ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই কীভাবে গড়ে উঠেছিল এই অজানা সভ্যতা?
Old Civilization in Pompeii : ভিসুভিয়াসের সেই ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতে পম্পেই-এর মোট জনসংখ্যার ১৫-২০ শতাংশ মারা গিয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছিল আগ্নেয়গিরির বিষাক্ত গ্যাস, ছাই থেকে সৃষ্ট থার্মাল শকে।
প্রায় দু-হাজার বছর ধরে বিশ্ববাসীর কাছে পম্পেই শহর পরিচিতি ছিল ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির বিধ্বংসী অগ্ন্যুৎপাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া এক অভিশপ্ত নগর রূপেই। ৭৯ খ্রিস্টাব্দে আগ্নেয়গিরির লাভা আর ছাইয়ের তলায় চাপা পড়ে যায় ২০,০০০ মানুষের এই প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদ। এতদিন ধারণা করা হত, এই বিপর্যয়ের পর সেখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এক অবিশ্বাস্য সত্যকে সামনে এনেছে। জানা যাচ্ছে, ধ্বংসের পরেও পম্পেই পুরোপুরি জনশূন্য হয়ে যায়নি। বরং, বেঁচে যাওয়া একদল মানুষ ফিরে এসেছিলেন সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে।
পম্পেই প্রত্নতাত্ত্বিক পার্কের ডিরেক্টর গ্যাব্রিয়েল জুখট্রিগেলের নেতৃত্বে পরিচালিত নতুন গবেষণাকাজ এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে। গ্যাব্রিয়েল জানিয়েছেন,
আমাদের নতুন খননকার্যের ফলে ছবিটি এখন অনেক স্পষ্ট। ৭৯ খ্রিস্টাব্দের পরের পম্পেই কোনো শহর ছিল না, বরং ছিল এক অনিশ্চিত এবং ধূসর বসতি। অনেকটা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে গড়ে ওঠা এক অদ্ভুত বস্তি বা শিবিরের মতো।
অর্থাৎ, যে পম্পেই একদিন রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম বিলাসবহুল এবং প্রাণচঞ্চল কেন্দ্র ছিল, ভিসুভিয়াসের তাণ্ডবের পর তা পরিণত হয়েছিল এক অস্থায়ী আশ্রয়স্থলে।
আরও পড়ুন-
হাজার বছর পুরনো কাপিসনিক সভ্যতার নতুন ইতিহাস প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কীভাবে খুঁজে পেলেন?
গবেষকরা বলছেন, অগ্ন্যুৎপাতের পর যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল, তাদের সকলের অন্যত্র চলে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। জীবনধারণের তাগিদে এবং ধ্বংসস্তূপ থেকে মূল্যবান সামগ্রী পুনরুদ্ধারের আশায় একদল মানুষ ফিরে আসতে বাধ্য হয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় কিছু বহিরাগতও, যারা তখন মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছিল।

পম্পেই নগরী
খননকার্যে দেখা গেছে, মানুষগুলি ছাইয়ের স্তূপের উপরে থাকা বাড়িগুলির ওপরের তলাতে বসবাস শুরু করে। যে বাড়িগুলির নিচতলা ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল, সেগুলিকে তারা ভাঁড়ার ঘরে রূপান্তরিত করে নেয়। এই সব জায়গা থেকে গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন রুটি তৈরির উনুন, শস্য পেষাইয়ের কল প্রভৃতি। এ-তথ্য প্রমাণ করে, তারা কেবল আশ্রয়ই নেয়নি, বরং সেখানে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাত্রা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। এই বসতিতে কোনো পরিকল্পিত রাস্তা, জলনিকাশি ব্যবস্থা বা রোমান শহরের প্রশাসনিক পরিকাঠামো ছিল না। এটি ছিল কেবল টিকে থাকার এক মরিয়া লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। গবেষকদের মতে, এই ছোট এবং দুর্বল সম্প্রদায়টি প্রায় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল। এরপর 'পোলেনা অগ্ন্যুৎপাত' নামে আরেকটি অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনায় সম্ভবত এই অঞ্চলটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।

ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি
প্রশ্ন হল, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইতিহাস-খোঁজ কেন এতদিন প্রত্নতাত্ত্বিকদের নজর এড়িয়ে গেল? ডিরেক্টর জুখট্রিগেলের মতে, এর কারণ খনন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা। আগেকার প্রত্নতাত্ত্বিকরা মূলত পম্পেই-এর বিখ্যাত ফ্রেস্কো, মূর্তি এবং অক্ষত বাড়িগুলি উদ্ধারের দিকেই বেশি মনোযোগ দিতেন। ফলে, পুনরায় বসতি স্থাপনের এই সূক্ষ্ম চিহ্নগুলি—যেমন মাটির পাত্রের টুকরো বা অস্থায়ী উনুন—তাঁদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। অনেক ক্ষেত্রে, এই প্রমাণগুলি পরবর্তী খননকার্যের সময় না বুঝেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল এবং তার কোনো নথিও রাখা হয়নি।
আরও পড়ুন-
নদী-উপত্যকায় ছিল প্রাচীন সভ্যতা? লালগ্রহের যে আশ্চর্য খোঁজ চমকে দিয়েছে বিজ্ঞানীদের
ভিসুভিয়াসের সেই ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতে পম্পেই-এর মোট জনসংখ্যার ১৫-২০ শতাংশ মারা গিয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছিল আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস এবং ছাইয়ের কারণে সৃষ্ট থার্মাল শকে। আজ সেই অভিশপ্ত নগরী ইতালির দ্বিতীয় জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, যা প্রতি বছর লক্ষ-লক্ষ পর্যটককে আকর্ষণ করে। কিন্তু এখন থেকে পর্যটকরা কেবল ধ্বংসের কাহিনি নয়, বরং তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা মানব সভ্যতার এক অবিশ্বাস্য সহনশীলতার গল্পও জানতে পারবেন। এই নতুন আবিষ্কার প্রমাণ করে দিল, প্রকৃতির চরমতম আঘাতের পরেও মানুষ কীভাবে ধ্বংসের মধ্যে থেকেই জীবনের নতুন অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারে।

Whatsapp
