ক্যাপিটল হিলে হইচই, আমেরিকা লুকিয়ে রেখেছে 'বঙ্কুবাবুর বন্ধু'কে?

UFO Hearing: ভিন গ্রহের কোনও যান পৃথিবীতে আছড়ে পড়লে বা এনকাউন্টারে মাটিতে নামানো হলে কেন তাকে গোপন রাখা হবে?

ওয়াশিংটন ডিসি-র ক্যাপিটল হিল। মার্কিন সেনেট, সুপ্রিম কোর্ট, সেনা ব্যারাক সব এখানেই। আমেরিকার ক্ষমতা ও গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র। ২৬ জুলাই ক্যাপিটল হিলের হাওয়া-বাতাসে রুদ্ধশ্বাস হইচই। প্রাক্তন গোয়েন্দা অফিসার হুইশলব্লোয়ার ডেভিড গ্রাশ বোমা ফাটাবেন। হাউজের প্রতিনিধিদের সামনে শপথ নিয়ে বলবেন এত দিনের চেপে যাওয়া রহস্য। যে শুনানির পোশাকি নাম 'ইউএফও বা ইউএপি হিয়ারিং'।

ইউএফও হিয়ারিং বা ইউএপি শুনানি জিনিসটা কী? কেন মার্কিন হাউজে কংগ্রেস প্রতিনিধিদের সামনে একেবারে শপথবাক্য পাঠ করে ডেভিড গ্রাশদের মুখ খুলতে হলো? তাও আবার পৃথিবীর বাইরের কোনও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি এবং এলিয়ন বা ভিনগ্রহী কোনও প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে?

রহস্যের পরত খোলার আগে ডেভিড গ্রাশ চরিত্রটির সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করাই। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ গোয়েন্দা বিভাগের দুঁদে অফিসার। চোদ্দ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে মার্কিন এয়ারফোর্স এবং এয়ার ন্যাশনাল গার্ড রিজার্ভে কাজ করেছেন। মেজর পদমর্যাদার দায়িত্ব সামলেছেন। ২০২১ সাল থেকে ন্যাশনাল জিয়োস্পেসিয়াল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি (NGA) সংস্থায় কাজ করছেন। এখানে পদমর্যাদায় ডেভিড গ্রাশ একজন পেশাদার কর্নেল।

১৯৭৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত একটি বই লাইব্রেরি থেকে পাচার হয়ে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে এসে পড়ে। ডক্টর জে অ্যালেন হাইনেকের লেখা 'দ্য হাইনেক ইউএফও রিপোর্ট'। ডক্টর হাইনেক 'প্রজেক্ট ব্লু বুক'-এর এয়ারফোর্স কনসালটেন্ট। বিশ্বের তাবড় ইউএফও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সেরা বললে কম বলা হয়। বইটির বর্তমান মালিক এই লেখক।

ইউএফও বিশেষজ্ঞ ডক্টর হাইনেকের সহযোগী মিস্টার বাড লেডউইথের আঁকা ছবি। 'কেলি-হপকিন্সভিল'-এর ঘটনার পরের দিন একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানের ভিত্তিতে আঁকা।

কেন এই বইয়ের প্রসঙ্গে টানতে হলো, তা নিয়ে পরে বিস্তারে লিখছি।

হাউজের চেয়ারম্যান এবং কংগ্রেস প্রতিনিধিদের সামনে নিজের পরিচয় দিয়ে মিস্টার গ্রাশ বলতে শুরু করেন। গত জুন মাসে প্রথমবারের জন্য ভিনগ্রহের প্রাণীদের তৈরি মহাকাশযান নিয়ে তাঁর দাবি প্রকাশ্যে আনেন ডেভিড গ্রাশ। বলেন, 'Intact and partially intact' অর্থাৎ 'অবিকল অবস্থায় এবং প্রায় অবিকল অবস্থায় পৃথিবীর বাইরের কোনও মহাকাশযান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করে রেখেছে'। মারাত্মক এবং চাঞ্চল্যকর দাবি। শুধু তাই নয়, সংবাদমাধ্যমের কাছে ডেভিড গ্রাশ দাবি করেন, পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা সেই মহাকাশযানের আয়তন বিরাট। একেবারে কিং সাইজ। একটা ফুটবল মাঠের মতো বড়।

ডেভিড গ্রাশ কি নিজের চোখে দেখেছন এইসব? হাউজের প্রশ্নোত্তর পর্বে এই প্রশ্নগুলিই যে ফলার মতো বিঁধবে তা প্রত্যাশিত ছিল। আর হলোও তাই।

প্রশ্ন: আপনি কি নিজের চোখে স্পেসক্রাফট (মহাকাশযান) দেখেছেন?

উত্তর: বন্ধ ঘরের মধ্যে আমি এর উত্তর দিতে পারব।

আরও পড়ুন- এবার কি সত্যিই আসতে চলেছে ভিনগ্রহীরা? আকাশের ‘রহস্যময় আলো’ নিয়ে তুলকালাম বিশ্ব

২৬ জুলাই ক্যাপিটল হিলের ঐতিহাসিক শুনানিতে ডেভিড গ্রাশের সঙ্গে আর কে কে হুইশল বাজাতে এলেন? ডেভিড ফ্রেভর। প্রাক্তন নৌসেনা কমান্ডার। ২০০৪ সালে প্রশিক্ষণ পর্বে আকাশে অবাস্তব অদ্ভুত যান্ত্রিক বস্তু প্রত্যক্ষ করেন। রায়ান গ্রেভস। অবসরপ্রাপ্ত নৌসেনা পাইলট। ২০২১ সালে সংবাদ মাধ্যমের কাছে রায়ান দাবি করেন, অতলান্তিক মহাসাগরের উপর Unidentified Aerial Phenomena (UAP যা কি না ইউএফও-এর সমার্থক) প্রতিদিন দেখা যেত। আর তা প্রায় বেশ কয়েক বছর ধরে।

মিলিপিপ্পিং খ্রুক। মিলিপিপ্পিং খ্রুক। ক্রেনিয়াস গ্রহের বাসিন্দা অ্যাং। প্রথমে এই শব্দ উচ্চারণ করেন বঙ্কুবাবুর উদ্দেশে। প্লুটোয় যেতে গিয়ে রাস্তা ভুল করে কাঁকুরগাছির পঞ্চা ঘোষের বাঁশবাগানে নেমে পড়ে অ্যাংয়ের মহাকাশযান। অতিকায় উপুড় করা কাচের বাটির মতোন জিনিস। বঙ্কুবাবুর বন্ধু ছাপা হয় সন্দেশ পত্রিকায়। ১৩৬৮ বঙ্গাব্দে।

ডেভিড গ্রাশের মতো একজন পেশাদারের চাঞ্চল্যকর দাবি। ইউএফও বিশারদ ডক্টর অ্যালেন হাইনেকের গবেষণাধর্মী বই। বঙ্কুবাবুর বন্ধু গল্পের অ্যাং। এইসবের মধ্যে কি কোথাও কোনও মিসিং লিংক আছে? তা জানতে রহস্যের আরও গভীরে যেতে হবে।

দ্বিতীয় পর্ব

জাস্ট আ সু-ই-ই-ই-শ। কয়েক মুহূর্তের একটা হুইইশশ্ শব্দ। প্রচণ্ড গতিতে স্নেক রিভার ক্যানিয়নের উপর দিয়ে চোখের পলকে উধাও দুই গোলাকার উড়ন্ত চ্যাপ্টা বস্তু। এই বয়ান ট্রাউট মাছের ফার্ম-মালিক এ সি উরির। ইদাহোর এক ঝরনার কাছে তাঁর ব্যবসা। ফ্লাইং-সসার নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী উরির এই বয়ান প্রায় সাত দশক আগের। কেন বললাম তাঁর মুখে শোনা ওই 'হুইইইশ' শব্দের কথা? কেননা মার্কিন হাউজের প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রায় একই ধরনের বয়ান শোনা গিয়েছে হুইশলব্লোয়ারদের মুখে। 'Can match their speed in a snap' ক্যান ম্যাচ দেয়ার স্পিড ইন আ স্ন্যাপ। উড়ন্ত বস্তু এক ঝটকায় তার গতি প্রয়োজন মতো বদলে দিতে পারে। আর বস্তুটির কোনও ডানা নেই।

চারের দশকের শেষের দিকের কথা। ফ্লাইং-সসার নিয়ে রিপোর্টার জন ব্রসম্যানের একটি প্রতিবেদন সাড়া ফেলে দেয়। সন ১৯৪৭। তারিখ ১৫ অগাস্ট। আমেরিকার 'টাইমস নিউজ' রিপোর্টটি প্রকাশ করে। ঘটনাটি যদিও তার দু'দিন আগের। ডক্টর অ্যালেনের দ্য হাইনেক ইউএফও রিপোর্ট বইয়ে এই তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।

ট্রাউট-ফার্ম মালিক এ সি উরির কথা লিখেছি একটু আগে। তাঁর বয়ানেই বিষয়টা বিশদে বলা যাক।

১৩ অগাস্ট। বেলা ১টা হবে। দিনের আলোয় আকাশ পরিষ্কার। ট্রাউট-ফার্মের উপর দিয়ে দু'টি ফ্লাইং-সসারকে উড়ে যেতে দেখেন উরি। একেবারে কাছ থেকেই দেখেন। স্নেক ক্যানিয়নের জমি থেকে ৭৫ ফিট উঁচু দিয়ে বস্তু দু'টি উড়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে উড়ন্ত যান দু'টির গতি ছিল কম বেশি ঘণ্টায় এক হাজার মাইল। ঠিক ওই সময়ই মিস্টার উরির দুই সন্তান কিথ এবং বিলি ফিরছিল নৌকা নিয়ে। উত্তর দিক থেকে নদী পার হচ্ছিল।

উড়ন্ত যান দু'টির সাইড-ভিউ বা একপাশ থেকে তার গঠন দেখতে পান উরি। দূরত্ব ছিল প্রায় ৩০০ ফিটের মতো। কিথ ও বিলিও উড়ন্ত বস্তু দু'টিকে দেখতে পায়। নদীর বুক থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণাকুণি যান দু'টিকে দেখে দুই ভাই। মিস্টার উরি, কিথ এবং বিলি তিন জনই ক্যানিয়নের দক্ষিণ দিক থেকে দু'টি ফ্লাইং-সসারকে উড়তে দেখেন। তিন জনের বয়ানই মোটামুটি এক। হালকা নীল রংয়ের আকাশযান। যান দু'টির হুডি বা টুপির মতো দেখতে অংশের কাছে লাল টিউবের মতো কোনও আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। উরির মতে, যান দু'টি পারমাণবিক শক্তিচালিত। তাঁর এ রকম মনে করার কারণ, যান দু'টি থেকে প্রায় কোনও শব্দই বের হচ্ছিল না। জাস্ট আ সু-ই-ই-ই-শ। কয়েক মুহূর্তের একটা হুইইশশ্ শব্দ। প্রচণ্ড গতিতে স্নেক রিভার ক্যানিয়নের উপর দিয়ে চোখের পলকে উধাও দুই গোলাকার উড়ন্ত চ্যাপ্টা বস্তু।

স্নেক রিভার ক্যানিয়নের উপরে মিস্টার উরি এবং তাঁর দুই সন্তান যে উড়ন্ত চাকতি দেখতে পায়। ১৫ অগাস্ট ১৯৪৭, টাইমস নিউজ পত্রিকায় ছাপা ছবি।

অদ্ভুত উড়ন্ত বস্তু দু'টিকে উরি দেখেন বেলা ১টা নাগাদ। ওই একই দিন সকাল সাড়ে ৯টা হবে। স্যালমন ড্যামের কাছে একই রকম ফ্লাইং-সসার প্রত্যক্ষ করেন কান্ট্রি কমিশনার এল ডব্লু হকিন্স। এই ঘটনা নিয়ে মার্কিন এয়ার ফোর্সের ব্লু-বুক অ্যাকাউন্টে কী রিপোর্ট করা হয়? রহস্যের গিঁট খানিকটা খুলতে হলে সেটা জানতেই হবে।

ব্লু-বুক রিপোর্ট:

উরির ফার্মের উপর দিয়ে 'মেশিন'গুলি উড়ে যাওয়ার সময় কয়েকটা গাছ বাতাসের চাপে দুমড়ে মুচড়ে যায়। মরমন পপলার গাছ। রিপোর্টে বলা হয়, কোনও প্লেন যেন গাছগুলো ভেদ করে উড়ে গিয়েছে। যদিও উরির মতে, 'পপলার গাছগুলোর মাথা যেন একেবারে ছেঁটে কেটে ফাঁকা করে দিয়েছে কেউ'।

নেহাত কাকতালীয় বা কল্পনার যোগাযোগ হয়তো। কিন্তু পাঠক ভেবে দেখুন, বঙ্কুবাবুর সঙ্গে দেখা করে বন্ধু অ্যাং তো চলে গেলেন নিজের গন্তব্যে। যাওয়ার পরদিন সকালে বাঁশবাগান দেখে তো তাজ্জব পঞ্চা ঘোষ। জন্মে এমন কাণ্ড দেখেননি। বাঁশবনের মধ্যে যে ডোবাটা আছে, তার চারপাশের দশটা বাঁশঝাড় রাতারাতি একেবারে ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে। শীতকালে বাঁশের শুকনো পাতা ঝরে বটে, কিন্তু এভাবে ন্যাড়া হয়ে যাওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক।

মিস্টার উরির বয়ানে, স্নেক নদীর ক্যানিয়নে পপলার গাছগুলোর মাথাও একইরকম ভাবে যেন ন্যাড়া হয়ে গিয়েছিল, ফ্লাইং-সসার উড়ে যাওয়ার পর।

ইউএফও বা ফ্লাইং-সসার রহস্যের শুরুর দিনগুলো থেকেই মার্কিন এয়ারফোর্স গোয়েন্দাবিভাগে দু'ধরনের মত। একদল মনে করতেন ফ্লাইং-সসার নিয়ে ভাবার, রহস্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখবার মতো শুধু জোরালো নয়, পাহাড়-সমান তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। রহস্যময় উড়ন্তযান অন্য কোনও গ্রহ বা দূরের গ্যালাক্সির, এরকম মতেও বিশ্বাস রাখতেন অনেকে। আর এক দলের ধারালো যুক্তি, ব্রহ্মাণ্ড বুঝে নিতে প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক ধারণা যেভাবে প্রতিদিন আধুনিক হয়ে উঠছে, তাতে এই ফ্লাইং-সসার নিয়ে মাথা ঘামানোর বিষয়টি এক কথায় ননসেন্স। যুক্তি-তক্কের যুদ্ধে 'ননসেন্স' তত্ত্বের জয় হয়। মার্কিন সেনামস্তিষ্ক রহস্যযানের গতিবিধির ফাইল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হয় ইউএফও বিরোধী নীতি। যে নীতিকে টলিয়ে দেওয়ার মতোই কাণ্ড ঘটেছে খোদ মার্কিন হাউজে। বোমা ফাটিয়েছেন হুইশলব্লোয়ার ডেভিড গ্রাশ এবং তাঁর দুই সহযোগী।

প্রশ্নোত্তর পর্বের আগে হাউজের সামনে তিন জনের বক্তব্য কী ছিল? সংক্ষেপে একবার বুঝে নেওয়া যাক।

রায়ান গ্রেভসের বয়ান:

মার্কিন নৌসেনায় পেশাদার হিসেবে কাজ করেছেন। UAP বা ইউএফও নিয়ে ফার্স্টহ্যান্ড অভিজ্ঞতা রয়েছে। আকাশে রহস্যময় উড়ানের অস্তিত্ব নিয়ে কমবেশি তিরিশ জন কমার্শিয়াল পাইলটের সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন সেনাবাহিনীর পাইলটদের সঙ্গেও। প্রত্যেকেই তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা রায়ানের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন। রায়ান গ্রেভসের দাবি, UAP নিয়ে সেভাবে রিপোর্ট করা হয় না কর্তৃপক্ষকে। পেশাদারিত্বে কালো দাগ পড়ে যাবে, পাইলটরা এ রকম আশঙ্কা করে থাকেন। ২০১৪ সালে রায়ানের একটি অভিজ্ঞতা হয়। তখন তাঁর আঠারো বছর বয়স। আকাশের অজানা বস্তুকে ভিসুয়াল আইডি ইত্যাদির মাধ্যমে ট্র্যাক করা হয়। কালচে ছাইরংয়ের ওই উড়ন্ত বস্তুকে অনুসরণ করতে গিয়ে একজন পাইলট হিসেবে রায়ান বোঝেন বস্তুটির বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি উন্নত। ২০২১ সাল থেকে UAP সংক্রান্ত যাবতীয় ভিডিও ক্লাসিফায়েড করা হয়। অর্থাৎ ওই সমস্ত ভিডিও এবং তথ্য সাধারণ মানুষের এক্তিয়ারের বাইরে।

ডেভিড গ্রাশের বয়ান:

মূল হুইশলব্লোয়ার। পেশাদার হিসেবে UAP টাস্ক ফোর্সকে রিপোর্ট করেন। মার্কিন হাউজের কংগ্রেস সদস্যদের কাছে ডেভিড গ্রাশের বক্তব্য, তাঁর এই দাবির উপর তদন্ত হোক। প্রকৃত সত্য সামনে আসুক। ২০১৯ সালের একটি অভিজ্ঞতাকে সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন। UAP টাস্ক ফোর্সের তৎকালীন ডিরেক্টর ডেভিড গ্রাশকে একটি বিশেষ কাজের অ্যাসাইনমেন্ট দেন। কাজের সুবাদে গ্রাশ জানতে পারেন UAP এবং রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রাম নিয়ে মার্কিন সরকার বেশ কয়েক দশক ধরেই অনুসন্ধান করছে এবং সে ব্যাপারে তথ্যও রয়েছে।

ডেভিড ফ্রেভারের বয়ান:

অভিজ্ঞ পাইলট। তিন জনের মধ্যে ফ্রেভারের বয়সই সবচেয়ে বেশি। UAP বা ইউএফও-র সঙ্গে 'টিকট্যাক' (Tic-Tac)-এর ঘটনার পর ফ্রেভারের নাম সামনে আসে। ঘটনাটি ২০০৪ সালের। সেসময় ফ্রেভারের প্রশিক্ষণ চলছিল। খবর এল প্রশান্ত মহাসাগরের উপর এক রহস্যময় যানকে দু'সপ্তাহ ধরে দেখা যাচ্ছে। ৮০ হাজার ফিট থেকে মুহূর্তে ২০ হাজার ফিটে নেমে আসছে ওই রহস্যময় উড়ন্ত বস্তু। এক জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেসে থাকতে পারছে। ফের সোজা উঠে যাচ্ছে আশি হাজার ফিট উচ্চতায়। বস্তুটিকে ফলো করতে গিয়ে ফ্রেভার দেখেন যানটির কোনও ডানা নেই। সমুদ্রেপৃষ্ঠের একটু উঁচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পিংপং বলের মতো। অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ফ্রেভার সেদিনের আবহাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেন। বলেন, আকাশ একেবারে স্বচ্ছ ছিল। সমুদ্রের জল নীল। রহস্যময় যানের সঙ্গে ফ্রেভারের বিমানের এ সময় একটি ৯০ সেকেন্ডের 'টিকট্যাক' হয়। এরপর এক সময় মূহূর্তের মধ্যে গতিপথ বদলে রহস্যময় আকাশযান নজরদারি রেডার থেকে উধাও হয়ে যায়। ৯০ সেকেন্ডের সেই 'টিকট্যাক' ইদানীং ডিক্লাসিফায়েড করা হয়েছে।

UAP কি সত্যিই আছে? এ রকম কোনও রহস্যময় যান কি সত্যিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বকে লুকিয়ে কোনও গোপন ডেরায় বাজেয়াপ্ত রেখেছে? সেই যানে কি কোনও পাইলট ছিল? থাকলে তিনি কি মানুষ না অন্য কিছু? হাউজের প্রশ্নোত্তরে এরকম সব সোজাসাপটা প্রশ্ন উড়ে এল ডেভিড, রায়ানদের দিকে। যার উত্তর, আরও বিস্ফোরক।

আরও পড়ুন- চাঁদে কি আদৌ কোনও দিন পা দিয়েছিলেন নীল আর্মস্ট্রং?

তৃতীয় পর্ব

নব্বই সেকেন্ডের 'টিকট্যাক'। অজানা উড়ন্ত বস্তুর সঙ্গে এনকাউন্টারের বর্ণনা দিতে গিয়ে 'টিকট্যাক' শব্দকেই বেছে নিয়েছেন ডেভিড ফ্রেভার। তা নিয়ে মার্কিন হাউজের প্রশ্নোত্তর পর্বে এক দফা মস্করাও হয়েছে। ক্যান্ডি টিকট্যাক, কমিউনিস্ট চিনের অ্যাপ টিকটক, অজানা উড়ন্ত বস্তুর সঙ্গে টিকট্যাক। ক্লাসিফায়েড সেই ভিডিও ফুটেজ কয়েক বছর হলো পেন্টাগন ডিক্লাসিফায়েড করেছে। ফুটেজ এখন ইন্টারনেটে দেখা যাচ্ছে।

এয়ারফোর্স যুদ্ধবিমানের ড্যাশবোর্ডে রেকর্ড করা ফুটেজ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে রহস্যময় উড়ন্তযান। বাতাসের গতির উল্টো অভিমুখে। জায়গাটা সান্তিয়াগো উপকূলের কাছাকাছি। আগেই লিখেছি ডেভিড ফ্রেভারের বয়ানের সূত্র ধরে। সেদিন আকাশ ছিল একেবারে পরিষ্কার। সমুদ্রের জল নীল। টার্গেটকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। উড়ন্ত বস্তুটি উড়তে উড়তেই পাক খাচ্ছিল। তারপর এক সময় উধাও। ২০০৪ সালের ঘটনা।

প্রশ্ন উড়ে এল কংগ্রেস সদস্যদের বেঞ্চ থেকে। রায়ান গ্রেভস, আপনি কীভাবে বুঝলেন যে ওটা আমাদের এয়ারক্রাফট নয়? 'আমাদের' বলতে মানব সভ্যতা যে বৈজ্ঞানিক সূত্রে আকাশযান নির্মাণ করেছে, সম্ভবত সেই এয়ারক্রাফটের কথাই বলতে চাইলেন মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য।

এখানে বলে রাখা ভালো, ইউএপি বা ইউএফও নিয়ে রায়ান গ্রেভসের ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স রয়েছে। যেমন রয়েছে টিকট্যাকখ্যাত ডেভিড ফ্রেভারের।

গ্রেভসের উত্তর, 'বিহেভিয়র' দেখে। অর্থাৎ কোনও একটা মেশিন কীভাবে আচরণ করছে তা দেখে। সেই মেশিন বা উড়ন্তযান শূন্য দশমিক শূন্য গতিতে নির্ভার অবস্থায় স্থির থাকতে পারছে, পরক্ষণেই সুপারসনিক গতিতে জায়গা এবং দিকবদল করে উড়ে যেতে পারছে, ডেভিড ফ্রেভারের দাবি করা টিকট্যাকের ফুটেজে তা দেখা যাচ্ছে এবং শোনাও যাচ্ছে।

৮০ হাজার ফিট থেকে ২০ হাজার ফিট দ্রুত নেমে আসা খুব সহজ কাজ না যে কোনও মেশিনের পক্ষে। শুধু তাই নয় সেই মেশিন এক জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেসে থাকতে পারছে। পরক্ষণেই মুহূর্তে ফিরে যাচ্ছে ৮০ হাজার ফিটের পুরোনো অবস্থানে। ডেভিড গ্রাশ, রায়ান গ্রেভস, ডেভিড ফ্রেভারেরা তিন জনই এক সুরে দাবি করেছেন, UAP বা UFO নাম যাই হোক, উড়ন্ত আকাশযানের প্রযুক্তি আজকের বৈজ্ঞানিক যুক্তিচিন্তার বাইরে। আর এখানেই এসেছে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তত্ত্ব।

জুন ১৯৫৫। ইউএফও রিপোর্ট। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান। সূত্র: দ্য হাইনেক ইউএফও রিপোর্ট

"জোর গলায় এই আশ্বাস আপনাদের দিতে পারি, কেউ যখন এত কাছ থেকে এ ধরনের অপার্থিব বস্তুকে দেখতে পায় এবং তাও প্রায় মিনিট খানেক ধরে, তখন প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতির মধ্যে সেই দৃশ্যটি গেঁথে যায়। মেমোরিতে চিরস্থায়ী হয়ে যায়।"

এ কথা ঠিক যে, খুব কাছ থেকে অজানা উড়ন্ত যানকে দেখার মুহূর্তটি শিহরণ ধরানো অভিজ্ঞতার। একইসঙ্গে না ভুলতে পারা এক অনন্য ঘটনাও বটে। কিন্তু কয়েক মিনিট পর দৃষ্টি থেকে বস্তুটি উধাও হয়ে গেলে তারপর আর কোনও প্রমাণ থাকে না। বিজ্ঞান নথি দাবি করে। তথ্যপ্রমাণ খুঁটিয়ে দেখতে চায়। রায়ান গ্রেভসরা দাবি করছেন তাঁদের কাছে তথ্যপ্রমাণ আছে।

ডেভিড গ্রাশের কাছে প্রশ্ন ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি কোনও UAP বা UFO নিজেদের হেফাজতে রেখেছে?

গ্রাশের উত্তর: অ্যাবসোলিউটলি। অর্থাৎ আলবাৎ রেখেছে। প্রায় ৪০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে, চার বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করে ডেভিড গ্রাশ মনে করছেন আমেরিকা অজানা আকাশযানকে নিজেদের কাছে লুকিয়ে রেখেছে বাকি বিশ্বকে অন্ধকারে রেখে।

গ্রাশের কাছে পাল্টা প্রশ্ন, কোথায় লুকিয়ে রেখেছে জানেন?

উত্তর: I know the exact location. আমি একেবারে নিশ্চিত লোকেশন জানি। হুইশলব্লোয়ার হিসেবে ডেভিড গ্রাশ সেই তথ্য শেয়ার করেছেন ইনসপেক্টর জেনারেলকে। একইসঙ্গে ইনটেলিজেন্স কমিটিকেও জানিয়েছেন।

বিস্ফোরক দাবি! গ্রাশের দাবির সামান্যতম অংশও যদি সত্যি হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে অজানা উড়ন্ত বস্তুর ক্রাশ-ল্যান্ডিং হয় পৃথিবীতে। অথবা কোনও এনকাউন্টারে ভেঙে পড়ে। আর সেই যান চালকবিহীন না হলে, তাতে প্রাণ থাকতে হবে। সেই প্রাণী কারা? মানুষ না অন্য অপার্থিব শরীরের? বঙ্কুবাবুর বন্ধু অ্যাংয়ের মতো কেউ?

তা হলে কি ধরে নিতে হবে মানুষের সঙ্গে এলিয়নদের এনকাউন্টার হয়েছে? তারপর সেই আকাশযানকে হেফাজতে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? ধোঁয়াশা আর রহস্য রয়েছে এখানেও। কেননা ডেভিড গ্রাশের উত্তরে জট আরও শক্ত হয়েছে। ডেভিড গ্রাশের দাবি, তাঁর সহযোগীদের মধ্যে অনেকেই আহত হয়েছেন। প্রশ্ন ছিল, কারা আক্রমণ করল? UAP নাকি ফেডারেল সরকার? গ্রাশের উত্তর Both, দু'জনেই। এখানেই রহস্য আরও জোরালো হয়। গ্রাশ বলেছেন, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী দু'জনের ব্যক্তিগতভাবে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা অত্যন্ত ডিসটার্বিং, খারাপ। কী সেই অভিজ্ঞতা? তা অবশ্য শেয়ার করেননি এয়ারফোর্সের প্রাক্তন গোয়েন্দা অফিসার।

সংবাদমাধ্যমের একটি সূত্র দাবি করে, মার্কিন হাউজের এই UAP Hearing বা শুনানি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নাকি আটকাতে চেষ্টা করে সরকার। শুনানি থেকে বেরিয়ে এসেছে তথ্য, কংগ্রেসের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যেও এমন অনেকেই আছেন যাঁরা UAP নিয়ে অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ। কিন্তু তাঁদের মুখে কুলুপ।

প্রশ্ন: মার্কিন সরকার কি UAP-এর বুদ্ধিমান মাথাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে?

ডেভিড গ্রাশ: সবার সামনে আমি এই প্রশ্নের উত্তর দেব না।

প্রশ্ন: আপনি বলছেন ভেঙে পড়া যান থেকে বায়োলজিকস (জৈবিক পদার্থ) পাওয়া যায়?

ডেভিড গ্রাশ: হ্যাঁ।

প্রশ্ন: হিউম্যান বায়োলজিকস নাকি নন হিউম্যান? মানুষের জৈবিক অংশ নাকি মানুষ নয় এমন কিছুর?

ডেভিড গ্রাশ: নন হিউম্যান বায়োলজিকস। মানুষের নয় এমন কিছুর জৈবিক অংশ।

প্রশ্ন: এর কোনও নথি, কোনও ভিডিও, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান, এরকম কিছু আছে?

গ্রাশের উত্তর: যেখানে যা যা নথি পাওয়া গিয়েছে তা জমা করা আছে। তবে এ কথাও স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি নিজের চোখে কোনও কোট আনকোট 'দেহ' দেখেননি।

লেখার শুরুতেই এই প্রশ্ন রেখেছিলাম যে কী এমন ঘটল, মার্কিন হাউজে কংগ্রেস প্রতিনিধিদের বসিয়ে, তাঁদের সামনে শপথ নিলেন হুইশলব্লোয়ারা। বোমা ফাটালেন। তাও আবার এমন একটি বিষয়টি নিয়ে, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের হয়তো কৌতূহল রয়েছে। কিন্তু তা কখনও মার্কিন ভোটবাক্সে নির্ণায়ক ভূমিকা নেবে, এমন কল্পনা বোধ করি বাড়াবাড়ি। তাহলে? তাহলে নিশ্চিত পেন্টাগন এবং হোয়াইট হাউজের অন্দরে এমন কিছু ফাইল নড়াচড়া হয়েছে যা নিয়ে লবি এবং বিপক্ষ লবি তৎপর হয়ে উঠেছে। খানিকটা হলেও জনমতের চাপে, UAP শুনানি জনসমক্ষে এসেছে। এবার হচ্ছে তদন্তের প্রশ্ন, তাকে ডিক্লাসিফায়েড করার প্রশ্ন।

যে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি:

১। UAP কি আমেরিকার ভিতরেই কোনও উন্নত সামরিক প্রকল্প, যা অত্যন্ত গোপনীয় এবং ক্লাসিফায়েড?

২। ভিন গ্রহের কোনও যান পৃথিবীতে আছড়ে পড়লে বা এনকাউন্টারে মাটিতে নামানো হলে কেন তাকে গোপন রাখা হবে?

৩। আমেরিকার কোন লোকেশনে যানটিকে অবিকল বা প্রায় অবিকল অবস্থায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে?

৪। নন হিউম্যান বায়োলজিকস বলতে ডেভিড গ্রাশেরা ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন?

৫। টিকট্যাকের পর কীভাবে এয়ারফোর্সের মতো অত্যাধুনিক রেডারের বাইরে চলে যেতে পারে কোনও আকাশযান?

মানুষ কি তা হলে একা? মহাশূন্যের অগণন অনন্ত ছড়িয়ে পড়া গ্যালাক্সিগুলির মধ্যে কোথাও কি মানুষের মতো কোনও রক্তমাংসের প্রাণ নেই? মহাকাশ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, আমাদের ছায়াপথের একটি নির্দিষ্ট অংশে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে জায়গাটি ৬ হাজার ৫০০ আলোকবর্ষ থেকে ১৯ হাজার ৫০০ আলোকবর্ষ দূরত্বের মাঝামাঝি। সেখানেই কি ক্রেনিয়াস গ্রহ? বঙ্কুবাবুর বন্ধুর বাড়ি? ইটির হোম?

 

More Articles