মোদি ম্যাজিক না কি শাহি-শ্রম? কোন মন্ত্রে গুজরাতে ফের পদ্ম-হাতছানি
Gujarat Elections 2022: সব মিলিয়ে কে জিতবে? বিজেপি না কংগ্রেস না কি নজির গড়বে আম আদমি দল?
মোদির রাজ্যে নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছিল সর্বাধিক। ১৮২ বিধানসভা আসনের লড়াই ফের শোরগোল ফেলে দেশজুড়ে। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির ঠিক কী পরিস্থিতি, সেই পরীক্ষাও ছিল এই নির্বাচন (Gujarat Legislative Assembly Election)। একাধিক বিতর্ক, প্রশ্ন আর গুজরাত-বিজেপি এবং তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাজ নিয়েও সমালোচনা চলে বিস্তর।
তবে সমস্ত কিছুর পরেও নির্বাচন শেষ হতেই ৫ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে এসেছে নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষার ফল। এক্সিট পোলের (Exit Poll) ফলাফল বলছে ফের, অর্থাৎ, ১৫তম গুজরাত বিধানসভায় রাজ করতে চলেছে বিজেপি। গতবারের তুলনায় বেশি আসন নিয়ে ফের ক্ষমতায় আসতে চলেছে ভূপেন্দ্র প্যাটেলের নেতৃত্বাধীন দল। মোদি-শাহের রাজ্য খুব একটা বিপদ বাড়াচ্ছে না দিল্লির।
যদিও এই ফলাফল বলা হচ্ছে সমীক্ষার ভিত্তিতে! নির্বাচনের গণনা ৮ ডিসেম্বর। রাত পোহালেই স্পষ্ট হবে গুজরাতের জনতার মত ঠিক কোন দিকে।
আরও পড়ুন: গ্রামে প্রথমবার ভোটগ্রহণ, উৎসবের মেজাজে গুজরাতের ‘মিনি আফ্রিকা’
ঠিক কী বলছে বুথফেরত সমীক্ষার ফল?
একাধিক গণমাধ্যম এবং সমীক্ষক সংস্থার পক্ষ থেকে প্রকাশিত ফলাফলে অনুযায়ী;
'আজতক-অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া' বলছে, গুজরাত বিধানসভার নির্বাচনের ফলে বিজেপি (BJP) পেতে পারে ১২৯-১৫১টি আসন। কংগ্রেসের (INC) ভাগ্যে জুটতে পারে ১৬-৩০টি আসন। আম আদমি দল (AAP) পেতে পারে ৯-২১টি আসন। অন্যান্য ২-৬।
'সি ভোটার-এবিপি নিউজে'র সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, বিজেপি পেতে পারে ১২৮ থেকে ১৪০টি আসন। কংগ্রেস ৩১ থেকে ৪৩, আর আম আদমি দলের ভাগ্যে যেতে পারে ৩ থেকে ১১টি আসন। এখানেও অন্যান্যদের জন্য রয়েছে ২-৬টি আসন।
'টু'ডেস চানক্য-নিউজ ২৪'- এর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বিজেপি পেতে পারে ১৫০টি আসন। কংগ্রেস মাত্র ১৯টি। এবং আপ ১১টি আসন পেতে পারে। অন্যান্যরা ২টি।
'নিউজ এক্স-জন কী বাত'-এর তথ্য বলছে, ১১৭ থেকে ১৪০ আসন বিজেপি। কংগ্রেস ৩৪ থেকে ৫১। আপ ৬ থেকে ১৩। আর অন্যান্যদের ভাগ্যে যেতে পারে ১ থেকে ২টি আসন।
'জি নিউজ-বার্ক'-এর যৌথ সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, ১১০-১২৫ বিজেপি। কংগ্রেস ৪৫-৬০। আপ ১-৫। অন্যান্যরা ০-৪ আসন।
'টাইমস্ নাও-ইটিজি' বলছে, ১৩৫-১৪৫ আসন বিজেপি। কংগ্রেস ২৪-৩৪, আপ ৬-১৬ এবং অন্যান্যদের ভাগ্যে যেতে পারে ১-৩ আসন।
'টিভি নাইন গুজরাতি' বলছে, বিজেপি পেতে পারে ১২৫-১৩০ আসন। কংগ্রেসের দখলে যেতে পারে ৪০-৫০ আসন। আম আদমি পার্টির ভাগ্যে ৩-৫, অন্যান্যরা পেতে পারে ৩-৭ আসন।
'রিপাবলিক-মার্ক'-এর সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, ১২৮-১৪৮, কংগ্রেস ৩০-৪২, আপ ২-১০, অন্যান্যরা ০-৩ টি আসন পেতে পারে।
৫ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে ছ'টার পর প্রকাশিত এই বুথফেরত সমীক্ষার ভিত্তিতে উঠে এসেছে এমন সম্ভাবনা। যেখানে উঠে এসেছে কংগ্রেসের বিপর্যয় এবং ফের বিজেপির উত্থানের কথা। সঙ্গে আম আদমি দলের ভাগ্য ফেরাতে খুব কম আসন।
গুজরাত বিধানসভা নির্বাচন
৩ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচন কমিশনের তরফে গুজরাত বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। কেন দেরি করে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা, তা নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়। যদিও নির্বাচনের আবহ শুরু হতেই কোমর বেঁধে প্রচারে নামে বিরোধীরা। কংগ্রেস থেকে আম আদমি পার্টি, একের পর এক আক্রমণে বিদ্ধ হয় বিজেপি। পাল্টা প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা হার্দিক প্যাটেল থেকে শুরু করে ক্রিকেটার রবীন্দ্র জাদেজার স্ত্রী রিভাবা, একের পর এক চমকে এগিয়ে যেতে শুরু করে বিজেপি।
এর মধ্যেই বিড়ম্বনা বাড়ায় মোরবি ব্রিজ দুর্ঘটনা। একাধিক মানুষের মৃত্যু নিয়েও প্রশ্নের মুখে পড়ে বিজেপি সরকার। ভোটের আগেই অস্বস্তি বাড়ে ভূপেন্দ্র প্যাটেলের। এর মধ্যেই নিজের রাজ্যে প্রচার শুরু করেন নরেন্দ্র মোদি নিজেও। একের পর এক উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে থাকেন একাধিক জনসভায়। করেন রোড শো।
এর মধ্যেই মূলত দুই দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গুজরাতে। ১ ডিসেম্বর প্রথম দফা এবং ৫ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফা। একাধিক জনসভায় ভাষণ এবং নানান উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও, অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে (Arvind Kejriwal) নিয়ে হিন্দু-বিতর্ক সৃষ্টি হলেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অশান্তির খবর আসেনি গুজরাত থেকে। রক্তাক্ত হয়নি এই নির্বাচন। একাধিক বিরোধ থাকলেও নির্বাচন চলেছে শান্তিপূর্ণ। বিরোধীদের তরফে আসেনি রিগিং বা জোর করে ভোট করার অভিযোগও।
গুজরাত-ফ্যাক্টর
মূলত, সৌরাষ্ট্রের এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বিষয় মাথাচাড়া দেয়। একদিকে বারবার মুখ্যমন্ত্রী বদল, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা এবং অন্যদিকে আম আদমি দলের উঠে আসা। গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ইস্যুর পাহাড়। যার মধ্যে অন্যতম হিসেবে উঠে আসে;
মাদক-বিরোধ
সম্প্রতি, বিষমদ পানে প্রায় ৫০ জনের মৃত্যু ঘটে গুজরাতে। ঠিক এই ঘটনার পরেই রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয় বিরোধীরা। কংগ্রেসের জগদীশ ঠাকুর থেকে শুরু করে আপের নেতা ইসুদান গাধবি। গুজরাতে মদ বন্ধের পরেও কেন এই ঘটনা ঘটল, তা নিয়েও সরব হন তাঁরা। নির্বাচনের প্রচারজুড়ে এই ইস্যু বড় ভূমিকা পালন করে গুজরাতে।
'ড্রাগ মাফিয়া'
২০২১ এই গুজরাতে উদ্ধার হয় ৩ কেজির বেশি হিরোইন। ২০২২ এ-ও প্রায় একই অবস্থা হয় গুজরাতের। একাধিক বন্দর থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় ড্রাগকাণ্ড বিতর্ক বাড়ায় রাজ্যে। প্রশ্ন ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে। একটি মামলায় হস্তক্ষেপ করে শীর্ষ আদালতও। নির্বাচনের প্রচারে এই ড্রাগ মাফিয়া নিয়েও বিরাটভাবে সরব হয় বিরোধীরা।
দুর্নীতি
গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে দুর্নীতিও বড় ভূমিকা পালন করে। ২০২১ এর ডিসেম্বরে গুজরাত সাবঅর্ডিনেট সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডের ক্লার্কশিপের পরীক্ষা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ৮৮ হাজার পরীক্ষার্থীর ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা করছে সরকার, অভিযোগ করে কংগ্রেস। ওই বোর্ডের চেয়ারম্যান বিজেপি নেতা অসিত ভোরার বিরুদ্ধেও ওঠে অভিযোগ। উত্তাল হয় গুজরাত। একই অভিযোগে সরব হয় আপ। ৮ থেকে ১২ লক্ষ টাকা ঘুষের বিনিময়ে চাকরি হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। উত্তাল হয় গুজরাত বিধানসভা। নির্বাচনেও এই দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ হয় বিজেপি।
বেকারত্ব
বাণিজ্যের রাজ্য। অর্থনীতির রাজ্য মোদীর গুজরাত নিয়েও প্রশ্ন ওঠে বারবার। বেকারত্বের ইস্যুতে উত্তাল হয় নির্বাচন। যুবসমাজের মধ্যে কাজের অভাব নিয়েও প্রশ্ন ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে। আদানিদের বন্দরের মধ্যেই ওঠে নানা বেআইনি কাজের অভিযোগ।
জানা যায়, প্রায় ৪ লাখ বেকার যুবক যুবতী এক বছরে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন রাজ্যের বেকার পোর্টালে। ৩,৮৫,৫০৬ জন শিক্ষার আলোয় পায়নি। কাজ পায়নি কয়েক লক্ষ। একাধিক তথ্য শোরগোল পড়ে রাজ্যজুড়ে। কাজের প্রশ্নেও উত্তাল হয় গুজরাত।
অশিক্ষা, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি
গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শুরু করে শহুরে জীবন। অশিক্ষার অন্ধকার নিয়েও প্রশ্ন ওঠে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। এদিকে গ্যাসের দাম থেকে পেট্রপণ্যের দাম বৃদ্ধি। চাল থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি, সব ক্ষেত্রেই অভিযোগের মুখোমুখি হয় গুজরাত সরকার।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা
এক দিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। অন্যদিকে রাজ্যের বিজেপি সরকার। একাধিক ক্ষেত্রেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয় বিজেপি। রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়েও ওঠে প্রশ্ন।
কেন জিতছে বিজেপি?
একাধিক ইস্যু এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ঝড় থাকলেও মোরবি ব্রিজ বিপর্যয় থেকে দারিদ্র্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও কেন বুথ ফেরত সমীক্ষা বলছে ভিন্ন কথা?
হিন্দুত্ববাদ
গুজরাত জুড়ে জাতপাতের বিভিন্নতার মধ্যেই সূচিত হয় ধর্মের হাতছানি। গোধরা থেকে শুরু করে একাধিক ক্ষেত্র, বারবার গুজরাতের সুরাত থেকে শুরু করে গান্ধীনগর, কচ্ছ। একাধিক জায়গায় হিন্দু এবং মুসলমান বিভাজন এই রাজ্যে অন্যতম। সেখানে দাঁড়িয়ে, নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ এবং রাজ্যের বিজেপি নেতারা তাঁদের হিন্দুত্ববাদী মনোভাবের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন।
জাতীয়তাবাদ
একদিকে দুর্নীতির অভিযোগ অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। একাধিক অভিযোগের মধ্যেও এই রাজ্যে মূলত শোরগোল ফেলেছে জাতীয়তাবাদ ইস্যু। কংগ্রেস বা অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে ভারত-বিরোধিতার সূত্রও।
কেজরিওয়াল প্রভাব
প্রবল মোদি-বিরোধী। বিজেপির কট্টর সমালোচক অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি দলের প্রভাব গুজরাতজুড়ে শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একাধিক ক্ষেত্রে ভালো প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু এখানেই উঠেছে প্রশ্ন। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং আম আদমি পার্টি আসলে বিজেপির সুবিধা করেছে। বিরোধী ভোট ভাগ এবং গুজরাতের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের শক্তিক্ষয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে আম আদমি পার্টি। যেখানে দাঁড়িয়ে বিজেপি বিরোধিতা এবং ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের মানুষের কাছে দুবিধা তৈরি হয়েছে। যার সঙ্গেই ভাগ হয়েছে বিরোধী ভোট।
মোদি-ফ্যাক্টর
নিজের রাজ্য গুজরাত। প্রধানমন্ত্রীর এই ইমেজ বরাবর প্রচারিত হয়েছে এই রাজ্যে। যেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর তরফে প্রচারেও খামতি রাখেননি মোদি (Narendra Modi)। সেই ফ্যাক্টর কাজে লাগতে পারে বলেই মনে করেছেন অনেকেই।
আদিবাসী অসন্তোষ এবং বিকল্পের অভাব
গুজরাতের বিজেপি সরকার। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের বিরাট মূর্তি এবং আদিবাসী উচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। রাজ্যজুড়ে বিরাট-সংখ্যক জনজাতির মানুষের বসবাস এবং তাঁদের সার্বিক উন্নয়ন নিয়েও সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে বিকল্পের অভাব বোধ কাজ করতে পারে। যেখানে বিজেপি নয়তো কে! এই প্রশ্নেও বিভক্ত হতে পারেন আদিবাসীরা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা।
শিল্প-ফ্যাক্টর
টাটা থেকে আদানি, একাধিক ক্ষেত্রে গুজরাতজুড়ে নানা অভিযোগের পরেও শিল্পের বিস্তার নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে বারবার। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি বলেই মত।
সব মিলিয়ে কে জিতবে? বিজেপি না কংগ্রেস না কি নজির গড়বে আম আদমি দল? এই প্রশ্নের উত্তর বৃহস্পতিবার পাওয়া গেলেও আপাতত আভাস বলছে, ফের গুজরাতে হাসবে বিজেপি। আর সেখানেই একাধিক প্রশ্ন আর বিতর্কের আবহে তৈরি হয়েছে জল্পনা এবং রাজনৈতিক আলোচনার রসদ।