সংকল্প জয়, প্রতিটি রান ধ্যান, ক্রিকেট ধর্মের সন্ন্যাসিনী জেমাইমা
Jemimah Rodrigues: জেমিমা, এক পায়রার নাম, যে আগুনের মধ্যেও শান্তি খুঁজে নেয়। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে আজ সে শুধু ব্যাটার নয়। বিশ্বাস, লড়াই আর পুনর্জন্মের প্রতীক।
বাইবেলের ‘বুক অব যোব’-এর শেষ অধ্যায়ে একটা বাক্য বারবার উচ্চারিত হয়, “অ্যান্ড হি কলড দ্য নেম অব দ্য ফার্স্ট, জেমিমা” — দি বুক অব যোব ৪২:১৪
যোব সব হারানোর পরও বিশ্বাসের জোরে, আশীর্বাদ হিসেবে পেয়েছিলেন তিন মেয়েকে। তাদের মধ্যে প্রথম মেয়ে, জেমিমা। যার অর্থ পায়রা, শান্তির প্রতীক।
শতাব্দী কেটে গেছে। আজকের পৃথিবীতে, ধর্ম আর রাজনীতি প্রতিদিন নতুন করে সংজ্ঞা বদলাচ্ছে। 'শান্তি' শব্দটার সঙ্গে ক্রমে গেঁথে যাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার তলোয়ার। যে দেশে মেয়েদের রাতে একা বেরোনো অন্যায়, যেখানে ধর্ম মানে ভোটব্যাঙ্ক, আর রাজনীতি কেবল বিভাজন চায়; এক রাতে সেই দেশেরই এক মেয়ে সেঞ্চুরি করে। তারপর উদযাপন নেই। কেবল উবু হয়ে সে বসে ক্রিজে। হেলমেটের নিচে ঘাম। চোখে উচ্ছ্বাস নেই, শুধু প্রার্থনা। ক্যামেরা জুম করে ধরল মেয়েটির মুখ। ধারাভাষ্যকার বললেন, “মেয়েটি জানে, এটি কেবল খেলা নয়।” ওই রাতে ভারত হারাল অস্ট্রেলিয়াকে, ইতিহাসে নাম উঠল। খেলা শেষের আগে মেয়েটির ব্যাট একবারও থামেনি। তিনি জানেন তাঁকে কেবল ফিনিশিং লাইনে স্কোয়ার কাট মারলেই চলবে না, বাউন্ডারি হাঁকাতে হবে গোটা সমাজের ফিল্ডিংকে ডজ করে। তাই তিনি খেলার আগে প্রার্থনা করেন। না, ক্যামেরার সামনে নয়, নিজের মধ্যে। কেবল বলে চলে, "প্রভুই তোমার হয়ে যুদ্ধ করবেন; তুমি শুধু শান্ত থাকো" (“স্ট্যান্ড স্টিল, অ্যান্ড গড উইল ফাইট ফর ইউ” এক্সোডস ১৪:১৪)।

জেমিমা রড্রিগেজ
মেয়েটির প্রতিটি বাউন্ডারি আসলে এক নীরব প্রতিবাদ। মেয়েটির নাম জেমিমা, জেমিমা রড্রিগেজ। যোবের গল্প আসলে ধৈর্যের গল্প, পুনর্জন্মের গল্প। কিন্তু সেই গল্প আজকের ভারতবর্ষে এক ভিন্ন প্রেক্ষিতে ফিরে এসেছে এক তরুণীর ব্যাটে। যাঁর বিশ্বাস আর লড়াই যেন বাইবেলের অন্য পাঠ। আরও একবার মনে করাব, জেমিমা সেই সময় লড়ছেন যখন ঈশ্বরকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভাবছে একদল লোক আর অন্য দল ভাবছে প্রতিরোধই প্রার্থনা। মুম্বইয়ের খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মানো জেমিমা, ক্রিকেটের মাঠে এসে এক নিঃশব্দ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, বিশ্বাস কি কেবল মন্দির বা গির্জায় থাকে,পরিশ্রমে কি ঈশ্বরপ্রাপ্তি নেই?
আরও পড়ুন- রিচা-জেমিমাদের লড়াই মাঠ পেরিয়ে সমাজে
ভোর চারটে। মুম্বই লোকালের ট্রেনের প্রথম হুইসেল। ছোট্ট একটা মেয়ে, কাঁধে ব্যাট, পাশে দুই দাদা, এনক আর ইলাই। পুরুষ ঠাসাঠাসি কামরায় চাপা পড়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি তখনও জানত না ভারতে মেয়েদের ক্রিকেট বলে কিছু আছে। আনন্দের সঙ্গে, প্রতিদিন মাঠে যেত। দু-ঘণ্টা ফিল্ডিং করত, যাতে দশ মিনিট ব্যাট করতে পারে। একদিন কোচ বললেন, “আজ মেয়েদের ট্রায়াল আছে, খেলবি?” সে বাড়ি ছুটল, ক্রিকেটের সাদা পোশাক পরে ফিরেও এল। পাশে বাবা ইভান রড্রিগেজ। গ্রাউন্ডে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হাসাহাসি। আট বছরের মেয়ে, আর প্রতিপক্ষ নাকি বছর চব্বিশ পঁচিশের ক্রিকেটাররা। ভাই ফিসফিস করে বলেছিল, “দাদা, ওকে একবার বল করতে দাও, তখন সবাই জানবে।”
দ্বিতীয় বলেই উইকেট। মাঠ নিস্তব্ধ। সেখান থেকেই শুরু এক নতুন গল্পের। ইভান রড্রিগেজ ছিলেন স্কুল কোচ, নিজেও খেলেছিলেন ক্লাব ক্রিকেটে। মেয়ের চোখে ছিল তাঁর প্রতিচ্ছবি। তিনি বলেন, “যখন মাঠে থাকি, আমি শুধু কোচ। বাবা নই।” মেয়েটির পা নড়ত না। রীতিমতো মার খেয়েছে ছোটবেলায়। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলার দিকেই ছিল তাঁর বেশি টান। স্কুলের মাঠে কখনও ক্রিকেট, কখনও হকি, কখনও ফুটবল, আবার কখনও বাস্কেটবল। জেমিমা মহারাষ্ট্রের মুম্বই অনূর্ধ্ব-১৯ হকি দলে খেলেছেন সেন্টার-ফরওয়ার্ড হিসেবে। তাঁর দ্রুত দৌড় আর নিখুঁত ড্রিবলিংয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন ভারতের প্রাক্তন জাতীয় হকি কোচ জোয়াকিম কার্ভালহো।

জেমিমা রড্রিগেজ
ক্রিকেট তখনও তাঁর জীবনের কেন্দ্রে আসেনি। স্টিক হাতে গোল করার আনন্দই ছিল প্রথম প্রেম। তবু ধীরে ধীরে ব্যাটের প্রতি টান বাড়ে , কারণ মুম্বই শহরে ক্রিকেট খেলার সুযোগ অনেক বেশি, প্রতিযোগিতাও নিয়মিত। জেমিমা নিজেই একবার বলেছিলেন, “আমি এখনও দুটোই ভালবাসি, একদিন দুটোতেই ভারতের প্রতিনিধিত্ব করব।” মুম্বইয়ের ভান্ডুপ থেকে বান্দ্রা। সব পরিবর্তনই হয়েছিল একটাই কারণে। যাতে জেমিমা ভালোভাবে খেলতে পারেন। এই শাসনের মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল শৃঙ্খলার বীজ।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি জায়গা করে নেন মুম্বই অনূর্ধ্ব ১৯ দলের স্কোয়াডে। প্রথম বড় মঞ্চ। এরপর কয়েক বছরের মধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন দলের অধিনায়ক। একইসঙ্গে খেলতে থাকেন অনূর্ধ্ব ২৩ ও সিনিয়র দলে। ধীরে ধীরে নিজের ছন্দ খুঁজে পান। ২০১৬-১৭ মরশুমে তিনি দশ ইনিংসে করেন ৬৬৫ রান,পরের মরশুমে (২০১৭–১৮) সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০১৩ রানে, যার মধ্যে ছিল পাঁচটি শতরান এবং একটি ডবল সেঞ্চুরি। বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর।
আরও পড়ুন- মাঠে জয়, সমাজে লড়াই; খেলাধুলোর মেয়েরা যে লড়াই লড়ছে
সেই দ্বি-শতকই ছিল ভাগ্য পাল্টানোর মুহূর্ত। তাঁকে ভারতীয় দলে ডাকা হয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঝলমলে পারফরম্যান্সে তিনি হয়ে ওঠেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। অচিরেই নীল জার্সির ডাক আসে। এরপরই প্রথম আন্তর্জাতিক সফর, গন্তব্য দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথম ম্যাচেই ৩৭ রান। মিতালি রাজের সঙ্গে জুটি বেঁধে ভারতকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। পাঁচ নম্বর ম্যাচে ৩৪ বলে ৪৪ রানের ইনিংস। এরপর ২০১৮ সালের মার্চ। মুম্বইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম অর্ধশতক, ৫৭ বলে ৫০। সেই ম্যাচেই গড়লেন রেকর্ড। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে পরপর তিনটি জয়। তারপর থেকে তিনিই ভারতের অন্যতম নির্ভরযোগ্য মিডল অর্ডার ব্যাটার।
২০১৯ সালে কিয়া সুপার লিগে ইয়র্কশায়ার ডায়মন্ডসের হয়ে ৫৮ বলে ১১২। সবই এক নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু, এই সংগ্রামই তাঁকে ‘মেন্টালি টাফ’ করে তুলেছে ততদিনে। এর পর ২০২০ সালে টি-২০ বিশ্বকাপ দলে যোগ দেওয়া থেকে ২০২১ সালে, ইংল্যান্ডের দি হান্ড্রেডে নর্দার্ন সুপারচার্জার্সের হয়ে ৯২ রানের ইনিংস। ২০২১-২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার উইমেনস বিগ ব্যাশ লিগে (ডব্লিউবিবিএল) মেলবোর্ন রেনেগেডসের হয়ে ধারাবাহিক রান। যাত্রা ছিল অব্যাহত।

জেমিমা রড্রিগেজ
তবে সব লড়াইয়েই উত্থান-পতন থাকে। ২০২২ সালে জেমিমা বাদ পড়েন ওয়ান ডে ওয়ার্ল্ড কাপ থেকে। নিজেই বলেছেন, অট্টহাসিতে তিনি কান্না চেপে রাখতেন তখন। মা লেভিতা রদ্রিগেজ সাহস জুগিয়েছিলেন,'সঠিক সময় আসবে'। সেদিন তিনি ভেঙে পড়েছিলেন, কেঁদেছিলেন। তারপর এক সপ্তাহ বিরতি। নিজেকে আবার গড়ে তোলা। এর পর আর ফেরায় কে? ঘরোয়া লিগে, দারুণ পারফরম্যান্স। মহিলা টি–২০ চ্যালেঞ্জ, শ্রীলঙ্কা সিরিজে প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ। সেই ম্যাচ শেষেও তিনি বলেছিলেন, “আমি খেলা শেষে কয়েক ঘণ্টা জার্সি খুলিনি, নিজের ঘরে আছি অনুভব হয়েছিল।” এ প্রত্যাবর্তন কেবল খেলায় ফেরা নয়, সর্বস্বজোড়া আত্ম-উদঘাটন।
ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে সেমিফাইনালের রাতে এক ইনিংসেই হাজারও প্রশ্নের দিয়ে দিলেন জেমিমা। ভারত তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে। কিন্তু এবার কেউ বলবে না, “মেয়েরা ভাগ্যের জোরে উঠেছে।”এবারের ভারত জিতেছে ঘাম, বিশ্বাস, আর এক মেয়ের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে। অস্ট্রেলিয়া, সাত বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। তাঁদের ৩৩৮ রানের পাহাড়টা নতজানু হলো এক তরুণীর সাহসের সামনে। হরমনপ্রীতের সঙ্গে ক্রিজে আসেন জেমিমা। একটি কভার ড্রাইভেই যেন জানিয়ে দেন, “আমরা জিতবই।” জুটি তুলে নেয় ১৬৭ রান। জেমিমার প্রতি শট ছিল প্রার্থনার মতো সুন্দর, প্রতি রানেই উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল বিশ্বাস।
আরও পড়ুন- একদিন আমিও স্মৃতি মন্ধনা হব
৮২ রানে হিলি ক্যাচ ফেললেন, ১০৬ রানে ম্যাকগ্রা, যেন ঈশ্বরও চান, গল্পটা এখানেই শেষ না হোক। শেষের ১৮ বলে দরকার ২৩ রান। রিচা ঘোষ দু'টি ছক্কা মারলেন, গ্যালারি গর্জে উঠল। তারপর ৪৮তম ওভারে জেমিমার দু’টি নিখুঁত চার। ভারত এক ধাপ এগিয়ে গেল ইতিহাসের দিকে। শেষ ওভারের স্কোয়ার ড্রাইভ, তারপর স্কোয়ার কাট। বল বাউন্ডারিতে পৌঁছতেই ভারত জিতে যায়। জেমিমা হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন মাঠে। চোখ বন্ধ করে বলেন, তিনি একা জেতেননি, যিশু তাঁর জন্য লড়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, আজ তাঁর শতরানের জয় নয়, ভারতের জয়। মেয়েদের জয়।
ভারতের ক্রিকেটে এখন নতুন সময়। স্মৃতি মন্ধনা, হারমনপ্রীত কৌর, দীপ্তি শর্মা,সবাই নিজের পথে ইতিহাস লিখছেন। কিন্তু জেমিমার গল্প আলাদা। তিনি বিশ্বাসে ক্রিকেট খেলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেছিলেন, “যখন আমি খেলি, তখন আমার মনে হয় আমি উপাসনা করছি।” ক্রিকেট তাঁর কাছে খেলা নয়। ধর্ম, বিশ্বাস। এই দেশে, যেখানে ঈশ্বরকেও রাজনৈতিক প্রতীক বানানো হয়, সেখানে জেমিমার প্রার্থনা ব্যাটের শব্দে অনুবাদ হয়। সেই রাতে অন্তত একজন মেয়ে দেশকে মনে করিয়ে দিয়েছিল— শক্তি মানে চিৎকার নয়, বিশ্বাস। জেমিমা, এক পায়রার নাম, যে আগুনের মধ্যেও শান্তি খুঁজে নেয়। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে আজ সে শুধু ব্যাটার নয়। বিশ্বাস, লড়াই আর পুনর্জন্মের প্রতীক।
Whatsapp
