ফুটবল শুধু ফুটবল নয়, প্রতিরোধের ভাষালিপিও বটে

Stadium protest: খেলার আগেই হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের ঝড় উঠল। সামাল দিতে নামাতে হল কয়েক হাজার পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের দাবি– ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যাতে দল না নামায় ইতালি।

উত্তর-পূর্ব ইতালির ফ্রিউলি-ভেনিজিয়া গিউলিয়া অঞ্চলের ছবির মতো শহর উদিনে। ইতিহাসের ধুলো মাখা এই শহরে পা পড়েছিল কুখ্যাত বেনিতো মুসোলিনির। ক্ষমতার চূড়ায় ওঠার জন্য মুসোলিনি, ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে  ‘মার্চ অন রোম’-এর আগে, এই শহরে একটি বিখ্যাত বক্তৃতা দেন। শোনা যায়, সেই বক্তৃতার পরেই তাঁর জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বাড়ে। এর পরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। প্রবল ক্ষমতাশীল অক্ষশক্তির ফ্যাসিবাদী নায়ক চলে গেছেন কালের নিয়মে, কিন্তু তাঁর অন্তিম পরিণতির দাগ আজও লেগে রয়েছে ইতালির স্মৃতিতে।

১০৩ বছর পর উদিনে শহর আজও একইভাবে দাঁড়িয়ে। এই শহরের বুকেই সম্প্রতি ঘটা একটি ঘটনা তোলপাড় ফেলে দিল বিশ্বজুড়ে। আসন্ন ফুটবল বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব চলছে। তারই একটি ম্যাচ, ইতালি ও ইজরায়েলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা এই শহরের ব্লু-এনার্জি স্টেডিয়ামে। কিন্তু খেলার আগেই হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের ঝড় উঠল। সামাল দিতে নামাতে হল কয়েক হাজার পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের দাবি– ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যাতে দল না নামায় ইতালি। কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট— প্যালেস্তাইনের গাজায় নারকীয় গণহত্যা! কিন্তু খেলা বন্ধ না করা গেলে, স্টেডিয়ামের গ্যালারিতেই এসে পড়ে বিক্ষোভের আগুন। প্যালেস্তাইনের পতাকা এবং ‘শো ইজরায়েল দ্য রেড কার্ড’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে গ্যালারি থেকেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেন দর্শকেরা।

Show israel the red card

এই লালকার্ড প্রতিবাদের শুরুয়াৎ স্কটল্যান্ডে। সম্প্রতি সেল্টিক ক্লাবের সমর্থকেরা প্রথম শুরু করেন এই ক্যাম্পেন, নাম দেন— ‘শো ইজরায়েল দ্য রেড কার্ড’। এরপর এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের আরও ত্রিশটি দেশে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ এই আন্দোলনে শামিল।

লা লিগার ক্লাব দেপার্টিভো আলাভেস। সেই ক্লাবের সমর্থক গ্যালারিতে উঁচিয়ে রেখেছেন লালকার্ড। মাঠের ভেতরে রেফারির হাতে থাকা যে কার্ড, খেলোয়াড়ের ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তটির জানান দেয়, জানান দেয় নিয়মের বাইরে খেলা আসলে পরাজয়, সেই লালকার্ডই এবার হাতে ধরে আছেন দর্শকেরা। ময়দানের নিজস্ব প্রতিবাদ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। এ প্রকৃতির আবহমান নিয়ম— এখানে প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার সম-অধিকার ধার্য করা আছে। কোনো যুক্তি মোতাবেকই সে অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। নিলেই গর্জে উঠবে মানুষ। লা লিগার দল আলাভেস, তাঁদের মেন্ডিজোরোজা স্টেডিয়ামে শুধু লাল কার্ডই নয়, একইসঙ্গে গলা মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থার প্রতি ছুঁড়ে দিলেন স্লোগান— "ইজরায়েলকে অবিলম্বে বয়কট করতে হবে ফুটবলের ময়দান থেকে।" লা লিগার আরেক দল ওসাসুনার সমর্থকেরাও রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে খেলায় স্টেডিয়াম থেকে এই একই দাবি জানিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন- মাঠে জয়, সমাজে লড়াই; খেলাধুলোর মেয়েরা যে লড়াই লড়ছে

সাম্প্রতিক ইতিহাসে, খেলার মাঠে যে কেবল ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতই একমাত্র রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে উঠে আসছে তা কিন্তু নয়। ব্রাজিলের স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসক বলসেনারোর বিরুদ্ধেও গর্জে উঠেছে সাও পাওলোর গ্যালারি। সাও পাওলোর প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবগুলো কোরিন্থিয়ান্স, পালমেইরাস, স্যান্টোস, ফ্ল্যামেঙ্গোর সমর্থকেরা একজোট হয়ে গ্যালারি থেকে ব্যানার-পোস্টার-টিফোয় জোরালো বক্তব্যে বিদ্ধ করেছিলেন শাসককে। 

কলকাতা তথা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় ডার্বি ম্যাচ— ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, সেখানেও রাজনৈতিক আন্দোলনের ঢেউ লেগেছে বিগত কয়েক বছরে। সাম্প্রতিক সময়ে সিএএ, এনআরসি-র মতো ইস্যু, যা কিনা দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে টিফো-ব্যানার নামতে দেখেছি যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। এনআরসি ইস্যু বিরোধিতায় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থকেরা লিখেছিলেন— "রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়…", আবার অতি সম্প্রতি দেশজুড়ে বাঙালিদের উপর বাংলাদেশি সন্দেহে অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা গ্যালারি থেকে ঝুলিয়েছেন বিশাল টিফো যাতে লেখা—

"ভারত স্বাধীন করতে সেদিন পরেছিলাম ফাঁসি/ মায়ের ভাষা বলছি বলে, আজকে ‘বাংলাদেশি’?" 

yuba Bharati

খেলার ময়দানে সম্প্রতি এহেন রাজনৈতিক প্রতিবাদ বারে বারে এসে পড়ার কারণ কী? কেনই বা এত সংগঠিত প্রতিবাদ বারে বারে উঠে আসে ফুটবলের ময়দান থেকে? ব্রাজিলের কোরিন্থিয়ান্সের দিকে তাকানো যাক, ৫৫ বছর আগে তাদের সাপোর্টার আল্ট্রাস তৈরিই হয়েছিল বিক্ষোভের আগুন থেকে। মিলিটারি ডিকটেটরশিপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন থেকে জন্ম নেওয়া এই গ্যালারির সমর্থকদের মূলমন্ত্রই ছিল "উইন অর লুজ বাট অলওয়েজ ডেমোক্র্যাটিক", দলের মূলমন্ত্র— ‘পিপলস ক্লাব’ সকলের জন্য। সকলের সমানাধিকারের জন্য এই ক্লাব। সেই দলের সমর্থকেরা দক্ষিণপন্থী শাসকের বিরুদ্ধে গর্জেছেন সময়ের নিয়ম মেনে। এ শহরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম ১৯২০ সালে হলেও, দেশভাগের যন্ত্রণার লাল আরও বর্ণময় করেছে ক্লাবের ইতিহাসকে, ১৯৪৭ সালের পর ছিন্নমূল হয়ে পড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের আশ্রয় হয়ে ওঠা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের রক্তেই তো রয়েছে প্রতিবাদ। একই ভাবে স্পেনের ক্লাব ওসাসুনার কথা ধরা যাক, স্পেনের যে গুটিকয়েক ক্লাব এখনও সদস্য দ্বারা পরিচালিত, ওসাসুনা তার মধ্যে অন্যতম। প্রবল কর্পোরেটাইজেশনের যুগে ক্লাবের মালিকানা কর্পোরেটের হাতে সম্পূর্ণরূপে তুলে দেয়নি তারা। স্পেনের গৃহযুদ্ধে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হাতে খুন হতে হয়েছে বহু ক্লাব সদস্য ও খেলোয়াড়দের, বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে অসংখ্য সমর্থককে। তাই ওসাসুনার সমর্থকদের এই ডানপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

সাম্প্রতিক ইতিহাসে বারে বারে খেলার ময়দানেই কেন উঠছে প্রতিবাদের ঢেউ? সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় দেখলে, আমরা দেখব খেলা মূলত সাম্যের কথা বলে। বিশ্বের যে কোনো খেলাই শুরু হয় 0-0 স্কোরলাইন থেকে। ফুটবল এমন একটি খেলা, যার জন্ম ও পরিণতি সমাজের মেহনতি ও নিচুতলার মানুষদের হাতেই, তাই সামাজিক বদলের আঁচ সর্বাধিক অনুভূত হয় ফুটবল গ্যালারিতেই। যে কোনো জনপ্রিয় খেলার সঙ্গেই রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের যোগসূত্র থাকে। বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলার সঙ্গে হয়তো রাজনৈতিক বিষয়ের যোগ বেশি। অর্থনৈতিক শ্রেণীকে সে চ্যালেঞ্জ জানায় বলে। ফুটবল গ্যালারিই হলো নাস্তিকের সেই তীর্থস্থান যেখানে একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী, একজন মোটা বেতনের চাকুরীজীবি এবং একজন অতি সাধারণ রোজগেরে কর্মী অনায়াসে পাশাপাশি বসে দলের সমর্থনে গলা ফাটাতে পারে। তাই সারা বিশ্বজুড়ে যখন দক্ষিণপন্থী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে, তখন সবথেকে বেশি উত্তাল যে ফুটবলের গ্যালারিই হবে তা বলার অবকাশ রাখে না।  

ফুটবল মাঠে আমরা যা দেখি তা একটি বৃহৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মিনিয়েচার, যার মধ্যেই কেটে যায় খেলোয়াড় জীবন, দর্শকের মননও। সিএলআর জেমস-এর বিখ্যাত কথাখানা সামান্য পাল্টে যদি বলি, তবে আমরা অনায়াসেই একথা বলতে পারি— "যারা শুধু ফুটবল বোঝে, তারা ফুটবলের কী-ই বা বোঝে?"  

More Articles