নবদ্বীপের বৈষ্ণব মন্দিরে কীভাবে পালিত হয় জন্মাষ্টমীর উৎসব?
Janmashtami in Nabadwip : বৈষ্ণব-শাক্ত নির্বিশেষে শ্রীকৃষ্ণ সকলের আরাধ্য হওয়ায় মন্দির ছাড়াও অনেক মানুষের ঘরে গোপাল বা শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব পালনের ঘটনা সংখ্যায় অনেক বেড়েছে।
নন্দ সুনন্দ, যশোমতী রোহিণী, আনন্দ করত বাধাই।
গোকুলনগর, লোকসব হরষিত, নন্দ-মহল চলু ধাই ।।
গোরোচনা জিনি, গোরী সুনাগরী, নব নব রঙ্গিনী সাথে।
নন্দসুত সবে, হেরইতে আনন্দে, লোক চলত পথ মাঝে।।
জন্মাষ্টমীর ভোরে ঘুম ভাঙত বাবার গাওয়া এমনই এক কীর্তন গানের সুর শুনে। মায়ের যত্নে সেজে উঠত বাড়ির গিরিধারী, গোপাল। ঝলমলে সিংহাসন এই দিনটাকে অন্যদিনের থেকে আলাদা করে দিত ভোরবেলাতেই। সারাদিন পাঠ কীর্তনসহ অনেক ব্যাপার থাকলেও আমাদের মতো ছোটোদের মন পড়ে থাকত নানারকম ভোগ আর একেবারে স্পেশাল তালের বড়ার দিকে। জন্মাষ্টমীর সঙ্গে তালের বড়ার বিশেষ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তা স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও, এই তিথি যে আসতে চলেছে— অতীতের মতো আজও তার আগামবার্তা পাওয়া যায় বাজারে তালের উপস্থিতি দেখে।
বৃন্দাবন যেমন বৃন্দাবনচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণের, নবদ্বীপ তেমনই নবদ্বীপচন্দ্র শ্রীগৌরাঙ্গের। এখানে তাঁর জন্মদিনই উৎসবের চেহারা নেয়। তবে ভক্তের বিশ্বাসে কৃষ্ণই তো এসেছিলেন নবদ্বীপের মাটিতে, বৃন্দাবনলীলার অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করতে। তাঁর অনুপস্থিতিতে বিরহতাপে শ্রীরাধার অন্তরের যে জ্বালা, তাকে উপলব্ধি করতে। তিনি তো রাধাভাবে জর্জরিত শ্রীকৃষ্ণই। বৈষ্ণব মন্দিরে তাই প্রাণের দেবতার অভিষেকের মঙ্গলঘট সাজিয়ে রাখার কাজে কোনোরকম ত্রুটি থাকবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।

ধামেশ্বর মন্দিরের বিগ্রহ
জন্মাষ্টমীকে কেন্দ্র করে এ-শহরে ভক্তজনের আবেগ অতীত থেকে চলে এলেও মানুষের আনাগোনা বেড়েছে অনেক। নিয়মিত মন্দির যাতায়াতে যোগ দিয়েছেন অনেক কম বয়সের মানুষ। এই স্রোতের মাঝে ভগবৎ প্রেমের মাত্রা কতখানি, তা নির্ণয় করা সাধকের কাজ— তবে, এটুকু মানতে হয় যে, পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বাইরের দর্শনার্থী যত আসেন, তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মন্দিরমুখী স্থানীয় মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে দিনে-দিনে। জন্মাষ্টমীতেও তার ব্যতিক্রম হয় না। বিগ্রহের সাজসজ্জা, মন্দিরের পরিবেশ, পাঠ-কীর্তন, আরতিদর্শন— সব মিলে এক আপাত প্রশান্তির পরিবেশ হয়তো সমস্যাজর্জরিত অশান্ত মনের মানুষকে বেশি করে টেনে আনছে।
আরও পড়ুন-
শেষদিন পর্যন্ত সঙ্গে ছিল শ্রীচৈতন্যের প্রিয় সখাদল
১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনী পূর্ণিমায় প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে নতুন পোশাকে সেজে ওঠে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি ও শ্রীগৌরাঙ্গের বিগ্রহ। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান অনুসন্ধান নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও এখনও পর্যন্ত প্রাচীন মায়াপুর অঞ্চলের এই মন্দিরই নবদ্বীপবাসীর কাছে ‘জন্মস্থান মন্দির’।

অনুমহাপ্রভু মন্দিরের বিগ্রহ
অন্যদিকে রয়েছে মহাপ্রভুপাড়ার ধামেশ্বর মহাপ্রভুর মন্দির, যেখানে চৈতন্যদেবের দারুময় বিগ্রহ রাজবেশে দাঁড়িয়ে আছে। ভক্তজন এসে দু-চোখ ভরে দেখে যান তাঁদের নয়নের মণি গৌরকে। সারাদিনের পাঠ, কীর্তন, ভোগ, আরতির রাজকীয় ব্যবস্থা মন্দিরের পরিবেশকে অন্যরকম করে দেয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত এই মূর্তির রূপ সত্যিই লাবণ্যময়। নবদ্বীপের মাটির সন্তান শ্রীচৈতন্য যেমন ‘ভূমিপুত্র’ হিসেবে সকলের আপনজন, তেমনই বিষ্ণুপ্রিয়ার পিতৃকুলের বংশধরদের দ্বারা তাঁর সেবাকাজ পরিচালিত হয় বলে তিনি তাঁদের জামাইও বটে। জ্ঞান-বিচারহীন আবেগাকুল বিশ্বাসে ভক্তজন তাঁদের ‘নদের নিমাই’-কে শ্রীকৃষ্ণের অবতার হিসেবে দেখেন বলেই জন্মাষ্টমী আরও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে।
আর এক মন্দিরেও জন্মাষ্টমী পালনের প্রস্তুতি চলে আর সব মন্দিরের মতোই। নবদ্বীপের দক্ষিণপ্রান্তে মণিপুর নামক অঞ্চলে মণিপুররাজ রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নিজের ও মেয়ে বিম্বাবতীর আরাধ্য দেবতা অনু মহাপ্রভুর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তাঁর ছেলে চৌরজিৎ এখানেই মন্দির নির্মাণ করান। রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র যখন নবদ্বীপে আসেন, তখন প্রকাশ্যে চৈতন্য বিগ্রহের পুজার্চনা নিষিদ্ধ ছিল। মণিপুররাজের চেষ্টাতেই গৌরাঙ্গ মূর্তির প্রকাশ্য আরাধনা অনুমোদিত হয়।
আরও পড়ুন-
চৈতন্যর প্রিয় মিষ্টি, আজও রসকদম্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলার এই জেলা
প্রতিটি মন্দিরেই এই দিনে দেবতা সেজে ওঠেন নতুনভাবে। সারাদিন চলে বিশেষ পূজার্চনা, পাঠ, কীর্তন। মহাসমারোহে নানাবিধ ব্যঞ্জন এবং মিষ্টান্নসহ ভোগ নিবেদন করা হয় দেবতার উদ্দেশে। অসংখ্য ভক্তের উপস্থিতিতে সন্ধ্যারতি সম্পন্ন হয়। তারপর আসে সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত। রাত্রি বারোটায় অভিষেকের আয়োজন করা হয়। দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মধু ও গঙ্গাবারি— এই পাঁচ দ্রব্য সহযোগে স্নান করানো হয় দেবতাকে। মন্দিরে-মন্দিরে শালগ্রাম শিলা অথবা ছোটো আকারে শ্রীকৃষ্ণ বা গোপাল মূর্তিকে স্নান করিয়ে তাকে সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাটাই প্রথা। একইভাবে পাঠ, কীর্তন এবং ভোগ নিবেদনের মাধ্যমে পরদিন নন্দোৎসব পালনের মধ্য দিয়ে জন্মাষ্টমী পালনের সমাপ্তি ঘটে।
তবে মণিপুরের অনু মহাপ্রভুর মন্দির বা মণিপুরি যেসব পরিবার এই অঞ্চলে থাকেন তাঁরা, দেবতাকে দধি, দুগ্ধ ইত্যাদি সহযোগে স্নান করানো ছাড়াও তাঁদের রীতি অনুসারে আর একটি বস্তু প্রস্তুত করেন। মৌরি, ধনে, নারকল এবং কেউ-কেউ এসবের সঙ্গে গোলমরিচ গুঁড়ো করে মধু মিশিয়ে প্রসাদের মণ্ড তৈরি করে থাকেন, যার নাম ‘নাওথি’। স্নানজল বা চরণামৃত পানের পাশাপাশি ওই ‘নাওথি’ তাঁরা প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। সদ্যোজাত শিশুদেবতা শ্রীকৃষ্ণের শরীর থেকে নির্গত বস্তু হিসেবে এই ‘নাওথি’ গ্রহণ করা হয়।
যখন কৃষ্ণ জন্ম নিল দেবকী-উদরে।
মথুরাতে দেবগণ পুষ্পবৃষ্টি করে ।।
বসুদেব রাখি আইল নন্দের মন্দিরে।
নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে-দিনে বাড়ে।।
শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর-শত নামে এরপর থেকে নামের বর্ণনা শুরু হয়। বর্ণনায় ‘কৃষ্ণ’ যেমন ‘দিনে-দিনে বাড়ে’, জন্মাষ্টমী পালনেও দিনে-দিনে কিছু পরিবর্তন এসেছে। সাধারণভাবে আপামর মানুষের সঙ্গে এই তিথি পালনের সরাসরি সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, প্রত্যেকেই এই তিথির অস্তিত্ব টের পান বাজারের ফুল, ফল, সবজি বা মিষ্টির মূল্যবৃদ্ধিতে।
বৈষ্ণব-শাক্ত নির্বিশেষে শ্রীকৃষ্ণ সকলের আরাধ্য হওয়ায় মন্দির ছাড়াও অনেক মানুষের ঘরে গোপাল বা শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব পালনের ঘটনা সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। গোপালের জনপ্রিয়তা, এর অন্যতম একটা কারণ হতে পারে বলে ধরা যেতে পারে। গোপাল এখন মানুষের ভ্রমণসঙ্গী হয়েছেন, সেটা সমাজমাধ্যম লক্ষ্য করলেই জানা যায়। প্রাচীন মানুষের তুলনায় সময়, শারীরিক সামর্থ্য বা ইচ্ছা— যে-কোনো বিষয়ের ঘাটতির কারণে দোকানে-দোকানে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে মালপোয়া বা তালের বড়া বিক্রির চল হয়েছে এবং এর পরিমাণ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। কৃষ্ণ বা গোপালের জন্মদিন পালনের বিভিন্ন ধরনের ছবির দেখা মিলবে সমাজ মাধ্যমেও। তাতে ক্যাডবেরি, চকোলেটের উপস্থিতিও নজর এড়ায় না। এক-কথায়, আমাদের জীবনে যাপনের মাত্রা কমেছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু উদযাপনের মাত্রা বহুলাংশে বেড়েছে, এটা বুঝে নিতে কোনো অসুবিধেই হয় না।

Whatsapp
