তিন ঘোষই টার্গেট, 'মস্তি করবে জানি' আসলে ভুয়ো নিরপেক্ষ?
Fake Neutrality: ভুয়ো নিরপেক্ষতা এক ধরনের পণ্য, যা সস্তা চমক ও প্রচারের আলো কুড়িয়ে নেয়, কিন্তু সমাজের জন্য কোনো গঠনমূলক বার্তা দেয় না।
রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই একটি শব্দ আজকাল বারবার উঠে আসে– "নিরপেক্ষতা"। এই প্রসঙ্গে শব্দটির অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই বিকৃত হয়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য এক গভীর বিপদ ডেকে আনছে। আসল নিরপেক্ষতা মানে হলো তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং নৈতিকতার মাপকাঠিতে সবার সমান বিচার করা। এর বিপরীত হলো ভুয়ো নিরপেক্ষতা, যেখানে ক্ষুদ্র ত্রুটিকে গুরুতর অন্যায়ের সঙ্গে এক পাল্লায় মাপা হয়। ফলে, যিনি সামান্য ভুল করেছেন, তার দোষকে ভয়ংকর অপরাধীর পাপের সমান করে দেওয়া হয়। এর ফল হয় ভয়াবহ। সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়, অপরাধী আরও শক্তিশালী হয়, এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়।
এই ভুয়ো নিরপেক্ষতা অবশ্য নতুন কোনো কৌশল নয়, এর দৃষ্টান্ত সারা পৃথিবীতেই দেখা যায়। তবে এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ দেখতে পেলাম আমাদের বাংলাতেই। একটি নতুন গানে রাজনৈতিক অঙ্গনের তিন ব্যক্তিত্বকে একই সারিতে দাঁড় করানো হয়েছে। তিনজনের পথচলা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন দুর্নীতির দায়ে জেলে গেছেন, আরেকজন কদর্য ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় মহিলা ও সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করেছেন, আর তৃতীয়জনের 'দোষ' তিনি ভোটে হেরে গেছেন। অবাক হওয়ার বিষয় হলো, এই সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের তিনজনকে এক পাল্লায় ফেলে দেওয়া হলো, আর দর্শকরা হাততালি আর উল্লাসে ফেটে পড়লেন। এই ঘটনা শুধু একটি গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমাদের সমাজের এক অদ্ভুত মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। ভুয়ো নিরপেক্ষতা এক ধরনের পণ্য, যা সস্তা চমক ও প্রচারের আলো কুড়িয়ে নেয়, কিন্তু সমাজের জন্য কোনো গঠনমূলক বার্তা দেয় না।
আরও পড়ুন- বহুত্ববাদী ভারতবর্ষই গণতন্ত্রের মৃত্যু রুখবে?
এই বাজারদর বাড়ানো ভুয়ো নিরপেক্ষতা সমাজকে কোনও প্রকৃত বার্তা দিতে পারে না, যদিও সস্তা চমক আর প্রচারের আলো কুড়োনো এতে সম্ভব হয়। তবে এ ধরনের বার্তা সমাজে এক সুচতুর বিভ্রান্তি তৈরি করে। যখন একজন নেতা বা শিল্পী অশ্লীল ও ঘৃণামূলক বক্তব্য দেন, আর তার সঙ্গে আপেক্ষিকভাবে সংযত একজন মানুষের সামান্য ভুলকে একই সমতলে আনা হয়, তখন আসল অন্যায়টি ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এই 'মাছি মারা নিরপেক্ষতা'র ফলে রাজনৈতিক মূল্যায়ন হয়ে পড়ে বিকৃত ও অস্পষ্ট। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না, আসলে দোষী কে। তারা মনে করে, সব নেতাই একই রকম। এর পেছনে কাজ করে সুশীলদের টাকার টান, খ্যাতির টান এবং নিজের বাজার তৈরির চেষ্টা। কিন্তু এই বাজার তৈরি করতে গিয়ে অজান্তেই বা জেনেশুনেই যে তারা গণতন্ত্রের ভিত্তি নষ্ট করছে, তা চিহ্নিত করা খুব জরুরি।
এই রোগ শুধু আমাদের দেশেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্বজুড়ে এর দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। ব্রেক্সিটের সময় ব্রিটেনের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলি ঠিক এই কৌশলই অবলম্বন করেছিল। সিরিয়াস অর্থনীতিবিদ আর মিথ্যাচারী বরিস জনসন বা নাইজেল ফারাজ-এর ব্রেক্সিট নিয়ে বক্তব্যকে সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছিল। শেষোক্ত দুজনের বক্তব্যের কোনো গভীরতা ছিল না এবং তাদের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক চরিত্রের কোনো সততাও ছিল না। কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করেছিল যেন দুই পক্ষেরই সমান যৌক্তিকতা আছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিলেন– তারা বুঝতে পারেননি যে একদিকের বক্তব্য কেবল মিথ্যা আর বিভাজনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ভুয়ো নিরপেক্ষতার কারণেই ব্রেক্সিট বাস্তবায়িত হয়েছিল, যার খেসারত ব্রিটিশ অর্থনীতি ও সমাজ এখনো দিয়ে চলেছে।
আরও পড়ুন- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বুঝতেন অটল বিহারী, বাজপেয়ীর বিজেপির থেকে কোথায় আলাদা মোদির বিজেপি?
একই কৌশল আমরা দেখেছি ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানেও। আমেরিকার টেলিভিশন টক শো এবং পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় ট্রাম্পের অগণতান্ত্রিক ও অসভ্য আচরণকে প্রায়শই তুলনা করা হয়েছে ডেমোক্র্যাটদের ছোটখাটো ভুলের সঙ্গে। যখন একজন নেতা বর্ণবাদী, লিঙ্গবৈষম্যমূলক মন্তব্য করেন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করেন, আর আরেকজন কেবল ইমেল প্রোটোকল বজায় রাখতে হিমশিম খান, তখন এই দুটিকে এক পাল্লায় মাপা চলে না। কিন্তু ভুয়ো নিরপেক্ষতার কারণে মার্কিনদেশে এটাই ঘটেছে। ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন, আর এর ফল সারা পৃথিবী এখনও ভোগ করছে।
বাংলায় ফিরে আসা যাক আবার। জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, “The greatest enemy of clear language is insincerity।” আর বাংলার রাজনৈতিক ভাষার সবচেয়ে বড় শত্রু আজ এই অসৎ নিরপেক্ষতা। ভুয়ো নিরপেক্ষতার মূল কারবারি কারা? দক্ষিণপন্থী দলগুলির তাঁবেদার মিডিয়া তো বটেই, একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, অতিবাম রাজনীতি ও তথাকথিত সুশীল সমাজের একাংশও এই খেলায় সমানভাবে অংশ নেয়। এর পেছনে দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা নিজেদের মধ্য-বামের চেয়ে বেশি নৈতিক, বেশি 'বিশুদ্ধ' প্রমাণ করতে চায়। তাই মধ্য-বামরাও যে অন্যান্য দলগুলির মতো 'পঙ্কে নিমজ্জিত', সেটা প্রমাণ করতে পারলে তারা নিজেদের 'holier than thou' (অন্যের চেয়ে বেশি ধার্মিক) প্রমাণ করতে পারে। দ্বিতীয় কারণটি আরও গভীর। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের এই ভুয়ো নিরপেক্ষতার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো শাসকদলকে পরোক্ষভাবে সুবিধা দেওয়া। তারা শাসকদলের ছোটখাটো সমালোচনা করলেও (কারণ বড় মাথাদের ছোঁয়ার সাহস তাদের নেই), প্রকৃত বিরোধীদের সঙ্গে শাসককে এক পাল্লায় ফেলে দিলে শেষ পর্যন্ত শাসকই লাভবান হয়। এতে অনুদান, পদ বা প্রভাব নামের ক্ষমতার মধু ঝরতে ঝরতে শেষ পর্যন্ত সে'সব সুশীলদের কাছে পৌঁছেও যায়।
তাই আজকের বাংলার রাজনৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হলো অতি-বাম ও সুশীল সমাজের এই ভুয়ো নিরপেক্ষতা। যারা গান লেখেন, নাটক বানান বা টিভির টক শো-তে বক্তৃতা দেন, তাদের বক্তব্য যদি সত্যিই গণতন্ত্রের পক্ষে হতো, তবে তারা প্রকৃত অপরাধীকে অপরাধী বলতেন এবং অসভ্য অন্যায়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতেন। কিন্তু বাঙালির দুর্ভাগ্য যে তারা তা করেন না। ওনারা বরং সব দোষকে এক পাত্রে তুলে দেন, যাতে আসল দোষী আড়ালে থাকে। এই চমকপ্রদ ভুয়ো নিরপেক্ষতার সুদূরপ্রসারী ফল কিন্তু ভয়াবহ! এর ফলে সাধারণ ভোটারদের মনে গণতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। তারা ভাবতে শুরু করে, 'সব দল, সব নেতাই এক'। সমাজে এক ধরনের রাজনৈতিক উদাসীনতা তৈরি হয়। এর ফলে একদিকে যেমন শাসক দলের দাপট আরও শক্তপোক্ত হয়, অন্যদিকে প্রকৃত বিরোধীরা ক্রমশ দুর্বল হতে হতে বিলীন হয়ে যায়। অথচ ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে যে জনতার রাজনীতিতে বিতৃষ্ণা হলে, প্রকৃত বিরোধী পক্ষ না থাকলে গণতন্ত্রে ভাঙন আসে। কিন্তু গণতন্ত্রের ভাঙন মানে স্বৈরতন্ত্রের উত্থান, আর স্বৈরতন্ত্র মানেই সমাজের মৃত্যু।
আরও পড়ুন- ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দে অ্যালার্জি! কাদের, কেন?
ইউরোপের ইতিহাসে নাৎসি জার্মানি বা ফ্যাসিবাদী ইতালির উত্থান থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই। সেখানে ভুয়ো নিরপেক্ষতার কারণে মানুষ প্রথমে ভেবেছিল, সব দলই খারাপ– হিটলার বা মুসোলিনি নতুন কিছু নন। এর ফলে ভুয়ো নিরপেক্ষতা এক ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী সমাজের জন্ম দিয়েছিল। জার্মানির স্কুলে আজও সেই পাঠ পড়ানো হয়। আজ বাংলার এবং সমগ্র ভারতের প্রেক্ষাপটে এই শিক্ষা আমাদেরও নতুন করে মনে রাখা জরুরি।
গণতন্ত্রকে বাঁচানোর প্রথম শর্ত হলো সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। একজনের সামান্য ভুলকে আরেকজনের গুরুতর অপরাধের সমান করে দেখানো মানে গণতন্ত্রকে ভাঁওতা দেওয়া। খোলা সমাজে অবশ্যই সমালোচনা প্রয়োজন, কিন্তু সেই সমালোচনা হতে হবে পরিমিত, ন্যায্য এবং তথ্যভিত্তিক– মুড়ি মুড়কি এক দর করার মতন নয়। গান, কবিতা বা নাটক যদি কেবল বাজারে বিক্রির জন্য তৈরি হয়, তবে প্রাথমিকভাবে তার চটুলতা মন কাড়লেও সেটা অবশেষে মানুষের উপলব্ধিতে মরচে পড়ার উপকরণ যোগায়। তাই ভুয়ো নিরপেক্ষতার চশমা পরে থাকলে যেমন সমাজ আর গণতন্ত্র দুইই বিপন্ন হয়, তেমনই পরবর্তীকালে সেই বাজারও আর অবশিষ্ট থাকেনা। তাই, বাংলার শিল্পী, সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীরা– যারা সমাজকে পথ দেখাতে চান, দয়া করে এই চমকপ্রদ ভুয়ো নিরপেক্ষতার মোহ ত্যাগ করুন। অন্যথায়, আজকের নড়বড়ে বাংলার সমাজ এবং গণতন্ত্র আরও রসাতলে যাবে।
লেখক ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক। লেখকের মতামত ব্যক্তিগত।

Whatsapp
