ফুটপাথ থেকে কেনা হয়েছিল অমিতাভের পোশাক! 'ডন' কেন আজও এক ম্যাজিক?
Amitabh Bachchan Don Movie: ডন-এর আইকনিক গান 'খাইকে পান বানারসওয়ালা' আদৌ এই ছবির জন্য বানানোই না।
১৯৭৩ সালে জয়া সহ অমিতাভ বচ্চন লন্ডনে গেলেন। সেই তাদের প্রথম বিদেশযাত্রা। সেখানেই এক সিনেমাহলে দু'জনে মিলে সদ্য রিলিজ হওয়া ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার 'দ্য গডফাদার' দেখে মুগ্ধ হন। “সেই প্রথম আমরা জানতে পারি মাফিয়াদের বসকে ইতালিতে ডন বলে ডাকা হয়,” বলেছেন জয়া। বিশ্ব সিনেমার মোড় ঘোরানো এই ছবিটি বলিউড দেখল। আর সেই দশক পেরোতে না পেরোতে এই সিনেমার দু'খানা বলিউড সংস্করণ বেরিয়ে গেল। ফিরোজ খানের 'ধর্মাত্মা' আর চন্দ্রা বারোতের 'ডন'।
গডফাদার দেখে ধর্মাত্মা দেখতে বসলে দর্শকের বিরক্তি লাগা স্বাভাবিক। গল্প প্রায় নব্বইভাগ এক। মাফিয়া ধরমদাসের ভূমিকায় প্রেমনাথ একা স্মাগলিং করে না। তাঁর গোটা গ্যাং এক অর্থে একটা গোটা পরিবারের মতো। কখনও তো দিনে সাড়ে তিন কোটি টাকাও রোজগার হয়ে যায় বেটিং, লটারি আর মটকা থেকে। ভিটো করলিওনের মতোই ব্যক্তিগত জীবনে ধরমদাস এক স্নেহশীল পিতা, বিশ্বস্ত স্বামী আর ঈশ্বরপ্রেমী ভক্ত। ডনের মতো তিনিও ড্রাগের ব্যবসার ঘোর বিরোধী। এক ছেলে আছে, নাম রণবীর, (ফিরোজ খান যে ভূমিকায় অভিনয় করেছেন) যে এই সব কিছু না জেনেও পাকেচক্রে মাফিয়ার রাজত্বে জড়িয়ে পড়ে। নাম ভূমিকায় প্রেমনাথ, তাঁর দশাশই চেহারার জন্য হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ডায়লগ বলতেন, অনিচ্ছাকৃত হলেও শুনতে মার্লন ব্র্যান্ডোর সেই লেজেন্ডারি ডায়লগ ডেলিভারির কথা মনে আসে। অনেক পরে এই চেনা গল্পকেই নতুন বোতলে হাজির করেছেন এখনকার দুই পরিচালক প্রিয়দর্শন (ভিরাসত) আর রাম গোপাল ভার্মা (সরকার)। দ্বিতীয়টিতে তো মিল খুঁজে পাবার জন্য তেমন পরিশ্রমও করতে হয় না। তারপরেও মানতেই হবে ধর্মাত্মা সে যুগের চলতি আর দশটা মাফিয়া ছবির থেকে ট্রিটমেন্টে একেবারেই আলাদা।
আরও পড়ুন- সনিয়ার কন্যাদান করেন হরিবংশ রাই বচ্চন! কীভাবে নষ্ট হল অমিতাভ-রাজীব গান্ধীর বন্ধুত্ব?
মাফিয়া নিয়ে বানানো দ্বিতীয় ছবি ডন যে কোনও দিক থেকেই ধর্মাত্মাকে ছাপিয়ে গেছে। চরিত্রগত দিক থেকে ডন একেবারে বিপরীত। সে অল্পবয়স্ক, চঞ্চল, তাঁর পুরো নাম জানা নেই, অতীত জানা নেই। সে নারীসঙ্গলোলুপ, ম্যাচো, একা কাজ করতে পছন্দ করে এমনকী সে আদৌ তাঁর দলের মাথা কিনা সেই বিষয়েই মাঝে মাঝে প্রশ্ন উঠে যায়। একটু ব্যাখ্যা করে বলি। ছোটখাট মাল পাচার, স্মাগলিং দলের মাথারা করে না। কিন্তু ডন করে। তাঁর সহকর্মী নারঙ্গ তাঁকে নির্দেশ দেয় কোথায়, কখন যেতে হবে। এমনকী এক দৃশ্যে নারঙ্গকে কর্তৃত্বের সঙ্গে এও বলতে শুনি, “ডন ওহাঁ মজুদ হোগা”। গ্যাং মেম্বাররা ডনকে নাম ধরে, তুম বলে ডাকে। নারঙ্গকে ‘আপ’ আর ‘নারঙ্গ সাহিব’। তবে কি ডন নেহাতই ইন্টারপোলের সামনে ঝোলানো এক ধোঁকার টাঁটী, যাকে সামনে রেখে আসল কাজ চালায় নারঙ্গ? আর বোকা ডন এই ভেবেই আনন্দ পায় “ডন কো পকড়না মুশকিলই নেহি না মুমকিন হ্যায়”। হয়তো নারঙ্গ বোঝে ডন এক খোলা ইলেকট্রিক তারের মতো। তাই সিনেমার চল্লিশ মিনিট যেতে না যেতে ডন মারা পড়ে। খেয়াল করে দেখবেন ডনের মৃত্যুতে দল বা দলের কাজকর্মে কিছুমাত্র টোল পড়ে না। পরে অবশ্য দেখা যায় নারঙ্গ না ইন্টারপোল কপ সাজা ভারদানই আসল মাথা। সে যাই হোক। সে গল্প আর একদিন। আজ বরং এই সিনেমা তৈরি হওয়ার পিছনের গল্প বলি, যা সিনেমার চেয়ে কম চিত্তাকর্ষক না।
১৯৫৯ সালে তৈরি শামি কাপুর অভিনীত ‘চায়না টাউন’ ছবির (যাতে রফির গলায় 'বারবার দেখো, হাজারবার দেখো' এখনও আমাদের মন ভরিয়ে চলেছে) কাহিনিকে প্রায় হুবহু তুলে নিয়ে একটা স্ক্রিপ্ট লিখে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছিলেন সেলিম-জাভেদ জুটি। দেব আনন্দ থেকে ধর্মেন্দ্র, জিতেন্দ্র, কেউই উৎসাহ দেখাচ্ছিলেন না। এদিকে ক্যামেরাম্যান নরিম্যান ইরানি 'জিন্দেগি জিন্দেগি' ছবি করে প্রায় বারো লাখ টাকার লোকসান করেছেন। 'রোটি, কাপড়া অউর মকান' ছবির সেটে পরিচালক চন্দ্রা বারোত, জিনাত আমন আর অমিতাভ বচ্চন মিলে ঠিক করলেন নরিম্যানকে সাহায্য করতে তারা অর্ধেক পারিশ্রমিকে একটা ছবি বানাবেন। ছবি হিট হলে শেয়ার পাবেন তারা। সেলিম-জাভেদের থেকে গল্প চাইতেই সেলিম বললেন, “হামারে পাস এক ব্রেকফাস্ট স্ক্রিপ্ট পড়ি হ্যায় যো কোই নেহি লে রহা”। নরিম্যানের শিরে সংক্রান্তি। না পড়েই নিয়ে নিলেন সেটা। চরিত্র অভিনেতা হিসেবে প্রাণ তখন এক নম্বর। যশজিতের ভূমিকায় তাঁকে ছাড়া কাউকে ভাবাই যাচ্ছিল না। মুশকিল হলো শুটিং শুরুর আগেই পায়ে লাগল চোট। তিনি আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না। পরিচালক চরিত্রকে একটা লাঠি দিলেন আর সেই লাঠি হাতেই কামাল করলেন প্রাণ।
সিনেমার জন্য টাকা জোগাড় হয়েছিল প্রায় ভিক্ষা করে করে। চন্দ্রা বারোতের বোন কমল বারোত চল্লিশ হাজার টাকা ধার দিলেন। সেই টাকা দিয়ে স্টুডিও ভাড়া করা হলো। যে দৃশ্যে ডিএসপি বিজয়কে ডনের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ দেখাচ্ছে, সেই দৃশ্য শুটিং করা হয়েছিল পালি হিলে ওয়াহিদা রহমানের বাড়িতে। হসপিটালের দৃশ্যের জন্য ইমান ধরম ছবির তৈরি সেট খানিকক্ষণের জন্য ব্যবহারের অনুমতি নেওয়া হলো। 'ইয়ে হ্যায় বোম্বাই নগরিয়া'– গানে অমিতাভের সবুজ লুঙ্গি ফুটপাথের দোকান থেকে কেনা আর লাল শার্ট অমিতাভের নিজের। সেই বিখ্যাত দৃশ্য, যেখানে ডিএসপি সাহেব বিজয়কে বোঝাচ্ছেন, কেন তাঁকে ডন সাজতে হবে, গভীর রাতে মেহবুব স্টুডিওর ক্যান্টিনে শুটিং করা। সেই শুটিং নিয়ে বেশ কিছু মজার ঘটনা আছে। অমিতাভ সেই দৃশ্যের অনুশীলন করেছিলেন সঞ্জীব কুমারের 'নয়া দিন নয়ি রাত; দেখে। সেই সিনেমায় মাথায় তেল চুপচুপে, মুখে পান এক শিক্ষকের ভূমিকায় অনবদ্য ছিলেন সঞ্জীব। অমিতাভকে ওই সিনে দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় কত নিখুঁত তিনি তুলে নিয়েছেন অগ্রজ অভিনেতার ম্যানারিজমকে। মুশকিল হলো, ওই দৃশ্যের কন্টিনিউটি রাখতে সেই একদিনে পঁয়ত্রিশটা পান খেতে হয়েছিল অমিতাভকে। পরদিন চুনের ধকে মুখ পুড়ে একশা! এরপর থেকে পানে শুধু লালকাত্থা মিশিয়ে দেওয়ায় হতো। চুন বাদ।
আরও পড়ুন- কাঁদতে কাঁদতেই লাইভ গান রেকর্ড! কেন জনপ্রিয়তায় আজও অধরা কেএল সায়গল?
পয়সার টানাটানিতে সিনেমা থেকে বাদ পড়ে গেছিলেন এক বিখ্যাত অভিনেতা। রাজেন্দ্র কুমারের খুব ইচ্ছে ছিল ডিএসপির রোলটা করেন। কিন্তু তাঁর কাছে পুলিশের ইউনিফর্ম নেই। বানাতে মেলা খরচ। এদিকে ইফতেকার প্রায় সব ছবিতেই পুলিশ সাজেন। তাঁর কাছে বেশ কয়েক সেট ইউনিফর্মও আছে। শুধু পোশাকের জোরে ইফতেকারের রোল পাকা হলো। শেষ দৃশ্য শ্যুট করার কথা এক ক্যাথলিক কবরখানায়। কিন্তু সেই করবখানা যা ভাড়া চাইছে, দেবার সাধ্য নেই। ফলে নকল একটা কবরখানা বানানো হলো। ভালো করে দেখলে দেখা যাবে কবরখানার ফলকে ডন সিনেমার সব কাস্ট আর ক্রু মেম্বারদের নাম লেখা।
ডন-এর আইকনিক গান 'খাইকে পান বানারসওয়ালা' আদৌ এই ছবির জন্য বানানোই না। সিনেমার স্ক্রিনিং দেখতে এসেছিলেন অভিনেতা মনোজকুমার। তিনি বেজায় বকা দিলেন। বললেন “আরেহ, সেকেন্ড হাফে তো দম ফেলবার জায়গা নেই। দর্শকদের বাথরুম করতে যাবার সময় দিতে হবে তো? একটা গান ঢোকাও।" বাথরুমে যাওয়ার জন্য গান এমন আচমকা পাবেন কী করে? দেব আনন্দের 'বানারসী বাবু' ছবির একটা গান রিজেক্টেড হয়েছিল। কল্যাণজি- আনন্দজির সুরে আনজানের লেখা এই গান গাইতে গিয়ে কিশোর নিজেই বেশ কয়েকটা পান মুখে ঠুসে, নিচে পিক ফেলে মুড তৈরি করে নিয়েছিলেন। সিনেমা শেষে যখন গানের পিকচারাইজেশনের সময় এলো, দেখা গেল 'লাওয়ারিস' ছবির শুটিংয়ে পায়ে চোট পেয়েছেন অমিতাভ। তাঁকে তো আর লাঠি দেওয়া যায় না। এদিকে সময় হাতে নেই বিশেষ। সিনেমা রিলিজের তারিখ এগিয়ে এলো। সেই চোট পায়েই কিছুটা লেংচে যে নাচ নাচলেন অমিতাভ, গোটা ভারত এখনও তার রেশ কাটাতে পারল না।
সিনেমা চলাকালীনই নরিম্যান মারা যান। অল্প অল্প টাকা জমলেই শুটিং হচ্ছিল। ফলে সাড়ে চার বছর লেগে যায় গোটা সিনেমা হতে। রিলিজ হবার পরে কী হলো তা সবার জানা। সিনেমার লভ্যাংশ নরিম্যানের স্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই বছর ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেলেন অমিতাভ বচ্চন। মঞ্চে ডেকে নিলেন নরিম্যানের স্ত্রীকে। পরিচালক চন্দ্রা বারোত জানালেন, “সিনেমা না, এই কয়েক বছর আমরা সবাই মিলে আসলে একটা পিকনিক করেছিলাম। বুঝতেই পারিনি যে ছবি কেউ বানাতেই চায়নি, একদিন সে ছবিকে কেউ ভুলতে পারবে না।”