ধ্বংস হচ্ছে পৃথিবীর ফুসফুস, সংশয়ে হাজার হাজার আদিবাসীর জীবন! নেপথ্যে কারা?
আমাজনের অরণ্য আজ ক্রমশ ধ্বংসের মুখে।
ব্রাজিল-সহ বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনেজু়য়েলা, গিনি এবং সুরিনামজুড়ে বিস্তৃত আমাজনের বৃষ্টি অরণ্য। ১.৪ বিলিয়ন একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত গভীর ও ঘন জঙ্গল, যেখানে এক সময়ে সহজে সূর্যের আলো পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারত না, তা আজ ক্রমশ ধ্বংসের মুখে। কেবল আঞ্চলিক আবহাওয়াই নয়, সারা পৃথিবীর জলবায়ু স্বাভাবিক রাখার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমাজনের বৃষ্টি অরণ্য। বর্তমানে চল্লিশ মিলিয়ন মানুষের আশ্রয় ও বাসস্থান আমাজ়নের বৃষ্টি অরণ্য।
সেই জঙ্গলকে সংরক্ষণের উদ্দ্যেশ্যে প্রতি বছর ন্যাশনাল আর্টিকুলেশন অফ দ্য ইন্ডিজিনাস পিপল অফ ব্রাজি়ল এবং এক্সটিংশন রেবেলিয়ন-এর তরফে প্রতি বছর ৫ সেপ্টেম্বর পালিত হয় গ্লোবাল ডে অফ অ্যাকশন ফর দ্য আমাজ়ন। আমাজ়নের জঙ্গল, জঙ্গলের জীব এবং জঙ্গলকে আশ্রয় করে তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে বেঁচে থাকা আদিবাসী মানুষদের সুরক্ষার উদ্দ্যেশ্যে পালিত হয় এই দিন।
কিন্তু আমরা প্রায় প্রত্যেকেই বিগত কয়েক বছরে ঘন ঘন আমাজ়নের জঙ্গলে দাবানলের কথা জেনেছি। ঠিক কারা দায়ী এই গুরুতর সমস্যার জন্য?
আরও পড়ুন: দুনিয়ার এক ফুসফুসের ২২% খতম ! ৯টি দেশের সীমান্তে চরম আমাজন কূটনীতি
আমাজ়নের জঙ্গলে দাবানল
ঠিক চারদিন আগে, অর্থাৎ ১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড মেটরিওলজিক্যাল অর্গ্যানাইজে়শনের একটি ফেসবুক পোস্ট নজর কাড়ে। ব্রাজিলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছেয়ে যাচ্ছে ভয়াবহ দাবানলে। তাপমাত্রার মানচিত্রে বাদামি হয়ে রয়েছে সেই অঞ্চল। চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ধোঁয়ার সেই ছবি ধরা পড়েছে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির স্যাটেলাইট কোপারনিকাস সেন্টিনেল-ফাইভ পি-তে।
সেই ধোঁয়া কেবল দক্ষিণ আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা ছড়িয়ে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকেও।চলতি বছরের জুন মাসে আমাজ়নের দাবানলের রূপ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। গত পনেরো বছরেও এত ভয়ংকর রূপ ধারণ করেনি আমাজ়নের দাবানল।
কেবল ২০২০ সালেই আমাজ়নের জঙ্গলে এক লক্ষ তিন হাজার বার দাবানলের ঘটনা দেখা দিয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে পঁচাত্তর হাজারটি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে কেবল আমাজ়নের জঙ্গলে। ২০১৮ সালে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় জেয়ার্ড বলসোনারো। বলসোনারর আমলে কেবল ২০২০ সালে একান্ন শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে আমাজ়নের দাবানলের ঘটনা।
ব্রাজিলের সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২০২০ সালের অগাস্ট মাস থেকে ২০২১ সালের জুলাই মাস অবধি ১৩,২৩৫ বর্গ কিলোমিটার অরণ্য ধ্বংস হয়েছে। বিবিসি সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০০৬ সালের পরে ২০২১ সালেই প্রথম আমাজ়নের অরণ্য-নিধনের ঘটনা বাইশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে আমাজ়নের দাবানল কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনুষ্য-সৃষ্ট। ব্রাজিলের দরিদ্র চাষিরা চাষের জন্য প্রায়ই অরণ্য ধ্বংস করতে বাধ্য হন। সেই আগুন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাগালের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে, ভয়াবহ দাবানলের আকার ধারণ করে। জুন মাসে যখন আমাজ়নের আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত শুষ্ক, তখন আরও সহজে ছড়িয়ে পড়ে সেই আগুন। যদিও রেনফরেস্ট হিসেবে আমাজ়নের জঙ্গলের সারা বছর আর্দ্র থাকার কথা, কিন্তু ক্রমাগত বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে তাপমাত্রা বাড়ছে। অরণ্য ধ্বংসর ফলে বৃষ্টি কমছে আমাজ়নের রেনফরেস্টে। এই অবস্থায় তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, কমছে বাতাসের আর্দ্রতা । আর সেই পরিস্থিতি-ই ঘন ঘন দাবানল তৈরির উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলছে।
আমাজ়নের জঙ্গল, সরকার এবং পুঁজিপতিরা
পুঁজিবাদ অর্থ ছাড়া কথা বলে না। পুঁজিপতিরা আমাজ়নের বনসম্পদ ধ্বংস করে কেবল শিল্পপ্রতিষ্ঠাই করেননি, বিভিন্ন বিরল গাছ এবং বনসম্পদও কালোবাজারে দেদার বিক্রি করে চলেছেন। আমরা প্রায় সকলেই জানি, জে পি মর্গ্যান চেজ় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির নেপথ্যে কত বড় ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, আবিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের নেপথ্যেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে এই সংস্থার বিরুদ্ধে।
রেনফরেস্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সূত্রে জানা যাচ্ছে, কেবল আমাজ়নের জঙ্গলই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার বিস্তৃত অরণ্য এবং জমি ধ্বংসে অন্যান্য বড় বড় সংস্থাকে টেক্কা দিয়েছে জেপিমর্গ্যান। ব্রাজিলের কাগজ তৈরির সংস্থা সুজা়নো, ব্রাজি়লের বৃহত্তম মাংস-প্যাকেজিং সংস্থা মিনার্ভা এবং মার্ফিগ সহ বেশ কিছু বড় সংস্থাকে ঋণ দিয়ে ব্যবসা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে জেপিমর্গ্যান। জে পি মর্গ্যান চেজ় ছাড়াও ব্ল্যাক রক, বিএনপি, এইচএসবিসি-র মতো সংস্থা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, পুঁজিপতি আর দেশের সরকারের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। ভারতে নরেন্দ্র মোদি থেকে ব্রাজি়লের প্রেসিডেন্ট জেয়ার্ড বলসোনারো তার অন্যতম উদাহরণ। এ-দেশে নরেন্দ্র মোদির সরকার আদিবাসী ভারতীয়কে পদ্মভূষণ পুরষ্কারে সম্মানিত করার দুদিন পরেই, পরিবেশ-সংরক্ষক অদিবাসীর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেন উন্নয়নের নামে। অন্যদিকে ব্রাজি়লের প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর পরিবেশ-বিরোধী নীতি আমাজ়নের হাজার হাজার আদিবাসীর জীবন সংশয়ে ফেলে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংশয়ে ফেলে। বলসোনারোর সরকারের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের প্রাণনাশের অভিযোগও অভিযোগ নয়।
বলসোনারো আমাজ়ন-অঞ্চলে বসবাসকারী চাষিদের বাধ্য করেছেন আমাজ়নের বনসম্পদ ধ্বংস করতে, যাতে সেখানে গো-মাংস এবং সোয়াবিনের উৎপাদন বাড়তে পারে। চাষের জমির অভাবে ব্রাজি়লের চাষিরা বাধ্য হচ্ছেন বনে আগুন লাগাতে।
২০১৯ ও ২০২০ সালেও ব্রাজি়ল সারা বিশ্বে গো-মাংস রপ্তানিকারী দেশগুলির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। ২০২১ সালে সেই স্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখল করলেও, সংখ্যাতত্ত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২২ সালে এই স্থান ব্রাজি়ল আবারও দখল করতে পারে।
ব্রাজি়লের গো-মাংস রফতানির নেপথ্যে কিন্তু আমাজ়নের অরণ্য ধ্বংস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রেনফরেস্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সূত্রে জানা যাচ্ছে, সুজা়নো নামের এই কাগজ-নির্মাণ সংস্থার তিনটি কাগজের মিল রয়েছে। মূলত ইউক্যালিপটাস থেকে কাগজ নির্মাণ করে এই সংস্থা। আর সেই ইউক্যালিপটাস গাছ চাষের জন্যে প্রতিটি মিলের দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার একর জমির প্রয়োজন হয়। ইউক্যালিপটাস মোটেই আমাজ়নের জঙ্গলে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা গাছ নয়। আমাজ়নের প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে ওঠা লক্ষ লক্ষ একর বন ধ্বংস করেই, চাষ করা হয় ইউক্যালিপটাস।
এছাড়াও আমাজ়নের জঙ্গলে কার্গিল-সয়, মারফ্রিগ-বিফ, জেবিএস-বিফ, ওয়ালমার্ট, স্টপ অ্যান্ড শপ, কস্টকোর মতো ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুঠছেন। বনসম্পদ ধ্বংসের মতো গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেও। এর পাশাপাশি খনিজ সম্পদ আহরণের জন্যও ব্যবসায়ীরা প্রায়শই অত্যাচার করেন আমাজ়নের জঙ্গলের আদিবাসীদের ওপর।
যে কোনও সম্পদের জন্যই আমাদের পরিবেশের ওপর নির্ভর করতে হয়, কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণ করেও যে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করা যায়, তা ব্যবহার করা যায়, জানাচ্ছেন আর্টিক্যুলেশন অফ ইন্ডিজেনাস পিপল অফ ব্রাজি়লের কার্যনির্বাহী সমন্বয়কারী সোনিয়া গুয়াহাহারা (সূত্র: WIRED)।