প্রথম মুদ্রিত বাংলা বই কেন রোমান অক্ষরে ছেপেছিলেন পর্তুগিজরা?

Portuguese in West Bengal : বাংলা ভাষার ভেতর বেশ কিছু পর্তুগিজ শব্দের চল রয়েছে, এ-কথা অনেকেই হয়তো জানেন না। আলমারি, চাবি, আলপিন, ফিরিঙ্গি, বারান্দা ইত্যাদি সবই পর্তুগিজ ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে।

MT

পৃথিবীতে এমন কোনও ভাষা নেই যেখানে একটি ভাষার মধ্যে অন্য ভাষার শব্দ প্রবেশ করেনি। বাংলা ভাষাতেও অজস্র বিদেশি শব্দের ব্যবহার করা হয়। এক সময় বাংলায় বাণিজ্যের কারণে ইউরোপীয় বণিকরা যাতায়াত করত। পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, ব্রিটিশদের সংস্কৃতি ক্রমেই প্রবেশ করেছে বাংলার সংস্কৃতিতে।

পর্তুগিজরা প্রথম বাংলায় আসে ১৫১৭ সালে। গঙ্গার পশ্চিম দিকে হুগলিতে তারা নিজদের বাণিজ্যকেন্দ্র গড়েছিল। শুধু যে ছানা আর চিজ তৈরির কায়েদা তাদের থেকে বাংলার সংস্কৃতিতে এসেছে, এমনটা নয়। আরও অনেক উপাদানই তাদের কাছ থেকে বাংলায় প্রবেশ করেছে। তার মধ্যে প্রধান হল বিদেশি শব্দ। যেমন, বাংলা ভাষার ভেতর বেশ কিছু পর্তুগিজ শব্দের চল রয়েছে, এ-কথা অনেকেই হয়তো জানেন না। আলমারি, চাবি, আলপিন, ফিরিঙ্গি, বারান্দা ইত্যাদি সবই পর্তুগিজ ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে।

আরও পড়ুন-

বাংলায় আজও বসে শতাব্দী প্রাচীন কুম্ভমেলা।। কেমন তার আকার-প্রকার?

বাংলা সাহিত্যে প্রথম ব্যাকরণ ছাপা হয় ইউরোপীয়দের হাত ধরে। আঠারো শতকে বাংলার ব্যস্ত দুটি বন্দর ছিল চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রাম। হুগলি-র সপ্তগ্রাম ছিল তখনকার বাংলার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। ইতিহাসবিদ জাও-ডি-ব্যারোস ও হেজেসের ভ্রমণকাহিনি থেকে জানা যায় যে, সেই সময় বড়-বড় জাহাজ হাওড়ার বেতড় পর্যন্ত আসত। তারপর ছোট-ছোট জলযানে করে বিভিন্ন পণ্য বণিকেরা হুগলি নদীর ধারে সপ্তগ্রামে নিয়ে আসতেন। চালান করা হত সুতির কাপড়, মসলিন, মশলা প্রভৃতি পণ্য। পর্তুগিজরা বেতড়কে বলতেন 'বাটার'। হুগলিকে বলতেন 'ওগুলি'। পর্তুগিজ বণিকেরা চট্টগ্রামকে বলতেন বড় স্বর্গ বা 'পোর্ট-গ্রান্ডী'। সপ্তগ্রামকে বলতেন ছোট স্বর্গ বা 'পোর্ট পিকানো'। ক্রমেই, বণিক থেকে তারা হয়ে উঠেছিল জলদস্যু। বাংলার একাধিক জায়গায় তারা ক্যারাভেলে করে আক্রমণ চালাত। সকলেই জানেন হয়তো, মোঘলদের সঙ্গেও পর্তুগিজদের যুদ্ধ হয়েছিল।

টেরাকোটা শিল্পে পর্তুগিজ বণিকদের জাহাজ

ভারতের গোয়াতে পর্তুগিজরা প্রথম ছাপাখানা চালু করে, যা মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বাংলা সাহিত্যে প্রথম ব্যাকরণ বইটি তারাই প্রথম ছেপে প্রকাশ করে। উপনিবেশবাদ অনুযায়ী, যারা ক্ষমতাবান তারা চিরকালই দমিত মানুষদের জানবার চেষ্টা করেছে, তাদের রীতিনীতি শেখবার আগ্রহ দেখিয়েছে, নিজেদেরই প্রয়োজনে। উপমহাদেশে পর্তুগিজরা প্রথম ছাপাখানা খুলেছিল মুঘল যুগে, সম্রাট আকবরের আমলে। পর্তুগিজ মিশনারিরাই প্রথম বাংলা ভাষায় মুদ্রিত গ্রন্থ রচনা করেন, এটি ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তবে, বইটি ছাপা হয়েছিল বাংলায় নয় রোমান অক্ষরে।

আরও পড়ুন-

বিসমিল্লাহ বলে শুরু রান্না! বিরিয়ানিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন নবাবের এই বংশধর

পর্তুগিজদের দ্বারা প্রথম মুদ্রিত বাংলা গ্রন্থ হল 'কৃপার শাস্ত্রের অর্থবেদ'। এরপর খ্রীষ্ট ধর্ম বিষয়ক লেখা, সংবাদ, ব্যাকরণ ও অভিধান নিয়ে আরও তিনটি বই পর্তুগাল শহর থেকে ছেপে বের হয়। প্রথম বইটি রচনা শুরু হয় ১৭৩৪ সালে। এবং বইটির প্রকাশকাল ১৭৪৩ সাল। যা বাংলা গদ্য-ইতিহাসের এক প্রাচীন নিদর্শন। বইটি রচনা করেন ম্যানুয়েল দা আস্‌সুম্পসাঁউ। এর অনেক বছর পরে পঞ্চানন কর্মকার বাংলা ও সংস্কৃত হরফের ছাঁচ নির্মাণ করলে হ্যালহেড বা হালেদ সাহেবের বাংলা বইটি মুদ্রিত হয়। 

More Articles