অভিষেকের সম্পত্তির পরিমাণ ঠিক কত
Abhishek Banerjee: অভিষেকের সম্পত্তির পরিমাণ কি বিপুল? হাজরার বিরাট প্রাসাদোপম বাড়ির মালিকের ঠিক কত টাকা?
ব্রেকিং নিউজ! দেশ কাঁপিয়ে এবার সিনেমায় নামছেন বঙ্গের 'ভাইপো'! নতুন অবতারে নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও (Mamata Banerjee)। এ-খবর সত্যি নয় যদিও। আসলে, সদ্য ৩৫ -এ পা দেওয়া তৃণমূল (AITC TMC) এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Abhishek Banerjee) নিয়ে সিনেমা বানিয়ে চমক দিয়েছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (TMCP) । থিম সংয়ের পরে, অভিষেক-কেন্দ্রীক সিনেমা বানিয়ে তাক লাগিয়েছে তারা। প্রশ্ন উঠেছে, ক্রমশ তৃণমূলের সর্বেসর্বা মমতাকে ছাপিয়ে কর্মীদের মধ্যে অভিষেকের প্রাধান্য কি ক্রমশ বাড়ছে?
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের (Assembly Election) আগে থেকে এই প্রশ্ন, জন্মদিন আর সমস্তকিছু কাটিয়ে দেশের খবরের দুনিয়ায়ও এগিয়ে রেখেছে অভিষেককে। খানিকটা নব্বইয়ের দশকের মমতার অবস্থানের সঙ্গে তৃণমূলের 'যুবরাজ'কে নিয়েও জল্পনা বাড়াচ্ছেন কেউ কেউ।
এখানেই, এই জল্পনা-কল্পনা আর অভিষেক-কথকথার মধ্যে কড়া নাড়ছে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির (Assets) পরিমাণ নিয়েও! রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (Chief Minister) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'উত্তরসূরি'র সঙ্গে, তাঁর স্ত্রী রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Rujira Narula Rujira Banerjee) নিয়ে অভিযোগ, গরু-কয়লা পাচারে দুর্নীতির অভিযোগ জড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেই দেশের একটা বড় অংশের, বিশেষত তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের নজর পড়েছে অভিষেকের সম্পত্তির উপর! তাঁর নাকি বিপুল পরিমাণে সম্পত্তি বেড়েছে। শুধু তিনি নন সম্পত্তি বেড়েছে তাঁর স্ত্রী-রও! গত কয়েক বছরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি ধনী হয়েছেন তরতরিয়ে।
আরও পড়ুন: ঠিক কী হয়েছিল অভিষেকের চোখে? সাত ঘণ্টার অপারেশনের নেপথ্যে লুকিয়ে যে সত্যি
অনেকেই বলছেন, সেটাই স্বাভাবিক। তিনি শিক্ষিত, চাকরি করতেন। আবার দলের তরফে লোকসভার সাংসদ। তাই, তাঁর বেতন রয়েছে, সুবিধা রয়েছে ধনী তো হবেনই!
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এখানেও। ধনী হবেন, তাই বলে বিপুল পরিমাণে সম্পত্তি বাড়বে? এই প্রশ্ন তুলেই অভিষেকের নাম না নিয়েও 'ভাইপো'কে সম্পত্তি-খোঁচা দিতে ছাড়েননি একদা মমতার কাছের লোক শুভেন্দু অধিকারী। দাবি করা হয়, শুভেন্দুর তৃণমূল ছাড়ার অন্যতম কারণ নাকি এই অভিষেকই! সম্প্রতি, বিজেপির নবান্ন অভিযান, পুরুষ-মহিলা পুলিশের স্পর্শ বিতর্কেও বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এই দু'জন।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? অভিষেকের সম্পত্তির পরিমাণ কি বিপুল? হাজরার বিরাট প্রাসাদোপম বাড়ির মালিকের ঠিক কত টাকা?
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে তখন নির্বাচন কমিশনে সরকারিভাবে সম্পত্তির খতিয়ান দেবেন তিনি। কিন্তু তার আগে? কেন তৈরি হয়েছে এই সম্পত্তি-বিতর্ক!
২০১৯ সাল। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় লোকসভা নির্বাচনে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার আসনে, তৃণমূলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। যদিও তার আগে মমতার দলেরই যুব সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন তিনি। তখন রাজ্যে এই সংগঠনের দায়িত্বে স্বয়ং শুভেন্দু। ২০১১ সাল থেকে সক্রিয় রাজনীতিতে নামার পরে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে (Loksabha Election) অংশ নিলেন অভিষেক। সেই সময় নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় অভিষেক জানান;
২০১২-২০১৩ অর্থবর্ষে অভিষেকের আয় ৪৪ লক্ষ ৬৪ হাজার ১০১ টাকা। তাঁর স্ত্রী-র আয়ের পরিমাণ ২৯ লক্ষ ৩৩ হাজার ৯৪৯ টাকা। অভিষেকের হাতে নগদের পরিমাণ ২২ হাজার ৭৩০ টাকা। রুজিরার কাছে নগদ দেখানো হয়েছিল ২০ হাজার ৫০০ টাকা।
বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক কোম্পানি, নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক সংস্থা মিলিয়ে অভিষেকের নামে টাকা জমা রয়েছে ৪২ লক্ষ ৭২ হাজার ৬২৪ টাকা। একই ক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রী-র রয়েছে, ২৮ লক্ষ ৯২ হাজার ১৫ টাকা। এই ক্ষেত্রে তাঁর কন্যার নামে ছিল ১০ লক্ষ ৯ হাজার ২৯ টাকা।
এনএসএস পোর্টালে জমা ছিল প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকার শেয়ার কেনা ছিল অভিষেকের। স্ত্রী রুজিরার নামে ছিল প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার শেয়ার। অভিষেকের নামে জীবন বীমায় জমা ২ লক্ষ ৭৫ হাজার ৯১৯ টাকা। আবার ৫ লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত ঋণের কথাও ওই হলফনামায় জানান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৎকালীন বাজার মূল্যে ৬৩ হাজার ৮০০ টাকার ২২ গ্রাম সোনা। ১ হাজার ৯০০ টাকার ৪০ গ্রাম রূপো রয়েছে তাঁর, একথাও বলেন অভিষেক।
রুজিরার সোনা, রূপো এবং হীরে মিলিয়ে ওই সময়ের হিসেবে প্রায় ২২ লক্ষ টাকার গয়না রয়েছে বলেও বলা হয় ওই হলফনামায়। অস্থায়ী সম্পত্তির মধ্যে ৩০ লক্ষ টাকার ফ্ল্যাট। সুদ বাবদ লক্ষাধিক আয়। এর সঙ্গেই নানা ক্ষেত্রের আয় মিলিয়ে তখন অভিষেকের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৭ লক্ষ ৮১ হাজার ৭৫০ টাকা। আর রুজিরার সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৫৪ লক্ষ ৮ হাজার ৪৯৩ টাকা। তাঁদের সন্তান আজানিয়ার সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১০ লক্ষ ৯ হাজার ২৯ টাকা।
২০১৪-২০১৯। অভিষেকের সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি নিয়ে বারবার কটাক্ষ করেছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা। যা বাড়ে ২০১৯ সাল নাগাদ ফের লোকসভা নির্বাচনের আগে যখন হলফনামা পেশ করেন অভিষেক। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া ওই হলফনামায় জানানো হয়;
২০১৭-২০১৮ অর্থবর্ষে অভিষেকের সম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৭১ লক্ষ ৪০ হাজার ৭৩৯ টাকা। তাঁর স্ত্রী রুজিরার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯১৫ টাকা ৪৮ পয়সা। তাঁর কন্যার সম্পত্তি বেড়ে হয়েছে ৩০ লক্ষ ৯৭ হাজার ৬৬৪ টাকা ৭৪ পয়সা।
যদিও কর প্রদানের ক্ষেত্রে ২০১৭-২০১৮ অর্থবর্ষে অভিষেকের বার্ষিক আয় দেখা যায় প্রায় ৭৫ লক্ষ টাকার আশপাশে। অন্যদিকে রুজিরার ক্ষেত্রে কোটি ছাড়ায় সেই পরিমাণ।
অভিষেকের এই সম্পত্তি বৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক বাড়ে তাঁর স্ত্রী-কে নিয়েই। ২০১৯-এর মার্চ মাস। লোকসভা নির্বাচনের প্রাকমুহূর্তের উত্তেজনার মধ্যেই প্রকাশ্যে আসে চাঞ্চল্যকর খবর। জানা যায়, দমদম বিমানবন্দরে বেআইনি সোনা-সহ আটক করা হয়েছে অভিষেক পত্নীকে। কিন্তু তিনি সহযোগিতা করার বদলে প্রভাব দেখিয়ে সরে গিয়েছেন। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূল। প্রকাশ্যে এই ঘটনা প্রমাণ করতে না পারলে রাজনীতি ছাড়ার হুঁশিয়ারিও দেন অভিষেক। যদিও দেখা যায় ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৯ এ এসে, প্রায় ২০৬ শতাংশ সম্পত্তি বাড়িয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিন্তু শুভেন্দু-র বিজেপি যোগে এই অভিযোগের পারদ বাড়তে থাকে আরও। একের পর এক জনসভায় অভিষেকের সম্পত্তি নিয়ে বিতর্ক বাড়ান তিনি। এমনকি ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের অন্যতম ইস্যু হয়ে ওঠে অভিষেকের সম্পত্তি বৃদ্ধি!
বারবার দাবি করা হয়, এই কয়েক বছরে নাকি বিপুল হারে সম্পত্তি বেড়েছে অভিষেকের। এমনকি তাঁর পোশাক থেকে গাড়ির ব্যবহার, বাড়ির নকশা থেকে স্ত্রী-র বিদেশ ভ্রমণ, সবক্ষেত্রেই ওঠে প্রশ্ন! যা বাড়ে ২০২২ সাল আসতেই। একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ, বিনয় মিশ্র থেকে শুরু করে কয়লা, গরু পাচারের অভিযোগে অভিষেককে আক্রমণ শানান বিরোধীরা। 'তোলাবাজ ভাইপো' বলেও কটাক্ষ ছুড়তে থাকেন শুভেন্দু।
অভিযোগ, ২০১৯ এ দেখানো হলফনামার সম্পত্তির পরিমাণ আসলে বহুগুণ বেড়েছে! ৬৩৮ গ্রাম সোনা, প্রায় ২ কেজি ৩০০ গ্রাম রূপো নয়, অভিষেক-পত্নীর গহনা এবং অর্থের পরিমাণও নাকি চোখে পড়ার মতো। অর্থাৎ দুর্নীতিতে হাতিয়ার করে রাজ্যের শাসকদলের অন্যতম নেতার ব্যক্তিগত বিলাসবহুল জীবন নিয়েই প্রশ্ন তোলেন বিরোধীরা। এমনকি তাঁর সাম্প্রতিক আমেরিকা গমন এবং চোখের চিকিৎসার খরচ নিয়েও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি তথাগত রায়ের মতো বিজেপি নেতারা।
তাহলে ঠিক কেন এই পরিস্থিতি? কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে যে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি তৃণমূলকে। সেই সম্পত্তি নিয়ে প্রশ্নের মুখে কেন অভিষেক?
রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক কত টাকার মালিক, তাঁর স্ত্রী-র সম্পত্তির পরিমাণ কত, সম্পত্তির বৃদ্ধির হার বিস্তারিত নির্বাচন কমিশনে জানানো রয়েছে, তাই যতক্ষণ না অবৈধ কিছু প্রমাণ না করা যাচ্ছে, ততক্ষণ তাঁর বলা কথা সত্যি এটাই ধরে নিতে হবে। সেখানে দাঁড়িয়ে বরাবর আর্থিকভাবে স্বচ্ছল একটি পরিবারের মেয়ে, তাঁর স্ত্রী রুজিরা বা এত বছরে বাড়তে থাকা অভিষেকের সম্পত্তি খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু দেখায় না।''
তবে এই বৃদ্ধিকেই হাতিয়ার করেছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাঁরা অনেকেই, নীতি-আদর্শের পাশাপাশি ব্যক্তি আক্রমণে সরব। আর এখানেই উঠেছে অভিষেক-প্রশ্ন। যা বাড়িয়েছেন তাঁর স্ত্রী-ও।
তাহলে এখন উপায়? ওই অংশের দাবি, অভিষেক এবং সমগ্র বিরোধীদের এই লড়াই চমকপ্রদ হতে পারে ২০২৪ এর আগে। তখন ফের সম্পত্তির তথ্য, নির্বাচন কমিশনে জমা দেবেন তিনি (যদি নির্বাচনে প্রার্থী হন)। আর সেখানেই স্পষ্ট হতে পারে কে ঠিক? শুভেন্দু নাকি অভিষেক। সম্পত্তির স্বচ্ছতা নাকি অবৈধ বৃদ্ধির দাবি!