বৃষ্টি-বিকেল ও কাগজের নৌকা
বৃষ্টির একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। মরসুমের প্রথম বর্ষা যখন নেমে আসে আর্দ্র-তপ্ত পৃথিবীর বুকে, তখন একটা মনকেমন করা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এমন একটা গন্ধ, যার বিকল্প আজ অবধি বিশ্বের কোনও সুগন্ধি প্রস্তুতকারক কৃত্তিমভাবে তৈরি করতে সক্ষম হননি। বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বৃষ্টির এই নিজস্ব গন্ধ সৃষ্টি হওয়ার বেশ কিছু কারণ থাকলেও মানুষের মন সেই সব রহস্য কোথায় আর ভেদ করতে চায়! মানুষের মন বরং মেঘলা দিনে উড়ে যায় দূর তেপান্তরের মাঠে। যে মাঠের মাঝ বরাবর দু'টো গাছ একটা দমকা ঝোড়ো হাওয়ার বাহানায় এলিয়ে পড়ে একে অপরের বুকে। মানুষের মন বৃষ্টিদিনে কাগজের নৌকা বানায়, যে নৌকা দিকভ্রষ্ট হয়ে সে হারিয়ে ফেলেছিল ছেলেবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার অথৈ সমুদ্রের দিকে পাড়ি দিতে দিতে। মানুষের মন আজীবন ছাতা হারিয়ে ফেলতে চায় ঘোর বর্ষায়। কিন্তু দায়িত্ববোধ তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় সে বর্ষাতির কথা, সে আরও শক্ত করে ধরে নেয় ছাতার বাঁট।
মানুষের মন মুষলধারে বৃষ্টির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে নেমে পড়ে কাদা মাখা মাঠে। প্রিয়বন্ধুদের সঙ্গে আরেকবার ফুটবল খেলতে, কাদা মাখামাখি করে ওলটপালট খেতে। জমা জলে ঝপাং করে লাফ দিতে, টিনের চালে বৃষ্টির গান শুনতে, পাতাদের গা বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটার ঝরে পড়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে, প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে ময়দান যেতে, মাঝদরিয়ায় মাঝির গান শুনতে...
হঠাৎ খুব শীত শীত করছে বুঝতে পেরে এসির রিমোটটা হাতে নিয়ে বন্ধ করে দিল সৌমিক। তার এমএনসি কোম্পানির এই বহুতল বিল্ডিংয়ের ২৭ তলাটা বৃষ্টি বাদলার দিনে এমনিই ঠাণ্ডা থাকে। সকাল থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে শহরের প্রত্যেক কোণায়। এখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় দুপুর দু'টো ছুঁইছুঁই, অথচ একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। একবারের জন্যও থামছে না। সৌমিক তার কেবিনের বাইরের দিকের ব্যালকনিটার দিকে তাকিয়ে এতক্ষন যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে খেয়াল হল, আজ তার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা। বাবাকে নিয়ে সন্ধেবেলা আবার নার্সিংহোমে যাওয়ার কথা। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
সৌমিকের বাবার বয়স বছর ৮২। ভদ্রলোকের হৃদপিণ্ডে কিছু গণ্ডগোল ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছেন, ৯৫ শতাংশ ব্লকেজ। বাঁচার চান্স নেই বললেই চলে। হয়তো অপারেশন টেবিলেই... ভদ্রলোক এই সবের পুরোটাই জানেন অবশ্য। ততদিন অবধি ডাক্তারবাবু খুব সাবধানে রাখতে বলেছেন ওঁকে। হাঁটাচলা একদম বারণ। গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সৌমিক দেখল এক হাঁটু জল জমেছে শহরের বুকে। বাড়ি ফিরেই বাবার কাছে গিয়ে সৌমিক বাবাকে রেডি হয়ে নিতে বলে, গাড়ির কাছে ফিরে এল আবার। খানিকক্ষণ পর সৌমিকের বাবা বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা কালো প্লাস্টিকের প্যাকেটে কী যেন নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে। গাড়িতে বাবাকে বসিয়ে সৌমিক গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে চলল নার্সিংহোমের দিকে। বৃষ্টিটা এখনও এক নাগাড়ে পড়েই চলেছে। একটা সিগন্যালে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে হঠাৎ পিছন ঘুরে বাবার দিকে তাকিয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল সৌমিক...
সৌমিক দেখল, কালো প্লাস্টিকটা থেকে বছর বিরাশির মৃত্যুপথযাত্রী ভদ্রলোক একটা একটা করে লাল নীল কাগজ দিয়ে বানানো নৌকা ভাসিয়ে দিচ্ছেন বৃষ্টির জমা জলে আর আনমনে হেসে উঠছেন একগাল। তারপর গাড়ির জানলা থেকে হাত বাড়িয়ে হাতের তালুতে ধরে ফেলছেন বৃষ্টির ফোঁটা। মুখ বাড়িয়ে মেখে নিচ্ছেন বৃষ্টির ছাঁট। কান পেতে শুনছেন বৃষ্টির আওয়াজ। আকাশে জমা ঘন কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধ নয়নে। বিকালের পড়ন্ত রোদ্দুরের মতো ভদ্রলোকের মুখে লেগে থাকা একগাল হাসি যেন ছড়িয়ে পড়ল সৌমিকের দমবন্ধ করা এমএনসি কোম্পানির কেবিনে, সেই দূর-তেপান্তরের মাঠে, ছাতা হারানো দিনগুলোয়, কাদামাখা শৈশবের বিকালে, ঝপাং করে লাফ দেওয়া বৃষ্টির জমা জলে, প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে বৃষ্টি ভেজা ময়দানী দুপুরে আর শহরের অলিতে গলিতে জমে থাকা বৃষ্টি জমা জলে; বৃষ্টিকে ভালোবেসে কাটিয়ে দেওয়া একটা জন্মের লাল নীল কাগজের ইচ্ছের নৌকা হয়ে।