অলিম্পিকে সোনা থেকে বিশ্বকাপ, মেসি, দি মারিয়া যেন আর্জেন্টিনার 'গুপি-বাঘা'
FIFA World Cup 2022 : বিগত দুই দশকে আর্জেন্টিনার হাসি কান্নার অংশীদার এই দুজন। অদ্ভুতভাবে, মেসি এবং দি মারিয়া – দুজনের জন্ম একই জায়গায়।
দেশের ভূপ্রকৃতির মতোই আর্জেন্টিনার পরিস্থিতি ঢেউ খেলানো। সুখী, বিত্তশালী দেশ নয়। বরং আর্জেন্টিনা দেখেছে যুদ্ধ, মন্দা, দুর্নীতি। ভারতের মতো সেখানেও মফস্বলের পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ায় অজস্র স্বপ্ন। দেশের একই জায়গা থেকে দু’টো ছোট্ট ছেলে সেরকমইই স্বপ্ন দেখেহচিল। দুজনের স্বপ্ন ছিল একই। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া সেই স্বপ্ন একটু একটু করে ডানা মেলেছে। একটা সময় শিখরে উথেও মুখ থুবড়ে পড়েছে সেই সোনালি রোদ্দুর। সবাই ভেঙেছে, কেঁদেছে। ছেলে দু’টিও কেঁদেছে; একবার নয়, বারবার। তবুও লড়াই ছাড়েনি। ২০২২ সালের কাতারের মাটিতে দুজনের চোখেই জল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন তাঁরা। আর ছোটটি নেই, স্বপ্ন এবার পূরণ হল। নিশ্চিন্তে এবার ঘুমোতে পারবেন লিওনেল মেসি এবং অ্যাঞ্জেল দি মারিয়া।
শোলের ‘জয় ভিরু’ হন বা আপন বাংলার ‘গুপি বাঘা’, পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম অনেক জুটিই লুকিয়ে আছেন। যারা তৈরি করেছে মিথ; কল্পনায় হোক বা বাস্তব, তাঁদের দেখে অবাক হয়েছে আম আদমি। মেসি দি মারিয়া যেন সেরকমই একটি অধ্যায়। একটা বিস্তীর্ণ সময়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিগত দুই দশকে আর্জেন্টিনার হাসি কান্নার অংশীদার এই দুজন। অদ্ভুতভাবে, মেসি এবং দি মারিয়া – দুজনের জন্ম একই জায়গায়। আর্জেন্টিনার রোজারিও, সান্টা ফে।
তিন বছর বয়স থেকে ফুটবল খেলা শুরু দি মারিয়ার। বিত্তবান ঘরের সন্তান ছিলেন না দুজনের কেউ। দি মারিয়ার মা-বাবা স্থানীয় কয়লাখনিতে কাজ করতেন। সেখানে ছোট থেকেই মা-বাবাকে সাহায্য করতেন দি মারিয়া। বাড়িতে একটা নয়া পয়সাও নেই, তাই ফুটবলের বুটও নেই। পরিবারের মর্ম সেখান থেকেই শিখেছেন তিনি। মেসির পরিবারও দেখেছে বেকারত্ব। একটা সময় খাওয়ার খরচ তুলতেও হিমশিম খেতে হতো। তার উপর ছিল মেসির জন্মগত রোগ। সমসত কিছুর ওপর ছিল একটা স্বপ্ন। একটা ফুটবল আর একজোড়া বুট। লক্ষ্য গোলপোস্ট। বাকিটা বুঝে নাও, পৃথিবী…
আরও পড়ুন : সবচেয়ে কম বেতনের কোচ তিনি, মেসিদের বিশ্বকাপ জয়ের রূপকথার সওদাগর স্কালোনি
দুজনই আদ্যোপান্ত ‘ফ্যামিলি ম্যান’। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ – এটাই ছিল স্বপ্ন। দুই নদী একসঙ্গে এসে মিলল ২০০৫ সালে। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে তাঁদের একসঙ্গে মাঠে নামা। মেসি প্লে মেকার, স্ট্রাইকার, দি মারিয়া উইং অ্যাটাক। একটা রূপকথার পথ চলা তখন থেকেই শুরু। অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপে দুজনেই খেলেছিলেন; এবং দেখিয়েছিলেন নিজেদের ঝলক। দলের হয়ে খেললে মেসি-দি মারিয়া ছাড়া আর্জেন্টিনা ভাবা যায় না। বিগত কয়েক বছরের দস্তুর এটাই। অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন করেছিল এই জুটি। সেই শুরু বন্ধুত্ব। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কখনও দুজনেই গোল করছেন, কখনও একজনের অ্যাসিস্টে অন্য জন। দুজনে মিলে একের পর এক কাপ জিতেছেন দেশের হয়। অনূর্ধ্ব ২০-র জয়ের পর চলে এল ২০০৮-এর অলিম্পিক। এবার আর জুনিয়র নয়, একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাঁরা। সেখানেও কামাল মেসি আর দি মারিয়ার। মেসির পাস থেকে গোল করেছিলেন দি মারিয়া। সোনার মেডেল নিয়ে ঘরে ফিরেছিল আর্জেন্টিনা।
অদ্ভুতভাবে, এই দুজনই ক্লাব পর্যায়ে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। বার্সেলোনায় মেসি, রিয়াল মাদ্রিদে দি মারিয়া। দুই দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাঠে যতই প্রতিযোগিতা থাকুক, বন্ধুত্ব ভাঙেনি কখনও। ভাঙেনি স্বপ্নগুলোও। কিন্তু অলিম্পিকের পর যেন থমকে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। বড়ো কোনও ট্রফি আসেনি ঘরে। কোপা আমেরিকা আসেনি, ’৮৬-র পর বিশ্বকাপও ঢোকেনি। এদিকে মেসিকে ঘিরে একটু একটু করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে লা আলবিসেলেস্তেরা। চুপচাপ হলেও প্রতিভার তোড়ে মেসি অবিশ্বাস্য উচ্চতায় পৌঁছে যান। দি মারিয়া ওই পর্যায়ে না গেলেও নিজের সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। কিন্তু বরাবরই মেসি-রোনাল্ডোর দ্বন্দ্ব এসে ঢেকে দিয়েছে দি মারিয়াদের মতো ব্যক্তিত্বকে।
আরও পড়ুন : সেনাপতি মেসি, সঙ্গে বিশ্বস্ত মার্তিনেজ, যে মন্ত্রে ফাইনালে স্বপ্নপূরণ আর্জেন্টিনার
২০১৪ বিশ্বকাপ। ব্রাজিলের মাটিতে মহারণ। ফাইনালে আর্জেন্টিনা। এবারও ভরসার মুখ মেসি আর অ্যাঞ্জেল দি মারিয়া। খেললেনও চুটিয়ে। কিন্তু কাজের কাজটি হল না। বাঁ দিক থেকে মারিও গোৎজের সেই শট – আছড়ে পড়ল কয়েক কোটির স্বপ্নে। ভূতের মতো নিষ্প্রাণ হয়ে গোল্ডেন বল নিলেন মেসি। আর দি মারিয়া? কান্না তাঁর নিত্যসঙ্গী। ২০১৮-ও হতাশার। স্বপ্ন পূরণ হবে কি? আশা দেখছেন না অনেকে। বয়স হচ্ছে, আর কয়েক বছর পরেই অবসর। মাথা নিচু করে বিদায় নিচ্ছেন মেসি, দি মারিয়া… বারবার…
হঠাৎ সমস্ত কিছু বদলে গেল ২০২১-এ। স্বপ্ন ফের জেগে উঠল। কোপা আমেরিকা। সামনে ব্রাজিল। প্রবল বিক্রমে লড়ছে আর্জেন্টিনা। গোলশূন্য হয়ে আছে স্কোরবোর্ড। হঠাৎ চমক। কারিগর? দি মারিয়া। তাঁর পা থেকে বেরিয়ে এল চিপ শট। ব্রাজিলের জালে জড়ানোর পর মেসি আর দি মারিয়া ছুটে গিয়েছিলেন পরস্পরের দিকে। আর শেষ বাজি বাজার পর কান্না। একটা ধাপ পেরোলাম বন্ধু, অবশেষে! একসঙ্গে! তবে আরও একটা ধাপ বাকি। জান বাঁচিয়ে রেখো, লড়তে হবে। একসঙ্গে।
আরও পড়ুন : প্রথম ম্যাচে হেরেও বিশ্বজয়! কেন রূপকথাকেও হার মানাবে মেসিদের এই যাত্রা?
২০২২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় ম্যাচটি ভাবুন। মেসি, দি মারিয়া দুজনের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ। মেক্সিকোর সঙ্গে ম্যাচটিতে না জিতলে ফের স্বপ্নভঙ্গ। গোলের সামনে প্রায় দুর্ভেদ্য ওচোয়া। সেই পরিস্থিতিতে ডান দিক দিয়ে ওঠার সময় একবার মেসিকে দেখে নিলেন দি মারিয়া। সুযোগ বুঝে বাড়িয়ে দিলেন বল। একটা টাচ নিয়ে সোজা শট, মেসির গোলের পর ফের চির পরিচিত দি মারিয়া-মেসির সেলিব্রেশন। এরপর চোটের কারণে কয়েকটা ম্যাচ না খেললেও বন্ধুর জন্য সবসময় হাজির মারিয়া। সুযোগ এল ফাইনালে। মেসির ফ্লিক পাস থেকে সোজা বল নিয়ে উঠলেন ম্যাক অ্যালিস্টার। বাঁ দিকে দি মারিয়াকে বল দেওয়ার পর জালে জড়াতে দেরি করেননি। সাইডলাইনে ছুটে যাওয়ার সময় মেসি দেখেন, তাঁর প্রাণের বন্ধু কাঁদছে। স্বপ্ন! সত্যি হবে তাহলে?
অনূর্ধ্ব ২০ থেকে বিশ্বকাপ ফাইনাল – বিগত কয়েক বছরে আর্জেন্টিনার বড়ো টুর্নামেন্টে জয়ের পিছনে বরাবর অবদান থেকেছে মেসি-দি মারিয়ার। রোজারিও-র দুই শিশুর স্বপ্ন শেষমেশ পূর্ণতা পেল। ফুটবলের ‘জয়-ভিরু’ এবার শান্তিতে ঘুমোবেন। ১৭ বছর একসঙ্গে পথ চলা, আরেকটু উন্মাদনা থাকলে ক্ষতি কি!