হামাস হামলার দায়ে সরলেন ইজরায়েলের গোয়েন্দাপ্রধান, হারের ইঙ্গিত নাকি...

Iran-Israel Crisis: ফের ইজরায়েলে হামলা চালিয়ে বসল হিজবুল্লাহ। সোমবার রাতে ইজরায়েলের উত্তর দিক লক্ষ্য করে কাতিউশা রকেটের একটি ব্যারেজ নিক্ষেপ করে হিজবুল্লা। তাদের নিশানায় ছিল ইডরায়েলের একটি সেনা সদর দফতর।

যেমনটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেই পথেই এগোচ্ছে ইজরায়েল-ইরান সংঘাত। কখনও ইজরায়েলের আঘাত ফিরিয়ে দিতে হামলা করছে ইরান, কখনও সেই প্রত্যাঘাত ফিরিয়ে দিতে বড়সড় ছক কষছে ইজরায়েল। এই আঘাত-প্রত্যাঘাতের মধ্যে দিয়ে উত্তেজনায় জড়িয়ে গিয়েছে দুই দেশ। শুধু দুই দেশই নয়, ইরানের প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের জঙ্গিগোষ্ঠী হাউথি। যারা আবার ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসেরও বিশেষ ভাবে ঘনিষ্ঠ। কার্যত মাস ছয়েক ধরে গাজায় যে ধ্বংসলীলা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল, হামাসকে শেষ করতে চেষ্টার কসুর রাখেনি ইজরায়েলি সেনা। শুধু গাজায় নয়, একই সঙ্গে লেবানন সীমান্তেও মাস ছয়েক ধরে ফসফরাস হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল বলে অভিযোগ। কিছু দিন আগেই ইরানকে হামলার জবাব ফিরিয়ে দিয়েছে ইজরায়েল। তার মধ্যেই ইজারায়েলের উত্তরে হামলা চালায় হিজবুল্লাহরা।

ইরানের ইজরায়েল হামলার সপ্তাহ না ঘুরতে ঘুরতেই পাল্টা হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েল। তার পাল্টা হিসেবে ফের ইজরায়েলে হামলা চালিয়ে বসল হিজবুল্লাহ। সোমবার রাতে ইজরায়েলের উত্তর দিক লক্ষ্য করে কাতিউশা রকেটের একটি ব্যারেজ নিক্ষেপ করে হিজবুল্লা। তাদের নিশানায় ছিল ইডরায়েলের একটি সেনা সদর দফতর। হিজবুল্লাহের তরফে বিবৃতি দিয়ে এই হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে। তাদের দাবি, ডজন ডজন কাতিউশা রকেট ইজরায়েল লক্ষ্য করে পাঠানো হয়েছে। সাফেদের কাছে এইন জাতিম সম্প্রদায়ই ছিল হিজবুল্লাহদের প্রধান নিশানা। ইহুদিদের স্বাধীনতা উৎসব পাসওভার সেদার উপলক্ষে জমায়েত হয়েছিল সেখানে মানুষজনের। সে সময়েই হামলাটি চালানো হয়। লেবাননের সরকারি সংবাদ সংস্থা (এনএনএ) জানিয়ে দেয়, দক্ষিণ লেবাননের গ্রামের ইজরায়েলি অনুপ্রবেশের উত্তর দেওয়ার জন্যই সোমবারের হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। 

এত সব কিছুর মধ্যেই আবার ইস্তফা দিলেন ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল অ্যহরন হালিভার। ইস্তফার কারণ হিসেবে নিজের ব্যর্থতার কথাই তুলে ধরেছেন মেজর। ৭ অক্টোবর হামাস ইজরায়েলে ঢুকে যে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছিল, তার দায় নিজের এবং নিজের দফতরের কাঁধে নিয়েছেন অ্যাহরন। তার দাবি, তাঁর বিফলতাই ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। তবে এই পদত্যাগকে ভালো চোখে দেখছে না বিশেষজ্ঞমহল। অ্যাহরনের ইস্তফার নেপথ্যে রয়েছে কোন কারণ? উঠেছে প্রশ্ন। 

আরও পড়ুন: গাজার পর লেবাননেও ‘মারণ’ ফসফরাস হামলা! যে ভয়ঙ্কর অভিযোগ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে

ইজরায়েলে হামলার পর পরই সতর্কতা জারি করে ইরান বলেছিল, ইজরায়েল যদি পাল্টা হামলার পথে না যায়, তাহলে ইরানও যুদ্ধের পথ থেকে সরে যাবে। কিন্তু ইরানের সতর্কতা হাওয়ায় উড়িয়ে ফের হামলা ফেরানোর পথেই হাঁটে ইজরায়েল। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু কার্যত পরিষ্কার করেই বলে দিয়েছিল, দেশের দুর্বলতা প্রকাশিত হয়, এমন কোনও কাজ তারা করবে না। বরং নিজের দেশকে রক্ষা করতে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেবে ইজরায়েল। ইজরায়েলের ছোট হামলার উত্তর দিতেও যে পিছু হঠবে না ইরান, তা-ও পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছিল তেহরানের তরফে।

হিজবুল্লাহদের একের পর এক হামলা যে টলাতে পারেনি ইজরায়েলকে, তা মঙ্গলবার পাল্টা হামলা চালিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে নেতানিয়াহু সরকার। হিজবুল্লাহর ছোড়া রকেটের উৎস বুঝে উঠেই পাল্টা হামলা চালাতে থাকে ইজরায়েলি সেনা। লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাত যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও। সংবাদ সংস্থা এএফপি-র পরিসংখ্যান বলছে, লেবাননে অন্তত ৭০ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে সাম্প্রতিক এই হামলায়। অন্তত ৩৭৬ জন হিজবুল্লা কম্যান্ডারের মৃত্যু হয়েছে। ইজরায়েলের পক্ষে ক্ষতি কম হলেও, একেবারে হয়নি তা নয়। অন্তত ১০ জন ইজরায়েলি সেনা ও আট জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এই হামলা-পাল্টা হামলায়।

এই যুদ্ধ যে একা হিজবুল্লাহ-র নয়, তা কার্যত গোড়া থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছে ইরান। প্রথম থেকেই হিজবুল্লাহকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে তেহরান। আর ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা যেভাবে বাড়ছে, তাতে তেহরান সাফ জানিয়েছে, ইজরায়েলের আর একটিও ভুল ইরানকে আরও কঠোর ও ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নেওয়ার দিকে ঠেলে দেবে। কিছুদিন আগেই ইরানের ইস্ফাহান শহরে যে হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েল, সেই হামলাক কড়া নিন্দা করেছে তেহরান। বিষয়টিকে বিদ্বেষমূলক বলে কটাক্ষও করে তারা।

এদিকে নিয়ত যুদ্ধে ক্ষেপে উঠছে ইজরায়েসবাসীও। এখনও হামাসের হাতে বন্দি ১৩৩ জন ইজরায়েলি। তাঁরা কী অবস্থায় আছেন, আদৌ আছেন কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন বহু পরিবার। এতদিন কেটে গেলেও তাদের উদ্ধারে সামান্যতম ব্যবস্থাও নেয়নি ইজরায়েল সরকার। ইজরায়েলে পাসওভার শুরুর আগেই দেশের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান অসংখ্য বাসিন্দা। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বাইরে জমায়েত পর্যন্ত করেন তাঁরা। গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামাসের হামলায় ১১৭০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই হামলার প্রতিশোধ নিতে গাজায় যুদ্ধঘোষণা করে ইজরায়েল। সেই হামলায় মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে। জখম অন্তত এক লক্ষের কাছাকাছি। মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই মহিলা ও শিশু।

গাজায় ইজরায়েলের এই ভয়াবহ যুদ্ধকে সমর্থন করেনি বহু ইজরায়েলিই। তবে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেননি এতদিন নেতানিয়াহু সরকার। হামাসের হাত থেকে সমস্ত বন্দিদের উদ্ধার করে আনতে পর্যন্ত বিফল হয় ইজরায়েল প্রশাসন। গাজায় হামাস হত্যার নামে যত সংখ্যক নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে ইজরায়েলি সেনা, তার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে আবার নতুন করে ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে ইজরায়েল। ইরান থেকে ছুটে আসা বোমা, গুলি তো রয়েইছে, তার মধ্যে লেবানন সীমান্ত থেকে প্রায়শই ইজরায়েলি ভূখণ্ডে ঢুকে নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে হিজবুল্লাহ। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতি কি ভিতরে ভিতরে বিক্ষুব্ধ করে তুলছে সাধারণ বাসিন্দারা। গত ৭ অক্টোবর ওই হামলার দিনও ইজরায়েলে ছিল উৎসবের মেজাজ। সেই উৎসবের আমেজকে ছিন্নভিন্ন করে ইজরায়েলে ঢুকে ভয়াবহ ও নির্মম ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল হামাস। সেই হামাসকে হত্যার নামে অগণিত সাধারণ ফিলিস্তিনিকে মেরে গিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। যাদের মধ্যে ক'জন হামাস জঙ্গি আদৌ রয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তার উপর নয়া যুদ্ধের আশঙ্কা কাঁপাচ্ছে ইজরায়েলের মানুষকে। এই যুদ্ধ বাড়তে থাকলে তা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্যই দুশ্চিন্তার হতে চলেছে।

এই পরিস্থিতিতে বাসিন্দাদের ক্রোধকে প্রশমিত করতে চাইছে নেতানিয়াহু সরকার। সে কারণেই কি ৭ অক্টোবরের হামলা প্রতিহত করতে না পারার দায় কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করলেন ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। সোমবার ইস্তফা দিয়েছেন মেজর জেনারেল অ্যহরন হালিভার। হালিভারের পদত্যাগের পরেই উস্কে উঠেছে জল্পনা। তবে কি এর পরে পর পর সামনে আসতে চলেছে একের পর এক পদত্যাগপত্র। হামাসের হামলার প্রতিরোধ করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে এই প্রথম ইজরায়েলি বাহিনীর কোনও শীর্ষকর্তা পদত্যাগ করলেন। শুধু গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবেই নয়, একেবারে সেনাবাহিনী থেকেই অবসর নিচ্ছেন তিনি। তিনি নাকি পদত্যাগপত্রে জানিয়েছেন, তিনি হামলা প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়াতেই ইজরায়েলের অদম্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তিনি চিঠিতে জানিয়েছেন, তাঁর অধীনে থাকা গোয়েন্দাবিভাগ ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকার, কালো দিনটিকে সঙ্গে নিয়ে চলছেন তিনি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। সেই অনুতাপ থেকেই নাকি তাঁর এই সরে আসা বলে মনে করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন:ইরানকে হামলার জবাব ইজরায়েলের, নেতানিয়াহুর হাতে রাফাহ দিয়ে যুদ্ধ থামাতে পারবেন বাইডেন?

সত্যিই কি তাই, নাকি এর নেপথ্যেও রয়েছে অন্য কোনও অঙ্ক? প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি এবার অদম্য ইজরায়েল একটু হলেও ভয় পাচ্ছে? আমেরিকার মতো শক্তি তাদের পাশে। পাশে আছে ব্রিটেন, ফ্রান্সও। তবে এত এত শক্তির বিরোধিতার মুখে কি এবার নতিস্বীকার করতে চলেছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকার। নাকি আসল ভয়ের জায়গা দেশের মধ্যের মানুষদের ক্ষেপে ওঠা। সেই ক্ষোভ প্রশমন করতেই গোয়েন্দা-প্রধানের কাঁধে দোষ চাপিয়ে মুখ বাঁচাচ্ছে ইজরায়েল সরকার। ইরানে হামলা চালানোর ব্যাপারে বন্ধুদেশ আমেরিকার হাজারো বারণ কানে পর্যন্ত তোলেনি ইজরায়েল। এবার সেই কথা না শোনারই কি মূল্য দিতে হবে ইজরায়েলকে? গাজায় যে ধ্বংসলীলা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল, যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে ইজরায়েলি হামলায়, তার ফলই কি এবার হাতেনাতে পেতে চলেছে নেতানিয়াহুর রাষ্ট্র? একদিকে ইরান ও হিজবুল্লাহ, হাউথি এবং হামাস-সহ তাদের প্রক্সি দলগুলোর সম্মিলিত হামলা, অন্যদিকে দেশবাসীর ক্ষোভ। সব দিক একসঙ্গে সামাল দিতে পারবে তো আগ্রাসী ইজরায়েল? আপাতত সেটাই দেখার।

More Articles