কৃষ্ণনগরের মনসামূর্তির ভেতর যেভাবে বেঁচে রয়েছে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি

Manasa Clay Dolls : এখানে, প্রতিমার পাশাপাশি ঘটেও মা মনসার পুজো হয়ে থাকে। ৬৩ বছর বয়সি মৃৎশিল্পী মাধব পাল পূর্বপুরুষের এই শিল্পশৈলীকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন ঐতিহ্যের এই শহরে।

কৃষ্ণনগর, বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এক জনপদ। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কীর্তির সাক্ষী এই শহর। জগদ্ধাত্রী পুজো, সরভাজা ও মাটির পুতুলের জন্য খ্যাত এই শহরের বুকেই বাংলা লোকায়তসংস্কৃতির ধারা প্রচারের আলোর থেকে দূরে নীরবে বিরাজ করছে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রকৃতির শ্রীবৃদ্ধির মধ্যেই নিজের সমৃদ্ধির সার্থকতাকে এই শহর খুঁজে পেয়েছে। শ্রেণি চেতনার গণ্ডিকে পেরিয়ে সার্বজনীন লোকায়ত-ধর্ম গড়ে তুলেছে বাঙালি। আর সেই সার্বজনীন-সত্তার পূর্ণপ্রভার দেখা মেলে মা মনসার আরাধনায়। শ্রাবণ সংক্রান্তির মনসা পুজো উপলক্ষ্যে কৃষ্ণনগরের পাটকাঠি কলোনীতে তৈরি হয় মনসার ঘট। এখানে, প্রতিমার পাশাপাশি ঘটেও মা মনসার পুজো হয়ে থাকে। ৬৩ বছর বয়সি মৃৎশিল্পী মাধব পাল পূর্বপুরুষের এই শিল্পশৈলীকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন ঐতিহ্যের এই শহরে।

আরও পড়ুন-

কেবল রথের মেলাতেই কেন পাওয়া যায় মুর্শিদাবাদের এই মাটির পুতুল?

চাক ঘুরিয়ে বেলে-দোয়াশ মাটি সহযোগে ঘট তৈরি করা হয়। হাতে টিপে মাটির সর্পফণা ঘটের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সেটিকে রোদে শুকিয়ে ভাটিতে পোড়ানো হয়। এরপর খড়িমাটির প্রলেপ লাগিয়ে, সাপের ফণায় লাল ও কালো রঙ দিয়ে রাঙিয়ে তোলা হয়। ঘটের নিচের দিকে একজোড়া চোখ আঁকা হয়। এই ধরনের ঘটকে এক নাগ ঘট বলা হয়ে থাকে। আবার কখনো ঘটের সামনে ও দুই দিকে তিনটি নাগ ফণা যুক্ত করে এবং ঘটের একেবারে উপরিভাগে আলাদা করে আরো একটি ফণা বসিয়ে পুজো করা হয়। একে চার নাগ ঘট বলা হয়ে থাকে।

শিল্পী মাধব পাল

মূলত পূর্ববঙ্গের যশোহর জেলায় এই ঘটে মনসা পুজো করার প্রচলন রয়েছে। প্রতিবছর মনসা পুজো উপলক্ষে প্রায় ৬০০ মনসা ঘট তৈরি করে থাকেন তিনি। বিপুল এই কর্মযজ্ঞে স্ত্রী মায়া পাল তাকে সহায়তা করেন। শিল্পীর নিজের আদি নিবাস পূর্বভঙ্গের অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের যশোহরের মাগুরার শ্রীপুর গ্রামে। দেশভাগের স্মৃতি ছিন্নমূল হয়ে যাওয়ার বেদনা তাঁকে আজও দুঃখ দিয়ে যায়। দর্মার বেড়া, টিন, কিছুটা ইটের উপস্থিতি দিয়ে তৈরি করা ছোট বাড়িতে থাকেন শিল্পী। বৃষ্টি হলে কাদা জমে যায় বাড়ির ভেতর। সঙ্গে তীব্র গরম, তার মধ্যেই এই শিল্প তিনি টিকিয়ে রেখেছেন। তাঁর তৈরি মনসাঘটের সর্বোচ্চ উচ্চতা এক ফুট। সর্বনিম্ন উচ্চতা ছয় ইঞ্চি। বছরের অন্য সময় রুজি-রুটির জন্য ভিন রাজ্য ঝাড়খন্ডে পোড়ামাটির তৈরি লক্ষ্মী ভান্ডার ও খেলনা ফেরি করে থাকেন তিনি। শিল্পীর বক্তব্য, শরীর যতদিন সায় দেবে ততদিন যশোহর শৈলীর মনসাঘট কৃষ্ণনগরের বুকে তৈরি করে যাবেন।

আরও পড়ুন-

মেঘলা দিনের রথের মেলা আজও রঙিন মাটির পুতুলে

শ্রাবণ সংক্রান্তির মনসা পুজোর দু-দিন আগে থেকে পাটকাঠি কলোনী মোড়ে রাস্তার ওপরে নিজের তৈরি এই সকল নাগঘট নিয়ে তিনি বসেন। নাগ ঘট তৈরির পাশাপাশি মনসা পুজোর অন্যান্য উপকরণ যেমন, দুধ কলা দেওয়ার মাটির মালসাও তৈরি করেন তিনি। ওই একই জায়গায় শিল্পী মীরা পালও যশোহর শৈলী মনসা ঘট তৈরি করে থাকেন। যদিও তাঁর নির্মিত ঘট চাকে ঘোরানো নয়। তা পুরোপুরি ছাঁচে তৈরি। খড়িমাটির বদলে তিনি বাজার চলতি ডিস্টেম্পার রঙ ব্যবহার করে থাকেন। তাঁর তৈরি নাগ ঘটের তলার দিকটায় মা মনসার মুখের অবয়ব প্রস্ফুটিত হয়ে থাকে।

বাংলায় মা মনসার বিভিন্ন রূপের পুজো হয়ে থেকে সারা বছর ধরেই। তার মধ্যে যেমন প্রচলিত মাতৃকামূর্তি রয়েছে, তেমনই রয়েছে অষ্টনাগ, নয় নাগ, বিয়াল্লিশ নাগের পুজোর রীতি। পাশাপাশি, মা মনসাকে ঘটরূপে পুজো করার রীতিও রয়েছে। বাঙালির কাছে মা মনসা হয়ে উঠেছে উর্বরতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক। এখানে ঘট হয়ে উঠেছে গর্ভবতী রমণীর প্রতিবিম্ব। এ-প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষক বিধান বিশ্বাস জানিয়েছেন,

সারা বাংলায় উল্লেখযোগ্যভাবে তিন রকমের মনসা ঘটের প্রচলন দেখা যায়। বাঁকুড়ার মনসা ঘট, পূর্ববঙ্গের বরিশালের মনসা ঘট এবং যশোহরের মনসা ঘট। ঘটের মাথা ছাড়িয়ে উদ্যত ভঙ্গিতে সাপের ফণা মাথা তুলে দাঁড়ায় যশোরের ঘটে। এই ধরনের ঘটকে কৈতরি ঘট বলা হয়ে থাকে। জোড়া হিসেবে এই ঘটগুলোকে পুজো করা হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদিয়া জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এই রকম ঘটে পুজো করার প্রচলন দেখা যায়। শৈলী নিরিখে বাঁকুড়া এবং বরিশালের তুলনায় স্বতন্ত্র যশোহরের মনসার ঘট।

পুরাণ মতে, কাশ্যপ মুণির মন থেকে জন্ম হয়েছে মনসার। পরবর্তীতে মহাদেবের কাছে স্তব, পূজা, মন্ত্র শেখেন মনসা। সেই মনসাই বঙ্গ জীবনের অন্যতম ভিত্তি হয়ে আলোকিত। মঙ্গলকাব্য থেকে গ্রাম বাংলার প্রতিটি সংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মনসার নাম। সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষের সহায় হয়ে উঠেছেন মনসা। উচ্চবর্ণ সঙ্গে নিম্নবর্ণের বিরোধকালে সাক্ষী থেকেছেন মনসা। প্রাচীন বিশ্বের নরতাত্ত্বিক ধর্মের অন্যতম প্রতীক হচ্ছে সর্প পুজো। সেই আদিম পৃথিবীতে যখন নদী, সমুদ্র, গাছ, মাটি, আকাশের পুজো হত, তখন সাপেরও পূজা করার রীতি ছিল। কালের বিবর্তনে সে মনসা হয়ে উঠেছে। আদিমতার আদি দেবী হয়ে সে আজও পুজিত হয়ে চলেছে গ্রামবাংলায়। দেশভাগ, কাঁটাতার তার সাংস্কৃতিক পরম্পরা ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দিতে পারেনি। আর এখানেই মনসার ব্যাপ্তি শাশ্বত ও চিরন্তন হয়ে উঠেছে। মাধব পালের মতন শিল্পীরা কপালে পরিশ্রমের ঘাম ও মনে একরাশ দুঃখ নিয়ে পাদপ্রদীপ থেকে দূরে বিরাজ করেও মনসার নাগ ঘট নির্মাণ করে চলেছে।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা : লোকসংস্কৃতি গবেষক বিধান বিশ্বাস
গ্রন্থঋণ : 'বাংলার দেবদেবী ও পূজাপার্বণ', দেবাশীষ ভৌমিক
'বাংলার ইতিহাস', ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত

More Articles