তিমি মাছের শরীরে লুকোনো দুর্মূল্য সোনা! কীভাবে মানুষের লোভের শিকার হচ্ছে এই প্রাণী?

তিমি মাছের বমি যে গায়ে মাখছেন, তার কি কোনও খেয়াল আছে? আজ্ঞে হ্যাঁ, তিমি মাছের বমি সুগন্ধি তৈরিতেও কাজে লাগে। অনেকে আবার খাবার এবং পানীয়তে মিশিয়েও ব্যবহার করেন।

ঘটনা ১

মানুষের জীবনে কতই না অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ঠিক যেমন হয়েছে থাইল্যান্ডের এক জেলে নারংয়ের ক্ষেত্রে। একদিনেও যে কোটিপতি হওয়া যায়, তা তিনি করে দেখালেন। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, তিমি মাছের বমি, যাকে ‘সমুদ্রের সোনা’ বলা হয়। নারং সমুদ্র থেকে ১০ কেজি ওজনের একটি তিমির বমির দলা পেয়েছেন, যার মূল্য ১১ কোটি ডলার। থানি প্রদেশের নিয়োম সৈকতে মাছ ধরে প্রতি মাসে ২১,০০০ টাকা আয় করেন নারং। অন্যান্য দিনের মতো ওই দিনও কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় সৈকতে এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেন তিনি। স্রোতের ধাক্কা খেতে খেতে তা পাড়ে চলে এসেছে। কিন্তু বস্তুটা যে কী, আর এর দাম কতখানি, প্রথমে নারং বুঝতে না পারলেও পরে এক বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলে তিনি একে ‘অ্যাম্বারগ্রিস’ বলে চিহ্নিত করেন।

ঘটনা ২

ভাগ্যের চাকা কার কখন ঘুরে যায়, তা কেউ বলতে পারে না। যেমনটা হয়েছিল মালয়েশিয়ার এক মৎস্যজীবীর সঙ্গে। এই মৎস্যজীবী ভাবতেই পারেননি, সমুদ্রের জলে ভেসে আসা এই আবর্জনা একদিন তার সময়ের চাকা পাল্টে দেবে। জালে আবর্জনা ফেঁসেছে বলে তিনি সেটা তুলে ফেলে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কী মনে হতেই তা আলাদা করে রেখে দেন। পরে মৎস্য দফতরের বিশেষজ্ঞ দল বমিটি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে, এটাই অ্যাম্বারগ্রিস।

উপরোক্ত দু'টি ঘটনাই সত্যি। এই অ্যাম্বারগ্রিসের খবর হয়তো অনেক ঘটেছে কিন্তু কোভিডের খবরের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে। সব প্রাণীর বমি নিকৃষ্ট হলেও পৃথিবীতে এই একটি মাত্র প্রাণীর বমি আপনাকে ভিখিরি থেকে একদিনে কোটিপতি বানিয়ে দিতে পারে। শুনতে অবাক লাগছে তাই না? কোন প্রাণীর বমি, তাও এত মহামূল্যবান? প্রাণীটি তিমি মাছ। আবার যে সে তিমি নয়, বিরল প্রজাতির স্পার্ম তিমি।

আরও পড়ুন: যৌনমিলনের জন্য লাল-নীল হয় কচ্ছপের মাথা! কেমন আছে চম্বলের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীরা?

যেটা ভাবছেন সেটা ভুল ভাবছেন, না, স্পার্ম তিমির সঙ্গে স্পার্মের কোনও সম্পর্ক নেই। স্পার্ম শব্দটি এসেছে স্পার্মাসেটি থেকে। আর এই স্পার্মাসেটি এসেছে গ্রিক শব্দ স্পার্মা থেকে, যার অর্থ বীজ। অর্ধতরল এবং মোমের মতো পদার্থ। একে স্পার্ম অয়েলও বলা হয়। তিমির মাথায় পাওয়া যায়। আরও ভালো করে বললে, তিমি মাছের ওপরের ঠোঁট থেকে মাথা পর্যন্ত যে অংশ সেই স্থানে এই অয়েল উৎপন্ন হয়। তিমি মাছ মরে গেলে বা তাকে মেরে ফেলা হলে বার করে নেওয়া হয় এই তেল। আলো জ্বালানো বা লুব্রিক‍্যান্টের কাজে লাগে।

এই স্পার্ম তিমির যৌনক্ষমতা অন্যান্য তিমি মাছের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি আসে। ৬২ বছর পর্যন্ত বাঁচে এই তিমি। ৭-১৩ বছরের মধ্যেই এই তিমি মাছ যৌনক্ষমতায় সক্ষম হয়ে ওঠে। কিন্তু ব্রেনের ডেভেলপমেন্ট আসে আরও পরে, ২৫-৪৫ বছরে। পুরুষ স্পার্ম তিমি মেয়েদের তুলনায় অনেক বড় হয়। দাঁতেরও নাকি আলাদা মাধুর্য আছে এই জাতির তিমি মাছের। দাঁতালো তিমিদের মধ্যে স্পার্ম তিমি সবথেকে বড়, তাই এর আরেক নাম কেশালো, যার অর্থ বড় দাঁত।

এবার আসা যাক, তিমির বমি বা অ্যাম্বারগ্রিসের কথায়। না, অ্যাম্বারগ্রিসের সাথে গ্রিস দেশের কোনও গলায় গলায় সম্পর্ক নেই। অ্যাম্বারগ্রিস শব্দটি প্রাচীন ফরাসি শব্দ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। তবে, বিখ্যাত তিমি বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার কেম্প তার বই ‘Floating Gold: A Natural (and Unnatural) History of Ambergris’-এ বলেছেন, স্পার্ম তিমিদের মধ্যে মাত্র ১% এই অ্যাম্বারগ্রিস উৎপন্ন করে। তাঁর কথায়, বেশিরভাগ তিমি মাছের দাঁত নেই, তাই তারা ফিল্টার ফিডিং প্রক্রিয়ায় খাবার সংগ্রহ করে। দাঁতালো তিমিদের মধ্যে স্পার্ম তিমি খাদ্য হিসেবে স্কুইড, অক্টোপাস, ক্যাটল ফিস, সামুদ্রিক পাখি শিকার করে খায়। কিন্তু শিকারের দেহের ধারালো শক্ত অংশ যেমন– পা, দাঁত, নখ, ঠোঁট হজম হয় না। এগুলো তিমি মাছের পেটে অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়।

এবার কি হয়, এই অপাচ্য টুকরোগুলোর আঘাতে তিমি মাছের যাতে ক্ষতি না হয়, সেই কারণে তাদের শরীর থেকে এক ধরনের চটচটে আঠালো পদার্থ ক্ষরিত হয় যা ওই অপাচ্য বস্তুগুলোকে ঢেকে ফেলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষরণও বৃদ্ধি পায় এবং বস্তুর আকারও বড় হতে থাকে। এই ক্ষরণ থেকেই তৈরি হয় অ্যাম্বারগ্রিস। কিন্তু এক সময় এই অ্যাম্বারগ্রিস এতই বড় হয়ে যায় যে, পায়ুপথ দিয়ে বের হয় না, তখন তিমি মাছ তাকে মুখ দিয়ে বের করে দেয়। তাই তাকে তিমির বমি বলা হয়।

তিমি মাছ মারা যাওয়ার পর বা তিমি মাছ বমি করার পর অ্যাম্বারগ্রিসের টুকরোগুলি সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়। প্রথমে এগুলো দেখতে হালকা সাদা বর্ণের মোমের মতো নরম এবং আঁশটে গন্ধযুক্ত হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নোনা জল এবং সূর্যের আলোর প্রভাবে শক্ত এবং ধূসর বাদামি রঙের হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর থেকে অতি সুন্দর একটি গন্ধ বের হতে থাকে, অনেকটা আইসোপ্রোপানলের মতো। অ্যাম্বারগ্রিস খানিকটা মোমের মতো পিচ্ছিল। সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় অনেকেই কুড়িয়ে পান, কিন্তু এর মূল্য জানেন না। যেহেতু সাগরে ভাসে এবং বাজারে দুর্মূল্য, তাই একে ‘ভাসমান সোনা’ বা ‘ফ্লোটিং গোল্ড’ বলা হয়।

তিমি মাছের এই বমি অনেক কাজে ব্যবহৃত হয়। শোনা যায়, ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের প্রিয় খাবার হিসেবে ডিম এবং অ্যাম্বারগ্রিস পরিবেশন করা হত। তিমি মাছের বমি যে গায়ে মাখছেন, তার কি কোনও খেয়াল আছে? আজ্ঞে হ্যাঁ, তিমি মাছের বমি সুগন্ধি তৈরিতেও কাজে লাগে। অনেকে আবার খাবার এবং পানীয়তে মিশিয়েও ব্যবহার করেন। অবাক হবেন না, ইউরোপে হট চকোলেট এবং তুরস্কে কফিতে ফ্লেভার আনতে অ্যাম্বারগ্রিস ব্যবহার করা হয়। অ্যাম্বারগ্রিসকে বিভিন্ন ওষুধ তৈরির কাজেও ব্যবহার করা হয়। এত ব্যবহারিক দিক থাকলেও চোরাশিকারিরা নিজের অর্থের ভান্ডার ফাঁপিয়ে তোলার জন্য এই বিরল প্রজাতির স্পার্ম তিমি মাছকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে একবারও ভাবছেন না।

সম্প্রতি মুম্বই থেকে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছে ১.৭ কোটি টাকার তিমি মাছের বমি পাওয়া গেছে। সে তিমি মাছের বমি জমিয়ে তা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করার মতলব আঁটছিল। তবে এখানেই শেষ নয়, এর আগেও গুজরাত এবং কর্নাটক থেকে কোটি কোটি টাকার অ্যাম্বারগ্রিসের পাচারকারীদের গ্রেফতার করে পুলিশ। এক কেজি অ্যাম্বারগ্রিসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ১ কোটি টাকার বেশি। দামি বস্তু তাই সহজে মেলে না। এই নিয়েই চলে জোরদার কালোবাজারি। বিশেষ করে সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় চোরা শিকারি ওঁত পেতে থাকে। স্পার্ম তিমি বিরল প্রজাতির, তাই এই প্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ কিন্তু কে শোনে কার কথা। তিমি মাছ মেরে তার পেট কেটে বের করে নেওয়া হচ্ছে অ্যাম্বারগ্রিস। এইভাবেই সংরক্ষিত এই প্রাণী বিরল থেকে বিরলতর প্রাণীতে পৌঁছে যাচ্ছে।

 

 

More Articles