝে নিতে পারে | মার্বার্গ শহরের প্রাচীন দুর্গ, টাউন স্কোয়ার এবং অন্য দর্শনীয় স্থানের ব্রোঞ্জ-মডেলের ক্ষুদ্র সংস্করণ এমনভাবে প্রকাশ্য স্থানে সাজিয়ে রাখা আছে যে অন্ধ যাত্রীরাও সেই সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানের পরিপূর্ণ অনুভব ও আন্দাজ পেতে পারে |
মার্বার্গ শহরের প্রাকৃতিক অবস্থানটিও এই সমস্ত আয়োজনের পক্ষে সর্বার্থেই অনুকূল | এটি একটি ছোট পাহাড়ি শহর | পাহাড়ি শহর হওয়ার ফলে, সেখানে একজন অন্ধ মানুষ ওপর দিকে যাচ্ছে অথবা নিচের দিকে নামছে এই বিষয়টির ওপর নজরদারি চালিয়ে অন্ধ মানুষটিকে সহজে পথনির্দেশ দেওয়া যায় | সারা মার্বার্গ শহর জুড়ে অন্ধ মানুষদের অবসর যাপনের ও বিনোদনের জন্য বিভিন্ন আয়োজন আছে | যেমন অন্ধদের জন্য ঘোড়ায় - চড়া শেখানোর স্কুল | যেমন অন্ধদের জন্য নৌকাবিহার, ফুটবল, পাহাড়ে চড়া এবং বরফের ওপর ছোড়ে বেড়ানো শেখার ক্লাব | মার্বার্গ শহরে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি আছে তার অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীই অন্ধ, যারা বিভিন্ন বিষয় শিক্ষালাভ করেছে এবং পাঠান্তে বিভিন্ন সম্মানজনক ডিগ্রীলাভ করেছে |
ব্লিস্টার অন্ধ ছাত্র-ছাত্রীরাও অনেক গবেষণাধর্মী কাজ করেছে এবং অন্ধ-সহায়ক বস্তুর উদ্ভাবন করেছে | অন্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করার এবং গবেষণা করার সুযোগ পায়, সে বিষয়েও তারা তৎপরতা দেখায় | উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে তাদের পছন্দের বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল আইন এবং মনস্তত্ত্ববিদ্যা | বিষয়গুলির পাঠবস্তু সুদীর্ঘ, গভীরতাপূর্ণ এবং স্ক্রিন রিডারের মাধ্যমে সেগুলি সহজে পড়া যায় বলে জনপ্রিয়ও বটে | বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এবং অন্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের যৌথপ্রচেষ্টায় আর একটি বাধার প্রাচীর অতিক্রম করেছে | এতকাল অন্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রকৃতিবিজ্ঞান চর্চার সুযোগ ছিল না | এবার সেই বাধাও সরিয়ে ফেলা হল |
লিওন পোর্জ, যার কথা দিয়ে এই প্রতিবেদন শুরু হয়েছে, সে এখন ডাসেলডর্ফে বায়োকেমিস্ট্রি এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র | বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়ের অন্ধ ছাত্র হিসেবে সেই প্রথম |
কেমিস্ট্রির চর্চা করতে গেলে প্রচুর ল্যাবরেটরির কাজ করতে হয়, যা অন্ধ ছাত্র -ছাত্রীদের পক্ষে কষ্টসাধ্য | এর সঙ্গে প্রচুর ইমেজ, চার্ট এবং গ্রাফের থেকেও পাঠ নিতে হয় | এই সব কারণে কেমিস্ট্রি চর্চার দরজা অন্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একরকম বন্ধই ছিল | কিন্তু কেমিস্ট্রির বিখ্যাত শিক্ষক টোবিয়াস মাঙ্কে, যিনি মার্বার্গ-এর কার্ল স্ট্রেল স্কুলে লিওন পোর্জ-এর শিক্ষক ছিলেন, মতপ্রকাশ করেছেন যে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশুনার ব্যাপারে অন্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এত বিধি-নিষেধ থাকা উচিত নয় | সে সব বিধি-নিষেধ অযৌক্তিক | মাঙ্কে বলেছেন - "কোনও মানুষই অণু দেখতে পান না, কোনও মানুষই পরমাণু দেখতে পান না | তা সত্ত্বেও কেমিস্ট্রির চর্চা সকলের কাছে এত দৃষ্টিগোচর| তার কারণ কী? দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন মানুষেরা যখন ওই বস্তুগুলির কিছুই দেখতে পায় না, তখন অন্ধ মানুষেরা সে সব বিষয়ে চর্চা করতে গেলে তার পথে কোনও অসুবিধা সৃষ্টি করা উচিত নয় |"