বাম ঘরানা থেকে বিজেপি, এখন কোন পথে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়?
Abhijit Gangopadhyay: অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সেই রাম-বামের একটি আদর্শ উদাহরণ। যিনি নিজেকে বামপন্থী বলে পরিচয় দিলেও যখন-তখন রামের জ্যাকেটটা গায়ে পরে নিতে পারেন।
তৃণমূলের বিরোধিতা ছিল তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। সেই বিরোধিতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তিনি যোগ দিয়েছিলেন বিজেপিতে। কিন্তু এক বছরের মাথায় যেন দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে। তমলুকের সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এখন শুধু বিরোধিতার মুখ নন, তিনি হয়ে উঠেছেন দলের ভেতরের এক অস্বস্তির কারণ। একের পর এক মন্তব্যে স্পষ্ট, কেন্দ্রীয় বিজেপির নীতি এবং বাংলায় দলের রাজনীতি নিয়ে তিনি গভীরভাবে অসন্তুষ্ট।
অভিজিতের অভিযোগ, রাজ্যে দুর্নীতি ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে; কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত হাত গুটিয়ে বসে আছে। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে এক তীব্র হতাশা— “বাংলায় রাজনৈতিক পরিবর্তন চাইলে কেন্দ্রের সদিচ্ছাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সেটা দেখা যায়নি।” শুধু তাই নয়, তিনি সরাসরি কটাক্ষ করেছেন দিল্লির নেতৃত্বকে— “হিন্দি বলয়ের নেতাদের এনে বাংলায় ভোট করানো যাবে না। দিল্লির নেতারা বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতি বোঝেন না।”
এই বক্তব্যই এখন রাজনৈতিক মহলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তাঁর উত্তরও জল্পনা আরও বাড়িয়েছে। প্রশ্ন ছিল, বিজেপি কি সত্যিই তৃণমূলকে সরাতে চায়, না কি চায় না? জবাবে অভিজিৎ বলেন, “বিজেপি সরাতে চায় কি চায় না— এটা অনেক গভীর প্রশ্ন। আজ সেই প্রশ্নে যাচ্ছি না।” তারপরই তিনি যোগ করেন, “কিছু দিন বাদে হয়ত যাব।” এর পর থেকেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক কৌতূহল— তাহলে কি দল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি?
আরও পড়ুন
‘গো ব্যাক’ স্লোগানের মুখে চাকরিপ্রার্থীদের সেই ‘মসিহা’! কেন অভিজিতের এই পরিণতি?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন সেনগুপ্ত ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন,অভিজিৎ গাঙ্গুলি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে, এখানকার গোদী মিডিয়া তাঁকে ভগবান বানিয়েছিল। তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনিই যেন মূর্ত প্রতিবাদ, এমনটা অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন। তাঁকে নিয়ে বাম মহলেও উৎসাহের অন্ত ছিল না। তিনি যখন বিজেপিতে যোগ দিলেন, তখন বাম মহল ও মূষড়ে পরে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি দেখলেন বঙ্গ বিজেপি বলে কিছু নেই, পুরো বিজেপিকেই চালনা করা হয় দিল্লি থেকে, সঠিকভাবে বলতে গেলে মোদী এবং অমিত শাহ এই দু'জনেই বিজেপিকে পরিচালনা করেন।"
তিনি আরও বলেন, "তাঁর রাজনৈতিক অপরিপক্বতা তাঁকে এই বোধ দেয়নি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যেতে পারে যদি তাঁকে গ্রেফতার করা হয় বা এই রাজ্যে ৩৫৫ ধারা লাগু হয়। অভিজিৎ বাবু হয়ত আশা করেছিলেন তাঁকে মুখ করে বঙ্গ বিজেপি বাংলায় লড়বে, সেটাও না হওয়াতে তিনি হয়ত আশাহতও হয়েছেন। সেই জন্যেই এখন শূন্যে ছড়ি ঘুরিয়ে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখানোর চেষ্টা ছাড়া তাঁর কথার কোনো মূল্য নেই বাঙলার রাজনীতিতে।"
রাজনীতির শুরুটা অবশ্য তাঁর ছিল একেবারে অন্য। একসময় তিনি বামপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় ধীরে ধীরে গা ভাসান ডানপন্থায়। গত কয়েক বছরে বাংলায় চালু হয়েছে রাম-বাম নামক লব্জ। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সেই রাম-বামের একটি আদর্শ উদাহরণ। যিনি নিজেকে বামপন্থী বলে পরিচয় দিলেও যখন-তখন রামের জ্যাকেটটা গায়ে পরে নিতে পারেন। একদিকে বাম রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসা, অন্যদিকে বিজেপির ‘হিন্দি বলয়’-নির্ভর নীতিতে হতাশা— দুইয়ের মাঝখানেই আজ যেন দোদুল্যমান তিনি।
আরও পড়ুন
কখনও রোহিঙ্গা, কখনও নারীত্ব নিয়ে প্রশ্ন! মমতাকে যে চোখে দেখেন অভিজিৎ
অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরানো হবে। কিন্তু এই সরানো মানে কী? আসলে তো গণতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন জয় লাভ করে ক্ষমতায় আসতে হয়। প্রশ্ন উঠছে, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কি সরাসরি কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারির ইঙ্গিত দিচ্ছেন? তেমন আশ্বাস আদায় করেই কি তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অভীপ্সায় বিজেপির টিকিট নিয়েছিলেন। বামের পথ থেকে ডানের পথে এসেছিলেন কিঞ্চিৎ লাভের আশায়?
তাঁর সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো দেখে অনেকেই বলছেন, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় আজ রাজনৈতিক সঙ্কটে দাঁড়িয়ে। বাম থেকে ডান, দুই পথই তিনি হেঁটেছেন, কিন্তু কোনো দিকেই যেন স্থিতি পাননি। বিরোধিতা তাঁর পরিচয়, কিন্তু সেই বিরোধিতার রাজনীতিতেই যেন আজ নিজের অবস্থান হারিয়ে ফেলছেন তিনি। রাজনীতির মঞ্চে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এখন ক্ষোভ, সংশয় এবং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝখানে। প্রশ্ন একটাই, তিনি কি এবার নতুন কোনো পথ বেছে নেবেন, নাকি এই ক্ষোভ থেকেই শেষ পর্যন্ত আরও এক নতুন রাজনৈতিক মোড় নেবেন?

Whatsapp
