কেবল রথের মেলাতেই কেন পাওয়া যায় মুর্শিদাবাদের এই মাটির পুতুল?
Clay Dolls of Murshidabad : হস্তশিল্প সংক্রান্ত কোনো সরকারি মেলায় অজয় কুমার চৌধুরীর তৈরি মাটির পুতুল দেখা যায় না। তিনি কেবলমাত্র নসিপুরের রথের মেলায় বসেন।
মুর্শিদাবাদ শহরের মোগলটুলিতে বাংলার মাটির তৈরি পুতুলের শিল্পকে ধরে রেখেছেন অজয় কুমার চৌধুরী। প্রতি বছর রথযাত্রার এক মাস আগে থেকে পুতুল তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। প্রায় পঞ্চাশরকম মাটির পুতুল তৈরি করে থাকেন বরিষ্ঠ এই শিল্পী। প্রচারের আলো থেকে শতহস্ত দূরে থেকেও নিষ্ঠা সহকারে শিশুমনকে আনন্দ দেওয়ার জন্য এক খোল ছাঁচের পোড়ামাটির রঙিন পুতুল তৈরি করে থাকেন তিনি।
আরও পড়ুন-
ডাইনোসরের মুখে সরলতার হাসি, বাংলার কোথায় তৈরি হয় ঝুলন যাত্রার পুতুল?
পুতুল-নির্মাণের ক্ষেত্রে এটেল ও বালিমাটি ব্যবহার করা হয়। শিল্পীর তৈরি কয়েকটি পুতুলের মধ্যে ইউরোপীয় শৈলীর ছোঁয়া বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। সিংহের সঙ্গে গ্লাডিয়েটরের যুদ্ধের দৃশ্যাবলী তাঁর পুতুলনির্মাণে উঠে এসেছে। যদিও অজয় কুমার চৌধুরী নির্দিষ্ট এই পুতুলকে শিকারের দৃশ্য হিসেবেই বর্ণনা করতে চেয়েছেন। তবুও শিকাররত পুরুষ-পুতুলের শারীরিক গঠন, পায়ের জুতো, পোশাক এবং হাতে-থাকা ঢাল, বর্শা স্পষ্টভাবে প্রাচীন রোমের অ্যাম্পি থিয়েটারের গ্লাডিয়েটরদের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

কামান-সহ সৈনিক
অন্যদিকে তোপের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার মধ্যে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় শৈলীর ছাপ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। মহিলার গায়ের রং এবং যুদ্ধের পোশাক সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। এমনও হতে পারে, পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর মুর্শিদাবাদ শহরে প্রবল ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার হতে থাকে, তারই ফলস্বরূপ ওখানকার মাটির পুতুলে এই পাশ্চাত্যের প্রভাব দেখা দিয়েছে।

তানপুরা হাতে গৃহিণী
অজয় কুমার চৌধুরীর তৈরি পুতুলের মধ্যে বাংলার মেয়েদের জীবনের সাংসারিক সংগ্রামও চিত্রিত হয়েছে। টিউকল থেকে জল তোলা, বটি দিয়ে মাছ কাটা, এসবই তাঁর পুতুল-ভাবনার মধ্যে খেলা করে যায়। অন্যদিকে অন্তঃপুরে থেকেও শিল্প ও সংগীতের প্রতি নারীর সাধনা শিল্পীর মনকে ছুঁয়ে গিয়েছে। আর সেই কারণে, পদ্মাসনে বসে একজন গৃহিণী তানপুরা বাজাচ্ছে, এই দৃশ্য তাঁর পুতুলের মধ্যে দেখাতে। ভল্লুকের খেলা দেখানো ব্যক্তি, বাদামবিক্রেতা, বেলুনবিক্রেতা, ঢাকি, নৌকার মাঝি, এই সমস্ত কিছু নিয়েই তাঁর পুতুলের সম্ভার। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, শিল্পীর তৈরি ঢাকিদের নৃত্যরত অবস্থায় দেখা যায়। ঢাক বাজানোর সময় ঢাকিরা অনেক সময় নেচে ওঠে। সেই নৃত্যরত ঢাকির দৃশ্য পুতুল নির্মাণে তুলে ধরেছেন শিল্পী। ঢাকির মাথায় পাগড়ি। আজকের দিনে পাগড়ি পরা ঢাকি রায় দেখা যায় না। তাঁর আরও একটি অভিনব পুতুলদৃশ্য হল দাড় টানা মাঝি এবং ডোমের পুতুল।
আরও পড়ুন-
ইন্দোনেশিয়ার পুতুলনাচ ‘ওয়ায়াং’-এর উৎস লুকিয়ে আছে ভারতেই?
আধুনিক সময় চিত্রের প্রভাবও রয়েছে শিল্পীর পুতুল নির্মাণের মধ্যে। ফটোগ্রাফার, ফুটবল খেলোয়াড়, ট্রাফিক পুলিশ, মিলিটারি ইত্যাদি পুতুলের মধ্যে সেই আধুনিকতার স্পর্শ অনুভব করা যায়। ভারত বনাম পাকিস্তানের সামরিক দ্বৈরথ শিল্পীর পুতুল নির্মাণে প্রভাব ফেলেছে। বিশাল একটা মাটির তৈরি কামানের পেছনে জলপাই রংয়ের উর্দি পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরুষ সৈনিক। শিল্পীর কথায় কার্গিল যুদ্ধের সময় এই ধরনের পুতুলটি তৈরি করা হয়। নব্বইয়ের দশকে কোনো পর্যটনস্থলে গেলে গলার মধ্যে ক্যামেরা ঝুলিয়ে থাকা ফটোগ্রাফারদের দেখা মিলত। অল্প টাকার বিনিময় তাঁরা পর্যটকদের ছবি তুলে দিতেন। যদিও বিক্ষিপ্তভাবে আজও এঁদের দেখা মেলে। সেই ফটোগ্রাফাররাও জীবন্ত ভঙ্গিমায় উঠে এসেছেন শিল্পীর পুতুলগুলিতে।

শিল্পী অজয় কুমার চৌধুরী
হস্তশিল্প সংক্রান্ত কোনো সরকারি মেলায় অজয় কুমার চৌধুরীর তৈরি মাটির পুতুল দেখা যায় না। তিনি কেবলমাত্র নসিপুরের রথের মেলায় বসেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাঁর থেকে মাটির পুতুল বিভিন্ন উপলক্ষে নিয়ে যায়। ছাঁচের দেবপ্রতিমা বিক্রিই শিল্পীর মূলত তাঁর প্রধান উপার্জন । তাঁর দুই ভাই কিশোর ও অশোক কুমার চৌধুরীও মাটির পুতুল তৈরি করেন। আজকে মুর্শিদাবাদ জেলার প্রসঙ্গ উঠলেই শোলার হস্তশিল্প, পাটের পুতুলের কথা সবার মনে আসে। কিন্তু রঙিন ছাঁচের পুতুল প্রায় ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে। মুর্শিদাবাদের পর্যটনস্থলগুলির সামনে সরকারি উদ্যোগে এই ধরনের পুতুল যদি রাখা যেত তাহলে এই সকল প্রান্তিক শ্রেণির শিল্পীরা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান, পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য দুই-ই পেতেন।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ
শিক্ষাবিদ মঞ্জিরা সেন

Whatsapp
