আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে সতর্ক! বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী বলছেন অমর্ত্য সেন?

Amartya Sen on Bangladesh: আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করার উপরেই জোর দিচ্ছেন অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেনের যুক্তি, একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর জায়গায় নেই বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের ভার এখন একজন অর্থনীতিবিদের হাতেই। হাসিনা পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের জন্মের প্রায় সাত মাস হতে চলল। তবু অস্থিরতা কাটেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই স্বীকারও করেছেন, পুলিশ প্রশাসন এখনও সক্রিয় নয়। সারা বাংলাদেশ জুড়েই তাই হিংসার নানা নজির ঘটমান। এমন নড়বড়ে রাষ্ট্রে ইসলামিক মৌলবাদের উত্থান নিয়েও আশঙ্কিত অনেকেই। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন আরেক বিশ্ববিখ্যাত, নোবেলজয়ী। অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের বন্ধু মুহাম্মদ ইউনূস। অমর্ত্য কী চোখে দেখছেন ইউনূসের বাংলাদেশকে? অমর্ত্য সেন বলছেন, তাঁর বন্ধু অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ করছেন ঠিকই কিন্তু অচলাবস্থা কাটাতে তাঁকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

সদ্য শান্তিনিকেতনে পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন বলেন, "বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমার উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। কারণ, আমি খুব তীব্রভাবে বাঙালি পরিচয় সত্তাকে ধারণ করি। আমি ঢাকায় অনেক সময় কাটিয়েছি এবং সেখানেই আমার স্কুলের শিক্ষা শুরু। ঢাকার পাশাপাশি মানিকগঞ্জে আমার পৈতৃক বাড়িতে প্রায়ই গিয়েছি। মায়ের দিক থেকে আমি নিয়মিত বিক্রমপুরে, বিশেষ করে সোনারাংয়ে গিয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এসব জায়গার খুব গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ তার বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা নিয়ে অন্য অনেকের মতোই আমি উদ্বিগ্ন।"

আরও পড়ুন-ভারত-পাকিস্তান উভয়ের অধীনতাই অস্বীকার করে নতুন বাংলাদেশ : মাহফুজ আলম

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অগ্রগতি, বাংলাদেশের মানুষের জীবনের উন্নতিকে কীভাবে দেখছেন অমর্ত্য সেন? বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জন্মহার কমে যাওয়া এবং গড় আয়ু বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে অমর্ত্য সেন বলেছেন, বাংলাদেশ বিগত কয়েক দশকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মহিলাদের উন্নয়নের বিষয়টিকে সামনে রাখতে চেয়েছেন তিনি। বলেছেন, মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার দিয়েছে। আআর এখানেই এখানে সরকারি এবং ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বেসরকারি সংস্থা—দুইয়েরই ভূমিকা রয়েছে।

এমনকী বাংলাদেশে সংবাদপত্র ‘তুলনামূলক স্বাধীন’ বলে মনে করেন অমর্ত্য সেন। সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়েও যে বাংলাদেশে অনেক সংবাদপত্রই নিরাপদে কাজ করে যেতে পেরেছে সেই উল্লেখ করেছেন অমর্ত্য সেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীরও প্রশংসা করেছেন অমর্ত্য। সেনাশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করার বিষয়টিকে শুভ ইঙ্গিত বলেই মনে করেছেনে এই নোবেলজয়ী। তবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করার উপরেই জোর দিচ্ছেন অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেনের যুক্তি, একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর জায়গায় নেই বাংলাদেশ। এই মুহূর্তে হাসিনা বিরোধীরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছে, লোগকে নিষিদ্ধ করলে সেই একই দোষে দুষ্ট হবে তারাও।

অমর্ত্য সেন বলছেন, "আমি মনে করি, কোনও একটি গোষ্ঠীকে এক পাশে ঠেলে না দিয়ে বাংলাদেশের উচিত, সবাই একসঙ্গে কাজ করার যে ঐতিহ্য এই দেশের রয়েছে, সেটার সর্বোত্তম ব্যবহার করা। একটি উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। আমি আশা করি যে স্বাধীনতা ও বহুত্ববাদের প্রতি বাঙালি সম্প্রদায়ের যে অঙ্গীকার রয়েছে, সেটা টিকে থাকবে। আমি আশা করি, বাংলাদেশে আগে নির্বাচন যেমন হতো বলে অনেকে দাবি করেন, তার চেয়ে আগামীর নির্বাচন দৃশ্যত বেশি অবাধ হবে। আমি বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন, তবে আমি আশাহীন নই।"

আরও পড়ুন-ভাষা আর ধর্মের জাল থেকে কোনওদিন মুক্ত হতে পারবে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কি নতুন বাংলাদেশকে নতুন দিশা দেখাতে পারবেন? অমর্ত্য সেন বলছেন, "ইউনূস একজন পুরনো বন্ধু। আমি জানি, তিনি খুবই সামর্থ্যবান ব্যক্তি এবং অনেক দিক দিয়ে একজন উল্লেখযোগ্য মানুষ। তিনি বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক অঙ্গীকার নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। এবার আপনি যদি হঠাৎ করে একটি দেশের প্রধান হন, যেমনটি ইউনূসের ক্ষেত্রে ঘটেছে, তাহলে আপনাকে অবশ্যই বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিষয় বিবেচনা করতে হবে। সেখানে বিভিন্ন ইসলাপন্থী দল রয়েছে, এখন হিন্দুদেরও বিভিন্ন পক্ষ রয়েছে। ইউনূসের সামর্থ্যের ওপর আমার গভীর আস্থা রয়েছে।"

পাশাপাশি এই সরকারের সমালচনাও করেছেন অমর্ত্য। বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর হামলা এবং মন্দিরগুলিতে ভাঙচুরের নিন্দা করে অমর্ত্য সেন জানিয়েছেন, এসব হিংসা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব ছিল সরকার ও জনগণের। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রতিরোধ করা জরুরি। “এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণে গর্ব প্রকাশ করেছে এবং জামায়াতের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আটকে রাখার প্রচেষ্টা করে এসেছে। দুর্ভাগ্যবশত, ভারতেও মসজিদে হামলা হয়েছে। এসব ঘটনা বাংলাদেশ হোক বা ভারত, বন্ধ করতে হবে,” বলছেন অমর্ত্য।

“নির্বাচিতভাবে নির্দিষ্ট কিছু ঘটনাকে সামনে এনে সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন দেওয়ার চেয়ে সহজ আর কিছু নেই। এভাবেই ১৯৪০-এর দশকের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেধেছিল, যার ফলে রক্তপাত ঘটে। আমাদের অতীতকে মাথায় রাখতে হবে এবং সেই আলোকেই আমাদের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করতে হবে। নির্বাচনী প্রচার অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে,” সতর্ক করেছেন অমর্ত্য সেন।

More Articles