জোব্বার ভেতর লুকিয়ে নিয়ে আসা বীজ থেকে ভারতে এল সবার প্রিয় এই পানীয়

সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যেই কফি উচ্চবিত্ত ভারতীয়দের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শহরের প্রাণকেন্দ্রগুলোতে তৈরি হয় 'কোয়াহখানা' বা কফিহাউজ।

কফির কথা উঠলেই আমার-আপনার মাথায় প্রথম কী ভেসে আসে? এখন চারপাশে এত ক্যাফে, কফির কাপে আড্ডার তুফান- এক লহমায় চোখের সামনে ভেসে উঠবে তেমনই কোনও দৃশ্য। কিন্তু কফি থেকে ক্যাফেটেরিয়ার যাত্রাপথের যে অজানা গল্প, তা অনেকেরই অজানা। ভারতে কফির আগমনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ ৪০০ বছরের ইতিহাস ও মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির এবং এক বৃদ্ধ সন্তর কথা।

কফি আবিষ্কারের গোড়ার কথা
কফির জন্ম নিয়েও আছে এক মজার গল্প। সুদূর আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় এক মেষপালক রোজই ভেড়ার পাল নিয়ে মাঠে যেতেন। কিছুদিন যাবৎ তিনি হঠাৎই লক্ষ করতে শুরু করেন, তাঁর পোষ্যদের স্বাভাবিক আচরণগত বদল ঘটছে। তারা আগের চেয়ে বেশ কিছুটা সক্রিয়। হতবাক মেষপালক অনেক খুঁজে যা পেলেন, তাতে তাঁর বিস্ময়ের শেষ থাকল না। একটি গাছের পাতা খেয়ে তার পোষা ভেড়াদের ঘুম ছুটেছে। সেখান থেকেই কফির আবিষ্কার। কিন্তু কফিকে প্রথম নিয়মিত পানীয় হিসেবে ব্যবহার করার চল শুরু হয় ইয়েমেনে, চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। ভারতে তখনও কফি আসতে ২০০ বছর বাকি।

প্রথমদিকে আরবে কফির সঙ্গে ওয়াইনের তুলনা করা হত। কফিকে বলা হতো 'ওয়াইন অফ বিনস'। ওয়াইনের মতো ভেষজ হয়েও কফিতে নেশা হয় না, আরব দেশে এইটাই ছিল কফির সবচেয়ে বড় ইউএসপি।

আরও পড়ুন: কাপেই নয় শুধু, তুফান উঠুক চিন্তায়ও- আলোআঁধারির কফিহাউজ

আরবে কফি গাছ থেকে সংগ্রহ করে ভালো করে রোস্টিং করার পর তা পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আবার তখনকার দিনে বহু সাধুসন্ত পুজো-উপাসনার সময় নিজেদের জাগিয়ে রাখার জন্য কফিকে পানীয় হিসেবে ব্যবহার করতেন।

কফির ভারতে আগমন
আরব উপমহাদেশে কফি জনপ্রিয়তা পেলেও তার দাম ছিল অনেক। তাই কেউই সরাসরি কফিচারা নিয়ে আরব থেকে অন্য দেশে আসতে পারতেন না। আরব থেকে কেবল রোস্টেড কফি রফতানি হতো, যা থেকে পরবর্তীতে কফি চাষ সম্ভব ছিল না। শুরুর দিকে মুঘল জমানায় কফি আমদানি করা হতো আরব থেকে।

ষোড়শ শতাব্দীতে এক মুসলমান সন্তর হাত ধরেই ভারতে কফি চাষের গোড়াপত্তন হয়। বাবা বুদন নামের সেই সন্ত থাকতেন দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকের চিকমাগালুর পাহাড়ের এক গুহায়। একবার তিনি হজ করার উদ্দেশ্যে মক্কা গিয়েছিলেন। ফেরার পথে নিজের জোব্বার ভেতরে লুকিয়ে ভরে এনেছিলেন সাতটি কফির চারা। সেখান থেকেই ভারতে কফির চাষের শুরু।

কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে কফি পানের কথা প্রথম পাওয়া যায় পর্যটক রেভারেন্ড এডওয়ার্ড টেরির লেখায়। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের দরবারে টেরি ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজার দূত। টেরি তাঁর ভারত বিষয়ক লেখায় কফি নিয়ে লিখছেন, "ভারত বহু ধর্মের দেশ। ভারতের মানুষ খুবই কঠোরভাবে তাঁদের ধর্মাচরণ করে থাকে। এমনকী, ধর্মের কারণে বহু মানুষ মদ‍্যপান করেন না, কিন্তু তাঁরা প্রায় সকলেই এক ধরনের পানীয় খান, যাতে নেশা হয় না কিন্তু শরীর তরতাজা থাকে। তাঁরা এই বিশেষ পানীয়টিকে কফি বলেন।"

সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যেই কফি উচ্চবিত্ত ভারতীয়দের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শহরের প্রাণকেন্দ্রগুলোতে তৈরি হয় 'কোয়াহখানা' বা কফিহাউজ। মূলত দিল্লির শাহাজানাবাদ, লালকেল্লা, চাঁদনি চক এলাকায় কফিহাউজগুলি ছিল। এই কফিহাউজগুলিই ধীরে ধীরে আড্ডা এবং মত আদানপ্রদানের ঠেক হয়ে উঠতে শুরু করে। কবি থেকে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী থেকে সাধারণ মানুষের আড্ডা, তর্ক, আলোচনার স্থান হয়ে ওঠে কফিহাউজগুলি।

কিন্তু ভারতের ইতিহাসে মুঘল সূর্য অস্ত যাওয়ার পর পরই কফির বাড়বাড়ন্ত কমে আসতে থাকে। চা-পাগল ব্রিটিশরা কফির বদলে চা চাষকেই অনেক বেশি প্রাধান্য দেয়।

বিশ্বে কফি পানের ইতিহাস
কফি মূলত আবিষ্কারের পর থেকেই ইসলামপ্রধান দেশেই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু কফির বিশ্বভ্রমণের দরজা প্রথম খুলে দিল ভেনিস। ভেনিস থেকেই বাকি ইউরোপে কফি ছড়িয়ে পড়ে। এরপরে আস্তে আস্তে কফি চাষে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব কমতে থাকে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে শুরু হয় কফি চাষ।

আমেরিকায় কফির জনপ্রিয়তার পিছনে আবার আছে অন্য একটি গল্প। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বস্টন টি-পার্টির ওপর হামলা চালায় মার্কিন মুক্তিকামীরা। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের প্রতি রাগ থেকেই জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন আমেরিকা প্রায় একপ্রকার বয়কট করে চা-কে। তখন থেকেই কফি চাষের জনপ্রিয়তা শুরু আমেরিকায়। তারপর আমেরিকার হাত ধরেই ব্রাজিলে কফির চাষ শুরু হয়।

ব্রিটিশ ভারতে কফি
কফির প্রতি তেমন প্রেম না থাকলেও দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় কফি চাষ প্রথম শুরু করে ইংরেজরা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি একের পর এক বড় শহরে গড়ে উঠতে থাকে আড্ডা দেওয়ার জন্য ক্লাব। ১৮২৭ সালে কলকাতায়, তারপরে ১৮৩২-এ মাদ্রাজে এবং ১৮৬৩-তে বেঙ্গালুরুতে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ক্লাব, যেখানে মূল পানীয় হিসেবে কফিকে রাখা হতো।

বর্তমানে ভারত পৃথিবীর ষষ্ঠ কফি উৎপাদনকারী দেশ। কর্নাটক, কেরল, তামিলনাড়ুর বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ১৬ রকম প্রজাতির কফির চাষ হয়।

ভারতে কফিকে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে ইন্ডিয়ান কফিহাউজের বিশাল অবদান রয়েছে। ১৯৩৬-এর কফি সেস কমিটির তত্ত্বাবধানে ভারতের বিভিন্ন বড় শহরে গড়ে উঠতে থাকে কফিহাউজ। ১৯৩৬-এ বম্বেতে প্রথম তৈরি হয় ইন্ডিয়ান কফিহাউজ। বর্তমানে ইন্ডিয়ান কফিহাউজের ৭২টি শাখা রয়েছে। সেখানে আজও নবীন থেকে প্রবীণের আড্ডা বসে, কফির কাপে তর্কের তুফান ওঠে।

More Articles