সাংস্কৃতিক নির্জনতা কি শুধুমাত্রই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদেরই?
Anglo Indian Culture: অনেক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ক্ষেত্রে অসুবিধা এই যে, তারা অনেকেই পরিচিত নন বাঙালি অনুষ্ঠান-সাহিত্য-নিয়মরীতি বা ধর্মের সঙ্গে।
নিঃসঙ্গতা। আমাদের সময়ে চলতে গিয়ে প্রায় সর্বক্ষেত্রের মানুষের একক অথবা সামাজিক সমস্যা নিঃসঙ্গতা। কেউ কাজের জায়গায় নিঃসঙ্গ, কেউ অন্তরে-অন্দরে, কেউ বা আবার ভাবনায়। এক বিশাল নৈর্ব্যক্তিক সম্পর্কের সারিতে কেউ তার পোশাকের জন্য বিচ্ছিন্ন, কেউ বা খাদ্যাভ্যাসের কারণে, কেউ আবার তার সামগ্রিক জীবনধারণের জন্যই আশেপাশের মানুষদের থেকে আলাদা। এই বিচ্ছিন্নতা আসলে কী? কে-ই বা কাকে করছে বিচ্ছিন্ন? এইখানেই খেলা সংখ্যার গুরুত্বের। কীরকম?
আজকের বাজারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বলুন বা গম্ভীর রাজনৈতিক সভা- একটা কথা প্রায়ই উঠে আসতে দেখি। ‘সংখ্যালঘু’ বা ‘প্রান্তিক’ অবস্থানের মানুষ। তাদের নিয়ে চর্যা হয়, প্রকল্প আনেন বুদ্ধিজীবিরা, সংবিধানে আইন-কানুন আসে। এই অন্যরকম মানুষের লড়াই সেই কবে থেকেই চলছে। ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণ- এই সবেতেই আসছেন ‘সংখ্যালঘু’ বা ‘প্রান্তিক’-রা। আধুনিক গানবাজনায়, স্লোগানিংয়ে উঠে আসছে ‘বিকল্প’। এই ‘বিকল্প’ কথাটা বেশ চটকদার। বিকল্পের অনুস্থাপনায় আলোচনার ‘অন্যরকম’ মাত্রা বাড়ার সুযোগ বেশি। এবার প্রশ্ন এই যে, এই বিকল্পের নির্মাণকর্তা কে?
আবার, একজন মানুষ ‘প্রান্তিক’ হয় কীসে? পেশায়, চামড়ার রঙে, সংখ্যালঘুত্বে, কথা বলার অভ্যাসে নাকি ভাবনায়? কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জীবনের সধারণ পরিচয় নিয়ে আমরা এরমধ্যেই কথা বলেছি। এবার বলব তাদের সামাজিক দূরত্ব বা সামাজিক নির্জনতা নিয়ে। আগেই দেখেছি, ছোটবেলা থেকেই স্কুল বা বৃহত্তর সামাজিক গোষ্ঠীতে মেলামেশার মাধ্যমেই তারা ভাবতে শিখে যায় যে, তারা ‘অন্যরকম’। মেট্রোপলিটন মনে ‘হেটেরো’ রঙ থাকলেও তার সহজাত আরামবোধ মনে হয় এখনও ‘টাইপ’ নির্মাণেই। অপরের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছিন্নতা - এই টাইপের সঙ্গে নিজের মিল বা অমিলের সমানুপাতিক।
আরও পড়ুন- অ্যাংলো বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন ভাগ করা ছিল মানা…
রবার্ট এজরা পার্ক ‘ইউরেশিয়ান’ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বলেছেন ‘বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত মানুষ’। তবে এদের তিনি ‘বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়’ বলতে ভীষণ নারাজ। ‘বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়’ হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য চাই এক সামগ্রিক বিচ্ছিন্নতাবোধের ধারণা, যা একইরকমভাবে থাকবে সম্প্রদায়ের সকল মানুষের মধ্যেই। এই সমবেত বিচ্ছিন্নতার ধারণা থেকেই জন্ম নেয় একটি ‘বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী’। তাই পার্কের মতে, অ্যাংলোরা হলো ‘অসংগঠিত প্রান্তিক মানুষের সমষ্টি’। গবেষক এন্ড্রুজ (২০০৫) আবার তাঁর পিএইচডি থিসিসে কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ‘বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়’ বলে চিহ্নিত করেছেন। আসলে এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংস্কৃতি অঞ্চলভেদে এতটাই ভিন্ন-বিক্ষিপ্ত, ‘ভঙ্গপ্রবণ ও ক্ষণস্থায়ী’ যে, শ্রেণিচেতনা তৈরি হতে পারেনি তাদের মধ্যে। এরসঙ্গে পরিবর্তিত সমাজ ও মানসিকতার সঙ্গে ঘর করতে গিয়ে জমেছে খানিক আত্মজিজ্ঞাসাও। এর কারণ?
বিশ্বায়ন উত্তর সমাজে ‘শ্রেণি সচেতনতা’ একটি সচল ও নমনীয় ধারণা। শ্রেণি সচেতনতা পোক্ত হয় সামাজিক বা লৌকিক আদান-প্রদানে। ধরা যাক, ঔপনিবেশিক সময় থেকেই। ব্রিটিশ পরিদর্শকরা কোনওদিনই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ভালো চোখে দেখেনি। এর প্রমাণ তাদের তৈরি করা নীতিই। ১৮০০ শতকে ‘কিঞ্চিৎ সাদা চামড়া’-র অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ‘ওদেশে’ নিয়ে যাওয়ার নিয়ম থাকলেও তা নিষিদ্ধ ছিল ‘বাদামি’-দের জন্য। আবার সেই শতকের একেবারে শেষের দিকে সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ হয় ব্রিটিশদের সঙ্গে অ্যাংলোদের বিবাহও। একটা সময় থেকে ব্রিটিশরা তাদের স্বল্পবিস্তর ‘নেটিভ সম্প্রদায়’ বলেই চিহ্নিত করতে শুরু করে। কারণ তাদের মধ্যে “...একজন ব্রিটিশম্যানের মতো দৃঢ় ‘মোরাল ফাইবার’-এর অভাব ছিল”।
অথচ অ্যাংলোরা কিন্তু বেশ কিছুটা সময় ধরে আঁকড়ে ধরে থেকেছিল ব্রিটিশ সংস্কৃতি ও জীবনধারণকেই। তাদের কাছে ব্রিটিশরা ছিল সৎ, কর্মনিষ্ঠ এবং কর্তব্যপরায়ণ। পুরনো অ্যাংলোরা তাই আজও বজায় রেখেছে ইওরোপিয় পোশাক, ভাষা ও খাদ্যাভ্যাস। তার একটা কারণ যদিও সমাজে তাদের-প্রান্তিক অবস্থান। গ্রেসের কাছে জানতে পারি, আগেকার অ্যাংলো মানুষদের বাংলা বা আঞ্চলিক ভাষা শেখার অনাগ্রহের কারণ হলো এই ভাষাগুলিতে কথা বলত সাহেবদের ‘আয়া, মালী বা পরিচারক’-রা। সুকুমার রায় এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কর্মীর অবস্থা দেখিয়েছেন একটি ‘হাইব্রিড গরুর’ মাধ্যমে। তার আচরণ কিছুতেই সামঞ্জস্যে আসে না তার অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে। তার সবকিছুই যেন অন্যভাবে করা চাই।
তাদের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হওয়ার সময় গ্রেস একদিন বলেছিলেন, “বাঙালি বস একটু বেশি ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন মারওয়াড়ি বসের থেকে কিন্তু তার মধ্যেও ছিল না সাধারণ ‘হ্যালো’ বলার সৌজন্যবোধ”। একটা সময় পর্যন্ত ‘ভদ্রমহিলা’-দের সঙ্গে অ্যাংলো মহিলাদের দেখা হতো শুধুই অফিসে, ক্লাব বা দাওয়াতে। তাদের কখনই দেখাসাক্ষাৎ হতো না গৃহাভ্যন্তরে বা পাড়ায় বেড়াতে বেরিয়ে। একটি তথ্য থেকে এও জানা যায়, হিন্দু বাড়িতে কোনওরকম গৃহসহায়তামূলক কাজে ঢুকতে পারতেন না অ্যাংলো মহিলারা কারণ তাদের খাদ্যাভ্যাসে সাধারণত ‘বিফ’ থাকত।
এই বিষয়টা নিয়ে প্রথম প্রশ্ন করেছিলাম আমার বন্ধু ফেলিশিয়াকেই।
- “দেখো, এখন সময়টা হয়তো খানিকটা পাল্টেছে। আমার প্রতিবেশী বা আমার বন্ধুর বাবা-মায়েরা শুধু প্রশ্ন তুলেছে, আমার কোন জাত? কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে যখন দেখেছে আমি ‘খারাপ মেয়ে’ নই, স্কুলেও পড়াই, তখন মিশেও গেছে আমার সঙ্গে। কিন্তু মম একটা সাংস্কৃতিক বৈষম্য লক্ষ্য করেছে অনেক ছোটবেলা থেকেই। মমের বন্ধুর মা একবার গঙ্গাজল ছিটিয়ে বাড়ি শুদ্ধিকরণ করেছিলেন মম বেরিয়ে যাওয়ার পরে”। এইক্ষেত্রে যেন, অ্যাংলো পুরুষদের থেকে আরেকটু বেশি ছোঁয়া-ছানির ভয় অ্যাংলো মেয়েদের নিয়ে। তাদের চরিত্রের সঙ্গে যে বরাবরই এঁটে ছিল শরীরসর্বস্ব এক অস্তিত্ব, যৌনচিন্তা ও বহুগামিতার প্রতি আকর্ষণ। তাই-ই হয়তো পরের প্রজন্মের প্রকট প্রচেষ্টা এত বেশি করে ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার। তারা আত্তীকরণ করেছে ভারতীয় পোশাক। সঙ্গী নির্বাচন করেছে ভিন্ন ধর্মের আঞ্চলিক মানুষদের থেকে।
পার্ক দেখিয়েছেন, এই প্রান্তিক বা বিচ্ছিন্ন অবস্থান সংখ্যাতত্ত্ব বা গোষ্ঠীতত্ত্বে শুরু হলেও শেষ হয় একক মনস্তত্ত্বে। বিচ্ছিন্ন মানুষ হিসেবে তিনি দেখেছেন এক ‘অসুখী মানুষ’-কে। বিচ্ছিন্ন মানুষ এক নিরবিচ্ছিন্ন দ্বন্দ্বে থাকে। এই দ্বন্দ্ব শুরু হয় আশেপাশের সাংস্কৃতিক দৈন্য থেকেই। দু'টি ভিন্নমুখী সংস্কৃতি পাশাপাশি এলে হয়, ওই দুই সংস্কৃতির আত্তীকরণ হয়, না হলে কর্তৃত্ববাদী সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতি। একেই সংস্কৃতির সাম্রাজ্যবাদ হিসাবে দেখতে চেয়েছেন পার্ক। এর ফলাফল হিসাবেই অপর মানুষের মনে তৈরি হয় হীনম্মন্যতা ও এক বিস্তীর্ণ অসাড় নির্জনতা।
বলেইছি, সংস্কৃতিকে জানতে হলে সবথেকে বেশি প্রয়োজন আশেপাশের মানুষের সঙ্গে সামাজিক আদানপ্রদান ও মিথোষ্ক্রিয়া। পড়শিদের সম্পর্কে জানতে চাইলে, বেশ খানিকটা মিশ্র উত্তর পাওয়া গেছে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের থেকে। বেশিরভাগই বলেছেন তাদের পছন্দ নয়, তাদের বসবাসের অঞ্চল। তবে কেউ অভ্যস্ত পুরনো বাসস্থানের অভ্যাসে, কেউ বা বাড়ি বদলাতে চান না নতুনকে মেনে নেওয়ার ভয়ে।
“অপর মানুষকে জানা প্রয়োজন কি”? এ প্রশ্ন করেছিলাম তাদের অনেককেই।
বেশিরভাগ উত্তর থেকে উঠে আসে একটি তথ্য। হয় তারা মিশতে চান না। অথবা তাদের ক্ষেত্রে অসুবিধা এই যে, তারা অনেকেই পরিচিত নন বাঙালি অনুষ্ঠান-সাহিত্য-নিয়মরীতি বা ধর্মের সঙ্গে। জেনিফার একেবারেই বাংলা লিখতে বা বলতে পারে না। “...ছোটবেলায় বাংলা চ্যানেল চালালে টিভি বন্ধ করে দিতেন গ্র্যান্ডপা। তার মতে, বাঙালিরা উচ্ছৃঙ্খল। যারা খাবার খেয়ে প্লেটে হাত ধোয়, তাদের থেকে কিছুই শেখার নেই আমাদের”। গ্র্যান্ডপা ছিলেন পেশায় একজন সাংবাদিক।
আরও পড়ুন- ডার্ক লিপস্টিক, ছোট স্কার্ট! অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে মানেই যৌন উন্মাদনা?
অনেকে আবার বলেছেন, “বাঙালি হিন্দু বসতি অনেক বেশি উদারভাবাপন্ন মুসলিম জনবসতির অঞ্চলের থেকে”। আমি কথা বলেছিলাম পিকনিক গার্ডেনের কিছু বাঙালি মহিলাদের সঙ্গেও। মধ্যবয়সী বাঙালি মহিলারা অ্যাংলো-মহিলাদের বন্ধু হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুমতি নেই তাদের বাড়িতে ডাকার। শ্রীমতী রেখা মজুমদার বলেন, “নেস ভালো মেয়ে। ওর পোশাক ও কথা বলার ধরন যথেষ্ট মার্জিত কিন্তু আমার বাড়ির লোকের আপত্তির জন্য ওর সঙ্গে বরাবর বাইরে দেখা করি।” আরেকজন আবার বলেছেন, “ওদের হেঁসেল থেকে আসা খাবার বাদ দিয়ে আর কোনওকিছু নিয়েই আপত্তি নেই আমার বাড়ির লোকের”। অথচ অ্যাংলো মহিলারা নিজেই বলেছেন, তাদের রান্নাঘরে আধিপত্য এখন স্থানীয় সবজি-মান্ডির। তাহলে কেন এই বো-ব্যারাকের উপচে পড়া ভিড়, ক্রিসমাসের রেসিন কেক আর তাদের ঘরে বানানো ওয়াইনের জন্য? এই বৈষম্যের রেখা কি টেনেছি আমরা নিজেরাই?
একটি কর্তৃত্ববাদী সমাজে সংস্কৃতি উদ্বিগ্ন হওয়ার ভয়ে কি থাকে না সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষরাও? অবিমিশ্র সংস্কৃতি রক্ষার দায় তাহলে কার? রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠের নাকি প্রান্তিক সংখ্যালঘুর?
এই নিয়ে একটা প্রশ্ন করতেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল আমার বন্ধু জেসন।
-“কী অন্যরকম খুঁজছ তুমি? বিশ্বায়ন হয়ে যাওয়ার পরে কেউই আর আমরা বিশেষ ‘আলাদারকম’ নই। আমি বাংলা বা অ্যাংলো সংস্কৃতি দেখে পোশাক পরি না। পরি বিজ্ঞাপন দেখে। কাজেই যে সংস্কৃতি টিকে আছে, তা শুধুই বিজ্ঞাপনের সংস্কৃতি”।
-কী বলছ? অনেকেই এখন সচেতন তাদের জাতিগত পোশাক বা ভাষা নিয়ে।
-“এথনিক পোশাক আর ভাষাও আজকাল বিজ্ঞাপনজাত, ম্যাডাম। রাজনীতি তো বটেই”।
আসলে বিশ্বায়ন শুধু একজাতকরণই করেনি, সমস্ত মানবিক ও সাংস্কৃতিক গুণাবলীর মাপের জন্য ধরিয়ে দিয়েছে এক সাধারণ দাঁড়িপাল্লাও। এতে বিস্তার খানিক বেশি হওয়ার কথা ছিল, মিশ খাওয়ার কথা ছিল ভিন্নমুখী সংস্কৃতির কিন্তু তা না হয়ে আরও যেন সংকীর্ণ হয়ে এল সংস্কৃতির প্রকাশেরর গতিপথ। একদল নিশ্চুপে গুটিয়ে এল ভয়ে, অন্যদল দামামা বাজিয়ে, পতাকা উড়িয়ে চেপে বসল সংস্কৃতিরক্ষার রথে। তাহলে, এই অপরায়ণ বা সাংস্কৃতিক নির্জনতা কি শুধুমাত্রই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মানুষদের? নাকি আমাদের সবার, যারা নিরবিচ্ছিন্ন নির্মাণ করছি এক নিঃসঙ্গতা, নিজের এবং অপর মানুষদের জন্য।