প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রের কিছু উপাচার, নারীর ত্বক বিষয়ক- প্রথম পর্ব
ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার বহু মহিলাকেই জীবনে একবার না একবার হলেও বাড়ির বড়দের কাছে গায়ের রং নিয়ে কোনো না কোনো কথা শুনতেই হয়েছে। গায়ের রং কীভাবে ভালো রাখা যায়, কী করে নিজের রং ও রূপ আরো ফুটিয়ে তোলা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে এই ধরনের কথাবার্তা চলেই আসছে সমাজে। আর বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরো বেশি করে চোখে পড়ে। বাড়ির বয়স্ক মহিলারা তাদেরকে এমন কিছু টিপস সবসময় দেন যা ব্যবহার করলে তাদের সন্তানের গায়ের রং ফর্সা হবে। হলুদ দুধ থেকে শুরু করে আরো কত কী খাওয়ানো হয় একটি গর্ভবতী মা কে। কিভাবে ত্বকের রঙ উজ্জ্বল করতে হয়, কিভাবে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে হয়, সবকিছু নিয়েই একাধিক নথিপত্র এবং বই আমরা দেখেছি। শুধুমাত্র বাড়ির বড়দের মুখেই নয়, এই ধরনের বিভিন্ন উপাচারের কথা লেখা রয়েছে আমাদের আদি চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যেও। আয়ুর্বেদ এবং ইউনানীর মত কিছু চিকিৎসাশাস্ত্রেও এই ধরনের বিভিন্ন উপাচারের উল্লেখ রয়েছে, যেগুলি মূলত তৈরি করা হয়েছিল ভারতের মধ্যম বর্গীয় মহিলাদের জন্যই।
গ্রিক এবং আরবিক মিশ্রিত ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতিতে মূলত এই ধরনের বিভিন্ন টিপস এর ব্যাপারে লেখা রয়েছে। এই ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতিটি মূলত কাজ করে মানুষের শরীর থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন হরমোন জাতীয় দেহরসের সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখার উপরেই। তার সাথে সাথেই মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য বজায় রাখাও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এই চিকিৎসা পদ্ধতির। এই চিকিৎসা পদ্ধতির বিভিন্ন নীতির উপর নির্ভর করে ভারতে বিভিন্ন ধরনের ঘরোয়া স্বাস্থ্য নির্ভর পুস্তিকা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, যেগুলিতে মূলত প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের কিভাবে উন্নতি করা যায় সেসব নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এই সমস্ত পুস্তিকার লেখকেরা খাদ্য বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের আলোচনা এই সমস্ত পুস্তিকায় করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতে এই সমস্ত পুস্তিকার মাধ্যমেই খাদ্য বিজ্ঞানের চল শুরু হয়। এর মধ্যে বেশকিছু পুস্তিকা দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল ভারতীয় মধ্যম বর্গীয় মহিলাদের মধ্যে। এর মধ্যেই একটি পুস্তিকা রচয়িতা ছিলেন রাজকীয় রাজ্য ভোপালের রানী সুলতান জাহান বেগম। ১৯১৬ সালে তিনি রচনা করেন হিফজ - এ - সিহ্যত। এই পুস্তিকাটি সেই সময় দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল মহিলাদের মধ্যে। এই প্রসঙ্গে আরও একটি পুস্তিকার নাম উল্লেখ করা ভালো। সেটি হল তাবিব আল নিসা। এবং এটি কে রচনা করেছিলেন হাকিম ডাক্তার কাজি মহম্মদ আজিমুল্লাহ। ১৯৩৪ সালে লাহোরে এই পুস্তিকাটি প্রথমবার প্রকাশিত হয়েছিল।
দুটি পুস্তিকাই উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত উর্দুভাষী মহিলাদের জন্য লেখা হয়েছিল। ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতি এবং পশ্চিমের জৈববিজ্ঞানের নানা রকম কলাকৌশল সম্বলিত এই সমস্ত পুস্তিকায় মূলত এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ছিল, যেগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে চলে এসেছে। বহু মহিলা যারা নিজেদের স্বামীর সাথে মফস্বল থেকে বেরিয়ে এসে শহরে আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছিলেন তাদের জন্যই মূলত এই সমস্ত পুস্তিকা তৈরি হয়েছিল। কিছু এমন আলোচনা, যেগুলি প্রথাগতভাবে বাড়ির বড়রা বাড়ির ছোট সদস্যদের শিখিয়ে আসে, সেগুলো নিয়েই ছিল আলোচনা। সুলতান জাহান বেগমের এই 'হিফজ এ সিহ্যত' মূলত ছিল একটি দুই খন্ডের পুস্তিকার সিরিজের দ্বিতীয় খন্ড। প্রথম খন্ড হিদায়াতুল আজ জাজউনে মূলত শরীয়াত আইন নিয়ে আলোচনা করা ছিল।
দ্বিতীয় খন্ড অর্থাৎ 'হিফজ এ সিহ্যত' - এ তিনি কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, যা মহিলাদের নিজেদের বয়স ধরে রাখতে সক্ষম করবে। স্বাস্থ্যকর খাবার, বর্জ্য পদার্থ, বাড়ি পরিষ্কার রাখার বিভিন্ন কৌশল, পোশাক-আশাকের রীতিনীতি, ব্যায়াম এবং সঠিক খাদ্য এই সমস্ত বিষয় নিয়ে এই পুস্তিকায় আলোচনা রয়েছে। উনবিংশ শতকের ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে বেগম এই পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। মুসলিম আখলাক পদ্ধতি অনুসারে মূলত তাঁর এই পুস্তিকার রচনা করা হয়েছিল। কিন্তু এই পুস্তিকার কিছুটা অংশে ইংরেজদের দ্বারা জারি করা স্যানিটেশনের বিধি-নিষেধের উল্লেখও মেলে।
অন্যদিকে, তাবিব আল নিসা মূলত পুরাতন উর্দু টিববি চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করে লেখা। এই ডাক্তার এবং হাকিম দুটি শব্দই উল্লেখিত এবং কাজী মহম্মদ আজিমুল্লাহ নিজেও জানিয়েছেন, পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতি এবং পুরাতন টিব্বি চিকিৎসা পদ্ধতির মেলবন্ধনেই তার এই পুস্তিকা তৈরি। মহিলাদের গাইনী সমস্যা, পুরুষ এবং মহিলার মধ্যে শারীরবৃত্তীয় তফাৎ, সাধারণ রোগের উপাচার এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যবান হওয়ার কিছু টিপস নিয়ে রচিত তাবিব আল নিসা।
সাধারণ খাদ্যাভ্যাস -
'হিফজ এ সিহ্যত' পুস্তিকার মাধ্যমে সুলতান জাহান বেগম মূলত একটি বিশেষ ধরনের ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন যাতে করে, দেহের কিছু কিছু সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে বাড়ি থেকেই। তবে, তারা আলোচনার মূল বিষয়টা ছিল গর্ভবতী মহিলাদের নিয়ে। তার লেখা পুস্তিকার একটি লাইন হলো, "মায়াই কা জান বুঝে কর বচ্চে কি সেহত সে গলফত করনা য়ানি খুদ বিমার হোকর বচ্চে কো বিমার বনা দেনা" অর্থাৎ, "যে সমস্ত মায়েরা নিজেদের সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল নন তারা নিজের অসুস্থ হয়ে নিজেদের শিশুকেও অসুস্থ করে দেন।" তিনি এই পুস্তিকায় ৬টি এমন জিনিসের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন যেগুলি শরীর স্বাস্থ্য ভালো রাখার পক্ষে প্রয়োজনীয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য : বাতাস, সঠিক খাদ্য, সঠিক সময় ঘুমোতে যাওয়া, সঠিক সময় ঘুম থেকে ওঠা, শরীর পরিষ্কার রাখা, শরীরচর্চা এবং সঠিক পোশাক পরা।
সুলতান জাহান বেগম তার নিজের বইয়ে মধ্যবিত্ত বাড়িতে অতিরিক্ত চা এবং কফি পান করার অভ্যাসটিকেও বদ অভ্যাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলছেন, খাদ্যদ্রব্য সবসময় হালকা এবং স্বাস্থ্যকর হওয়া উচিত যাতে শরীর কোনভাবে অসুস্থ না হয়ে পড়ে। সবার একই ধরনের খাদ্য খাওয়া উচিত নয়। সবার খাদ্যাভ্যাস আলাদা হয়। মিষ্টি এবং তেল জাতীয় খাবার শরীরে ফ্যাটের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। সাথে সাথেই, এই ধরনের খাবারের ফলে মুখ আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, যদি আপনি বেশি করে ফল খান তাহলে আপনার শরীরের জেল্লা বৃদ্ধি পাবে এবং শরীরের পাচনতন্ত্র ভালো থাকবে।
অন্যদিকে আজিমুল্লাহ উপদেশ দিয়েছেন, খাদ্যদ্রব্য সবসময় হালকা হওয়া উচিত। তিনি ফলের জ্যাম, গুরুপাক খাবারের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন দুধ, রুটি, মাখন এবং ডিম এর উপরে। তবে শুধুমাত্র আজিমুল্লাহ একা নন, উর্দু ইউনানী চিকিৎসা শাস্ত্রের বহু বইতে এই ধরনের খাদ্যের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, এবং বলা হয়েছে এই ধরনের খাদ্য গ্রহণ করলে আপনি আরো বেশি সুস্থ থাকবেন এবং আপনার শরীরের জেল্লা আরো ফুটে উঠবে। পাশাপাশি এই ধরনের খাদ্য আপনার ত্বকের রং আরও উজ্জ্বল করতেও সাহায্য করবে।
তথ্যসূত্রঃ https://scroll.in/article/1006392/how-urdu-domestic-manuals-in-the-1900s-taught-indian-women-to-be-fair-and-lovely