'দরকার হলে সারাজীবনে চারটে সিনেমা করব, কিন্তু সৎভাবে করব': অনির্বাণ ভট্টাচার্য
Exclusive Interview of Anirban Bhattacharya: ইনস্ক্রিপ্ট-এর সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে অনির্বাণ ভট্টাচার্য।
সদ্য মুক্তি পেয়েই প্রশংসায় ভাসছে অনির্বাণ ভট্টাচার্য পরিচালিত প্রথম বড়পর্দার ছবি 'বল্লভপুরের রূপকথা'। এই আবহেই সিনেমা-থিয়েটারের মিশেল থেকে অতিমারীর অন্ধকার, নানা বিষয়ে ইনস্ক্রিপ্ট-এর সঙ্গে অকপট অনির্বাণ ভট্টাচার্য। কথা বললেন প্রিয়ক মিত্র।
প্রথমেই আপনাকে অঢেল অভিনন্দন। 'বল্লভপুরের রূপকথা' দর্শকদের মুগ্ধ করছে। এখানে প্রথম যে প্রশ্নটা রাখব, তার তিনটে ভাগ। গল্প হিসেবে বাংলা থিয়েটারের ক্লাসিক নির্বাচন করলেন কেন? কেন বাদল সরকার এবং কেন 'বল্লভপুরের রূপকথা'? 'বাদল সরকারের গান'-এ এর কিছুটা উত্তর পাই, কিন্তু নির্দেশক হিসেবে কোনও ভাবনা কি কাজ করেছিল এর নেপথ্যে?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: আসলে আমাদের যখন ছবি করতে বলা হলো, তখন আমি এবং প্রতীক (দত্ত) নানাবিধ বিষয় ভাবছিলাম। আমরা ততটা প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের কোনও গল্প বলার ইচ্ছে রয়েছে, এমন অবস্থায় আমাদের ছবি করতে বলা হয়নি। কারণ তখনও 'মন্দার' রিলিজ করেনি, আমরা বিষয়টা থেকে সেভাবে বেরিয়ে আসিনি। ২০২১-এর নভেম্বরে 'মন্দার'-এর স্ট্রিমিং শুরু হয়, তার আগে, মে মাস নাগাদ আমাদের ছবির ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসার অভিষেক দাগা ফোন করে যখন একটি ছবি করতে বলছেন, তখন 'মন্দার' তৈরি হয়ে গেছে, ওঁদের দেখে কাজটি ভালো লাগে, ওঁরা সেজন্য ছবিটা করার কথা বলেন। ছোট বাজেটের মধ্যে ছোট ছবি করতে বলা হয়, বড় স্কেলের কিছু নয়, এমনকী, 'মন্দার'-এর চেয়েও স্বল্প পরিসরের কাজ হতে হবে সেটা। সেই শর্তে আমরা গল্প খোঁজা শুরু করি, কারণ আমাদের কাছে কিছুই রেডি ছিল না। শীর্ষেন্দুবাবুর একটা গল্পের কথা ভাবছিলাম, নিজেদের আইডিয়া থেকে একটা ডিসটোপিয়ান গল্প তৈরির কথা ভেবেছিলাম, যা ভীষণই ডার্ক, 'মন্দার'-এর চেয়েও ডার্ক। তখন আমরা ঠিক করলাম, প্রযোজকের কাছে যদি একটা ভার্সেটাইল প্রোপোজাল আমরা নিয়ে যেতে পারি। তার মধ্যে ডার্ক কনটেন্ট ছিল, সোশিও পলিটিক্যাল কনটেন্ট ছিল, যেটা শীর্ষেন্দুবাবুর একটা গল্প; তার সঙ্গে একটা হাসির ছবির কথাও আমাদের মাথায় ছিল। এইসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছিল। আমি সেসময় কিছু পুরনো নাটক পড়ছিলাম। এমনকী, মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের 'কাল বা পরশু', ম্যাক্স ফ্রিশের যে নাটক থেকে নবারুণ ভট্টাচার্যর 'যারা আগুন লাগায়' লেখা, তারই এক ধরনের বঙ্গীকরণ, সেই নাটকের কথাও ভেবেছিলাম। মূলত সোশ্যাল রেলিভ্যান্সের নিরিখে গল্প খোঁজা চলছিল তখন। আমাদের মাথাটা বেশিরভাগ সময়ই ওরকম হয়ে থাকে, যেখানে এখনকার গল্প খুঁজে চলি আমরা। হঠাৎই আমার 'বল্লভপুরের রূপকথা'-র কথা মাথায় আসে। আমি প্রতীককে বলি, এটা ছবি হবে রে? ও বলে, খুব শক্ত। এটা এমনই একটা ডায়লগ ড্রামা, যার মধ্যে অনেক বেশি থিয়েটারের উপাদানই রয়েছে। আমাদের দু'জনেরই তাই মত ছিল। ফলে খুব স্কেপটিক্যাল হয়েই আমরা যাই গল্প শোনাতে। কিন্তু 'বল্লভপুরের রূপকথা'-র গল্পের সার শোনার পর অভিষেক এবং আমার অন্য প্রযোজক আর কিছুই প্রায় শুনতে চাননি। এইটা ছিল, বলা যেতে পারে, বুল'স আই। ওঁরা প্রথমেই কনটেন্ট হিসেবে এটা এতটাই পছন্দ করে ফেলেছিলেন, যে এটাতেই স্টিক করে থাকতে চেয়েছিলেন। তারপর আমরা গল্প লিখতে শুরু করি।
কোনও সন্দেহ নেই, এটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর, ক্রুয়েল সময়। বললে হয়তো খুব নেগেটিভ শোনাবে, আমরা যে সময়টার মধ্যে বসে আছি, সেখানে হয়তো আমাদের সুযোগসুবিধা অনেক বেশি, কিন্তু আমাদের সোল ইজ ডাইং স্লোলি।
আলাদা কোনও ভাবনা কাজ করেনি। ওই যে বললাম, একটু স্কেপটিক্যাল-ই ছিলাম। 'ম্যাকবেথ'-ও নাটক, কিন্তু 'ম্যাকবেথ'-এর ক্ষেত্রে তো আর আমাদের নাটক অনুসরণ করতে হয়নি। আমরা গল্পটা তুলে নিয়ে নিজেদের মতো করে চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলাম। গেইলপুর-সহ অন্যান্য চরিত্রদের গোটা প্রেক্ষাপটটাই আমরা তৈরি করেছি। বলা যায়, মৌলিকভাবে লেখা হয়েছিল চিত্রনাট্যটা। 'বল্লভপুরের রূপকথা'-র ক্ষেত্রে সেই সুযোগ আমাদের ছিল না। প্রথম দিন থেকেই আমার মনে হয়েছিল, এই টেক্সটটাকে বদলাতে গেলে ম্যাসাকার হবে। কারণ নাটকটা পড়ে এবং 'নান্দীপট'-এর মঞ্চায়ন দেখে (যাতে প্রতীক অভিনয়ও করে) আমাদের যে হাসি পায়, মজা লাগে, তার মূলে রয়েছে 'টেক্সট'। ওই টেক্সট-টা পারফর্ম করলেই তবে সেই মজাটা থাকবে, গল্পটা থেকে সরে গেলেই বিপদ হবে, এইটা বুঝেছিলাম। কারণ গল্পটা তো আপাতপক্ষে একটা সরল গল্প। গল্পটার মধ্যে তো বিশাল কোনও মোচড় নেই, এখন যেমন স্পয়লার, থ্রিল, হুডানিট, হাউডানিট এসব নিয়ে গল্প তৈরি হয়, তেমন কিছুই নেই। গল্পটা তো সহজ, নদীর মতো বয়ে চলা গল্প। আসল ব্যাপারটা ছিল গল্প বলাটা, কীভাবে সংলাপের ভেতর দিয়ে চরিত্রদের বের করে আনছি, মানুষগুলোকে বের করে আনছি। সেটাই একটু ভয় ধরিয়েছিল, যে, নাটকের স্ক্রিপ্ট ইনট্যাক্ট রেখে একটা সিনেমার চিত্রনাট্য কীভাবে তৈরি করা যায়।
'বল্লভপুরের রূপকথা'-র পরতে পরতে সহজতা রয়েছে এক ধরনের, একথা দর্শকরা বলেছেন। এই গল্পের প্রেক্ষিত ছয়ের দশক। সেই দশকের বাংলা ছবির মধ্যে যে ইনোসেন্স ছিল, যে স্পষ্টতা ছিল, এই ছবিতে তার কোনও প্রভাব ছিল?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: আমি তো ছয়ের দশকের মানুষ নই। আটের দশকের মাঝে আমার জন্ম, আমি নব্বইতে বড় হয়ে উঠেছি। আমি ছয়ের দশক থেকে অনেকটা দূরে। তবে যেহেতু ওই সময়ের সিনেমা আমরা দেখেছি, থিয়েটার নিয়ে পড়াশোনার সূত্রে ওই সময়টার ইতিহাস ইত্যাদির সঙ্গে একটা যাতায়াত রয়েছে, তাই একথা আমি বলব, আজকের এই মেহেম-টাতে বসে আরও ভালো বোঝা যায় যেটা, ওটা ছিল একটা ইনোসেন্ট পৃথিবী। পৃথিবী কোনও দিনই খুব একটা শান্ত ছিল না। কিন্তু আপামর জনসাধারণের নিরিখে পৃথিবী অনেক বেশি কোমল ছিল। মানুষ অনেক বেশি মানুষ ছিল। ইতিহাস পড়ে, সাহিত্য পড়ে, সবচেয়ে বড় কথা, সিনেমা দেখেই তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ছয়ের দশকের যে সিনেমা, সেখানে ফ্যামিলি ফিল্মের যে নেচার, তার অভিনয়ের যে নেচার, সেটা দেখলে একটা আভাস পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: ‘মৃণাল সেনের চোখে দেখেছি আমার শহর’: কথাবার্তায় অঞ্জন দত্ত
কোনও সন্দেহ নেই, এটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর, ক্রুয়েল সময়। বললে হয়তো খুব নেগেটিভ শোনাবে, আমরা যে সময়টার মধ্যে বসে আছি, সেখানে হয়তো আমাদের সুযোগসুবিধা অনেক বেশি, কিন্তু আমাদের সোল ইজ ডাইং স্লোলি। এই মেশিনারির পৃথিবীতে, এই টেকনোলজির পৃথিবীতে মানুষ তাদের আত্মা হারাচ্ছে। যে কারণে মানুষ মানুষ, সে ভালবাসতে পারে, হৃদয় আছে, মায়া আছে, মমতা আছে, বুদ্ধি আছে, সেটা খুবই অধোগামী। এই জায়গা থেকেও এই ভাবনাটা কিছুটা এসেছিল।
'বল্লভপুরের রূপকথা' পরিচালক হিসেবে আমার কাছে একটা এক্সারসাইজ বলা যায়। আমি এরকম কাজ কখনও করিইনি। আমি থিয়েটারেও যা কাজ করেছি, তাতে হাসি-মজা থাকলেও তা খুব সার্কাস্টিক, ডার্ক ভঙ্গিতে পরিবেশিত হয়েছে। সে 'চৌমাথা' হোক, 'উদরনীতি' হোক বা 'পন্তু লাহা ২.০' হোক। আমি এরকম নির্মল কাজ কখনও করিনি। কাজেই সেই নির্মলতা আমার মধ্যে এখনও আছে কি না, না কি ডার্ক সার্কাজম চর্চা করতে করতে এখন আমিও একটা ফ্রাস্ট্রেশন, ডিপ্রেশনের খোপে ঢুকে গেছি, এই ছবির যে পেলবতা, এই ছবির যে নির্মলতা, সেটা আদৌ এই সময় বাঁচতে বাঁচতে আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে কি না, তা বোঝার জন্যও প্রয়োজন ছিল এই চ্যালেঞ্জটা।
'মন্দার' ছিল ওয়েব সিরিজ। 'বল্লভপুরের রূপকথা' বড়পর্দার ছবি। অতিমারীর প্রকোপ পেরিয়ে মানুষ আবার হলে আসছে আস্তে আস্তে। কিন্তু এই দুই আলাদা মাধ্যমের মধ্যে ভবিষ্যতে আপনি কোন মাধ্যমে কাজ করতে চাইবেন?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: আমি মাধ্যম নিয়ে খুব স্ট্যাগন্যান্ট থাকতে চাই না। ওটিটি খুব পপুলার মাধ্যম হিসেবে ইমার্জ করছে। হয়তো একটু কম ক্লাসিক্যাল, সিনেমা অনেক বেশি ক্লাসিক্যাল এখন। যদিও হলে সিনেমা দেখার যৌথতার ডিসিপ্লিনটা এখন যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হয়তো ততটা ক্লাসিক্যাল থাকছে না। সব ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে। যে কোনও ডিসিপ্লিনারি ভিউয়িংয়ের ক্ষেত্রে অতিমারীর পরে যে দাগটা লেগেছে, তা সরতে অনেক সময় লাগবে। কারণ, দু'বছরের একা একা থাকার একটা অভিঘাত তো আছে। মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদির সূত্রে একটা ইন্ডিভিজুয়ালিজমের চর্চা শুরু হয়েছিল বছরদশেক ধরে, অতিমারীর ফলে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। বিশেষত, আগামী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তো একাই শুরু করল পৃথিবীতে চলাটা। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং ইত্যাদির একটা ছাপ রয়েছে। মোবাইল, সেলফি, সব কনটেন্ট একজায়গায়; এই যে গোটা পৃথিবীটা আমার হাতেই আছে, আমিই সেটা চালাচ্ছি- এই যে আইসোলেশন, এই যে ইন্ডিভিজুয়ালিজমের চর্চা, এর ফল ভুগতে হবে আমাদের। থিয়েটারের দর্শককেও ভুগতে হবে, সিনেমার দর্শককেও ভুগতে হবে। তবে এই সমস্যাটা অতিমারীতে যে মাত্রায় পৌঁছেছিল, তা হয়তো থিতিয়ে যাবে। কিন্তু দ্বিতীয় কোনও অশান্তি তো আর থেমে থাকবে না, কিছু একটা আসবে পৃথিবীতে আবার, তা যুদ্ধ হোক বা অন্য কিছু। ফলে কমিউনিটি ওয়াচে যে বিচ্যুতি দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে লড়াই করতে করতেই সিনেমাকে যেতে হবে। কিন্তু সিনেমা ইজ স্টিল এ ক্লাসিক্যাল ফর্ম অফ ভিউয়িং। একটা সামাজিক ক্রিয়া বলা যায় সিনেমা দেখাটাকে। এই দুই মাধ্যমেই থাকতে চাইব।
ওরকমভাবে তো বিচার করা মুশকিল, কোনটা সিনেমার কনটেন্ট, কোনটা ওটিটি-র কনটেন্ট। ওটা খুব বোকা বোকা বিভাজন যে, বড় শট হলেই তা সিনেমা, আর ছোট, একফালি ঘরের মধ্যে কিছু হলেই তা ওটিটি-র জন্য। ব্যাপারটা তো এমন নয়। কিন্তু ভিউয়িংয়ের বিষয়টা মাথায় রাখব, কোনটা কমিউনিটি ওয়াচ, কোনটা পার্সোনাল, সেই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। কনটেন্টে ওই ভাগটা রাখা জরুরি আমার মতে। একটা গল্প কত মোক্ষমভাবে, কী কী অনিবার্যতার সঙ্গে একজনের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে পারে, সেটা দেখতে হবে। গল্পের মধ্যে যদি সেই উপাদান থাকে, 'বল্লভপুরের রূপকথা'-র মধ্যে যা আছে, কমিউনিটি ওয়াচের মাধ্যমে, হলের সামগ্রিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে যদি তা জারিত হতে পারে, তাহলে তার অভিঘাত জোরদার হবে। আবার কিছু গল্প ব্যক্তিগতভাবে হেডফোনের মাধ্যমে মোবাইল, টিভি বা ল্যাপটপের পর্দা মারফৎ একজনের মাথায় ঢুকে গেলে তার একটা অন্য অভিঘাত আছে। সেই ভাগাভাগিটা একটু রাখার চেষ্টা করব।
থিয়েটারের নির্দেশক অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে আমরা দেখেছি। 'চৌমাথা' থেকে 'পন্তু লাহা ২.০' বা 'বেরবার পথ নেই'। 'মন্দার' এবং 'বল্লভপুরের রূপকথা' দুইয়েরই শেকড় থিয়েটার। আপনার নির্দেশনার কিছু ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রভাষার সঙ্গে নাট্যআঙ্গিক কি মিশে গেছে কখনও? যদি যায়, তা কি সচেতন?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: ছবি রিলিজ করার পর থেকেই এই সংক্রান্ত আলোচনা চলছে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, চলচ্চিত্রভাষার সঙ্গে নাট্যআঙ্গিক কোনও দিন মিলতে পারে না। এটা অসম্ভব। এটা বোঝার জন্য আমাদের এই দুটো মাধ্যমেরই একদম গোড়ার কথায় ফিরে যেতে হবে। একটা প্রি-রেকর্ডেড ফর্ম, আরেকটা জ্যান্ত ফর্ম। দর্শকের চোখের সামনে ওই মুহূর্তে অনির্দেশ্য স্থানে কিছু মানুষ এসে একটা গল্পের মাধ্যমে ওই কালখণ্ডটাকে নির্দিষ্ট করে তুলছেন। তারপর, দু'ঘণ্টা, আড়াই ঘণ্টা বা তিন ঘণ্টা পর আবার সেই স্পেসটা অনির্দেশ্য হয়ে উঠছে। তার মানে জ্যান্ত মানুষ ছাড়া থিয়েটার সম্ভব নয়। যদি একটা স্টেজে হতে থাকা গোটা থিয়েটারকে যে কোনও একটা ক্যামেরা দিয়েও বন্দি করা যায়, তাহলে তা আর থিয়েটার থাকে না। যদি একটা পর্দা বা টিভি স্ক্রিনের সামনে থ্রি ডাইমেনশনাল হিউম্যান ফিগার নড়েচড়ে কিছু কথা বলে, এবং স্ক্রিনে চলা ছবিটার সঙ্গে সে শিল্পগতভাবে গল্পের একটা যোগসূত্র স্থাপন করে তার পারফরম্যান্সের মধ্যে, তাকেও সিনেমা বলা চলে না। এখন দু'জায়গা থেকে এই কথাটা আসতে পারে। একটা নাটকের টেক্সট নিয়ে এই ছবি। দ্বিতীয়ত, আমি এই ছবির পরিচালক, এই ছবিতে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁরা বেশিরভাগই নাটকের সঙ্গে যুক্ত। এই ঝোঁক থেকেই মূলত কথাটা আসছে। এখন যদি আমরা ওয়েস অ্যান্ডারসনের কাজ দেখি, 'দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল' বা 'দার্জিলিং লিমিটেড' দেখি, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, অনেক ক্ষেত্রেই তিনদিকে তিনটে দেওয়াল, এবং সামনে ক্যামেরাটা বসানো, রীতিমতো ওয়াইড শট, ডেপথ পর্যন্ত কম্পোজিশন চলছে, এই কাজগুলোকে কোনও দিনই কিন্তু আমরা থিয়েটারের মতো বলিনি। যদিও ওয়েস অ্যান্ডারসন থিয়েটার, সিনেমা- দুইই ডিরেক্ট করেছেন। আমার ধারণা, আশ্রয় নেওয়ার ক্ষেত্রে এইটা একটা সুবিধে হচ্ছে। যতটুকু সিনেমাটাতে নতুন লাগছে, অন্যরকম লাগছে, সেটাকে নতুন বা অন্যরকম না বলে থিয়েটারের মতো লাগছে বলাটাতে একটা সহজ আশ্রয় আছে। কিন্তু একটা সিনেমা প্রথম থেকে শেষ শট পর্যন্ত তা ফান্ডামেন্টালি থিয়েটার তো নয়ই, থিয়েটারের মতোও হতে পারে না।
আমাদের চোখ তো ওয়াইডেস্ট লেন্স, আমরা পুরোটাই প্রায় দেখতে পাই। থিয়েটার যখন আমরা দেখি, অর্থাৎ মঞ্চে যখন একটা নাটক চলছে, তখন নিশ্চয়ই আলাদা করে আলো ফেলে একটা চরিত্রকে বা একটা সেটের অংশকে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়, ম্যাগনিফাই করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু থিয়েটারকে যদি একটা সিরিজ অফ ফ্রেম ধরি, উইং, পিছনের ব্যাকড্রপ, ওপরের ফ্রিল- এই সবক'টা ফ্রেমেই কিছু উপাদান নির্দিষ্ট থেকে যাচ্ছে, সিনেমার ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। সিনেমাতে আমি সিলেক্টিভ ফ্রেম দেখি, সেই কারণে আমি একশো লেন্সে একরকমের ছবি দেখি, পঞ্চাশে এক, পঁয়ত্রিশে এক, ষোলোতে এক, বারোয় আরেক। যতটুকু আমি দেখতে চাইছি, ততটুকুই আমি সিনেমাতে দেখাতে পারি। থিয়েটারের ক্ষেত্রে তা কিন্তু হয় না। দ্বিতীয়ত, ক্যামেরা এমন কিছু মুভমেন্ট করতে পারে, যা কিন্তু আমাদের ন্যাচারাল চোখের মুভমেন্ট নয়, যেভাবে আমরা থিয়েটার দেখি। আমরা একটা জায়গায় বসে থাকি, তা মাটিতে হোক, মাঠে হোক, নাটকের মঞ্চের সেটে হোক; মোদ্দায় আমরা স্ট্যাটিক পোজিশনে বসে থাকি। সামনে যে ইমেজটা চলতে থাকে, সেখানে মানুষ নড়াচড়া করে, কিন্তু সেই ছবিটা, যা আমার সামনে আছে, সেখানে মানুষ নড়লেও ফ্রেমটা কিন্তু স্ট্যাটিক, অর্থাৎ আমাদের থিয়েটারের মঞ্চটা, সেটা অনড়। আবার আমরা সিনেমায় যখন আসি, তখন কিন্তু ট্র্যাক ইন করলে, জুম ইন করলে, প্রোফাইল ট্র্যাক করলে ফ্রেম বদলাতে বদলাতে যায়। আমাদের চোখ কিন্তু জুম ইন-জুম আউট করতে পারে না। ফলত, এই মূলগত জায়গা থেকেই সিনেমা ও থিয়েটার আলাদা হয়ে যায়। যাঁরা একে থিয়েটারের মতো সিনেমা বলছেন, তাঁদের বলায় ক্ষতি কিছু নেই। তাঁদের আবেগের প্রতি সম্মান জানিয়েই বলছি, আমার মনে হয়, এই আলোচনাতে ফান্ডামেন্টাল ভুলটা রয়ে যাচ্ছে, থিয়েটার আর সিনেমার ভাষা কখনও মিলতে পারে না। এটা মূলত দর্শকদের উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। ব্যাকরণগতভাবে নিশ্চয়ই বলা হচ্ছে না।
আমি অন্যরকমও কিছু করার চেষ্টা করেছি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, আমাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত যে মোড়কটা, সেটা ভেঙে অন্যরকম একটা অ্যাটিটিউড নিয়ে পর্দায় আসার, সেগুলো ওয়ার্ক করেছে কি করেনি, তা তো দর্শক বলতে পারবেন।
আপনি একবার বলেছিলেন থিয়েটারের নির্দেশনাতেই থাকতে চান, চলচ্চিত্র পরিচালনা নিয়ে সেরকম ভাবনা নেই। এখন একটি সিরিজ এবং সিনেমার পর আপনার পরিচালনা নিয়ে প্রভূত প্রত্যাশা। কোন নির্দেশনার মাধ্যম আপনি বেশি উপভোগ করেছেন?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: হ্যাঁ, আমার সিনেমা বা সিরিজ পরিচালনায় আসার খুব একটা ইচ্ছে বা তাগিদ ছিল না। কিন্তু অতিমারী আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এনেছে। বলা যেতে পারে, আমার সিনেমা-সিরিজ পরিচালনায় আসাটা অতিমারীর এক ধরনের বাইপ্রোডাক্ট। আমরা তখন সকলেই বসেছিলাম, তখন বলা হলো, আমি কোনও গল্প ডেভেলপ করতে আগ্রহী কি না। শুধু ডেভেলপ করা পর্যন্তই ব্যাপারটা ছিল। পরে 'মন্দার'-এর চিত্রনাট্য হয়ে যাওয়ার পর, সেটার বারকয়েক রিডিং হওয়ার পর মহেন্দ্র সোনি, মনিদা আমাকে ইনসিস্ট করেন যে, তোমারই এটা ডিরেক্ট করা উচিত। অন্য কোনও ডিরেক্টর এটা করলে সেখানে একটা ক্রিয়েটিভ বা নান্দনিক সংঘাত হতে পারে। সেই থেকেই শুরু হয়ে গেল পরিচালনার কাজ, তারপর এই ছবি। নাটক হোক বা সিনেমা-সিরিজ হোক, ঝুটঝামেলা যেগুলো থাকে, অত্যধিক ভয়ংকর পরিশ্রমের বাইরে যেটা থাকে, সেটাতে বেশ ভালই আনন্দ পেয়েছি, মজা পেয়েছি। থিয়েটার বা সিনেমা-সিরিজ, কোনওটাকেই বাড়িয়েকমিয়ে নম্বর দিতে পারব না। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে হয়তো দুটোই সাইমালটেনিয়াসলি করতে চাইব।
'মন্দার' পুরস্কার পেয়েছে সেরা সংলাপের জন্য। 'টিকটিকি'-র কিছুটা সংলাপ আপনার লেখা। 'বল্লভপুরের রূপকথা'-র ক্ষেত্রেও দেখা গেল, সংলাপে আপনি চাকচিক্য কম রাখেন, অথচ তা নানাভাবে মানুষের মনে গেঁথে যায়। এই সহজ সংলাপের ভাবনাটা যদি একটু বলেন।
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: প্রথমেই বলি, 'টিকটিকি'-র ক্ষেত্রে সংলাপ রচনার জায়গাটা যৎসামান্য। আমি এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, দু'জনেই শুটিংয়ের সময় ধ্রুবদার (বন্দ্যোপাধ্যায়) অনুমতি নিয়ে কিছু সংলাপ ব্যবহার করেছিলাম, যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রিঅ্যাকশন হিসেবে আসছিল আর কী। সেজন্যই কৃতজ্ঞতাবশত ধ্রুবদা আমাদের নাম রেখেছিলেন সংলাপে। আলাদা করে পেনে কাগজ ছুঁইয়ে সংলাপ লিখিনি। সংলাপের মিনিমালিজম আমাকে বরাবর টেনেছে। বেশি করে টেনেছে প্রতীকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হওয়ার পর। প্রতীকের সংলাপের মিনিমালিজম আমাকে মুগ্ধ করেছে। অনেক কথা না বলে অল্প কথা বলা, সরল কথা বলা। সেদিক থেকে প্রতীককে আমার সংলাপের খানিকটা শিক্ষক বলা যেতে পারে আর কী। আমি খুব ইমপ্যাক্টফুল ডায়লগ ভালবাসি। যেমন এই ছবিরই একটি সংলাপের কথা বলি। সেটা যদিও আমার লেখা, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে প্রতীকের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ছবির শেষকালে গল্পের নায়ক ভূপতিকে বলা হয়, আপনার জন্য আরেকটি প্রস্তাব অপেক্ষা করছে, যদি আপনার আপত্তি না থাকে। তখন ভূপতি বলে, আপনারা তো দেখলেন আমার কিছুই নেই, আপত্তিই বা থাকে কেমন করে। এইটুকু সংলাপে ওর অবস্থান, ওর রসবোধ, ওর একটু বদমাইশি, ছেলেমানুষি এবং অসম্ভব প্রখর বুদ্ধির ছাপ পাওয়া যায়, এই দুটো লাইন দিয়ে এতগুলো জিনিসকে ধরা যায়, সংলাপের মিনিমালিজমের ক্ষেত্রে এটা আমাকে খুব টানে। সাহিত্য পড়ার যেটুকু সুযোগ পেয়েছি, যতটুকু সময় আমি এখন পাই, খুব অল্প হলেও, সেখানে যেমন সংলাপ থাকে, সেগুলোই সংলাপ বলার বা লেখার ক্ষেত্রে আমার ট্রেনিং।
আরও পড়ুন: ‘হ্যামলেট’-এর মতোই আমরা প্রত্যেকে চাইছি প্রতিশোধ: কৌশিক সেন
সিনেমা করতে আসার পর আমি ফলো করার চেষ্টা করেছি, মূলত একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলে। কিন্তু এটাও আমি মনে করি, শুধুমাত্র জীবনের সংলাপ আদানপ্রদান তুলে দিলেই তা সিনেমা বা থিয়েটার হয়ে ওঠে না। ফলত, কাজটা একটু বেশিই কঠিন, যে জীবনের সংলাপের মতো শুনতে লাগবে, অথচ তা যেন জীবন থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, একটা এলিয়েনেশন নিয়ে। এটা সত্যিই প্রতীক খুবই মুনশিয়ানার সঙ্গে করে, সেটাকেই আমি খানিকটা ফলো করার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে লালদার (সুমন মুখোপাধ্যায়) থিয়েটার বা সিনেমার সংলাপও আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করে, উজ্জীবিত করে। এগুলোই আমার অনুপ্রেরণা বলা যায়।
আপনি অনেকদিন পর আবার অভিনয়ে ফিরছেন। বহু মানুষের নানা প্রত্যাশা জমে। ব্যোমকেশ হয়ে আসছেন ওয়েবে আবারও। কিন্তু তাছাড়া এমন কোনও ধরনের চরিত্র রয়েছে, যা এবার করতে চান?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: মুশকিলটা হচ্ছে, সিনেমার ক্ষেত্রে শুধু ইন্টারেস্টিং চরিত্রটা খুব বড় কথা নয়। সেটা আছে ঠিকই, কিন্তু সব ব্যাপার সেটা নয়, সেটা ছবি পরিচালনা করতে গিয়ে বুঝলাম। কীভাবে সেই চরিত্রটাকে প্লেস করা হচ্ছে, কীভাবে তাকে দেখানো হচ্ছে, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি অহংকার করে বলছি না, কিন্তু এর আগে এমন কাজ আমি করেছি, চিত্রনাট্য পাঠ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, এই চরিত্রটা বেশ প্রমিসিং হতে পারে, কিন্তু শেষত তা পরিণতি পায়নি নানা কারণে। নানারকম চরিত্রেই কাজ করতে চাই, এবং সবসময়ই অভিনেতা হিসেবে ভেতরে একটা খিদে থাকে যে, কোথায় অভিনয়টা ভালোভাবে দেখাতে পারব। আমাদের অভিনয়ের শেকড়ে সেটা আছে। আমরা তো সাহেব অভিনেতা নই, আমাদের ফোকে, আমাদের যাত্রায়, আমাদের থিয়েটারে- সবকিছুতেই সেটা আছে। বেশ ভালো করে অভিনয় করে 'অভিনয় করলাম', এটা দেখাতে পারার একটা ব্যাপার আছে। সেটা যে সবসময়ই খুব চিৎকার-চেঁচামেচি বা উচ্চকিত অভিনয়, তা কিন্তু নয়। ধরা যাক, 'মাই লেফট ফুট'-এ ড্যানিয়েল ডে লুইস যে অভিনয়টা করেন, বা 'স্কারফেস'-এ আল পাচিনো যে অভিনয়টা করেন, বা 'ঠগিনী'-তে উৎপল দত্ত এবং রবি ঘোষ যে অভিনয়টা করেন- এমন অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে অভিনয় দেখেই আমাদের মনে হয়েছে, 'ওফফ, কী অভিনয়!' সেরকম সুযোগ আমি খুব বেশি পেয়েছি আমার আট বছরের সিনেমার অভিনয়জীবনে, তা নয়। কিছু চরিত্র পেয়েছি। কিন্তু গ্রো করতে করতেও তো যেতে হয়, তার জন্য কনসিস্টেন্টলি ভালো চরিত্র পাওয়াটা খুব জরুরি। কিন্তু কনসিস্টেন্টলি ভালো চরিত্র পাওয়ার এবং ঘন ঘন ভালো পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ কিন্তু সবসময় পাওয়া যায় না।
'ব্যোমকেশ' হিসেবে আবার আসছি। দু'টি নতুন ছবিতে অভিনয় করেছি, যা পরের বছর রিলিজ করবে। দেখা যাক। আমি অন্যরকমও কিছু করার চেষ্টা করেছি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, আমাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত যে মোড়কটা, সেটা ভেঙে অন্যরকম একটা অ্যাটিটিউড নিয়ে পর্দায় আসার, সেগুলো ওয়ার্ক করেছে কি করেনি, তা তো দর্শক বলতে পারবেন। হ্যাঁ, কিছু নতুন জিনিস হয়েছে। এবার সেই নতুন জিনিসটা কতটা গ্রহণ করে মানুষ, তার পরীক্ষা পরের বছর হবে বলেই আমার ধারণা।
আপনি নানা ধরনের চরিত্র করেছেন। কিন্তু তাও কোথাও টাইপকাস্ট হওয়ার কোনও ভয় কাজ করে কি?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: না, আমি কখনও টাইপকাস্ট হয়ে যাওয়ার ভয় পাইনি। তার কারণ, সেরকম কোনও ঘটনা এখনও পর্যন্ত আমার অভিনয়ের কেরিয়ারে ঘটেনি। ভেরি ফরচুনেটলি, আমি এখনও পর্যন্ত এমন ধরনের চরিত্রই পেয়েছি, যেগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার কিন্তু তফাৎই থেকেছে। ব্যোমকেশ গোয়েন্দা চরিত্র, তার একটা স্ট্যাগন্যান্সি হয়তো থাকবেই। সেই লোকটা প্রখর বুদ্ধিমান, সব সলভ করে দেবে, সেই অবতারেই সে প্রতিটা গল্পে হাজির হবে। সেক্ষেত্রে গল্পের নিরিখে, চরিত্রের অন্য ঘাঁতঘোঁত আবিষ্কার করতে করতে যেতে হয়। তা বাদে, ভালো হোক, মন্দ হোক, সিনেমা চলুক বা না-চলুক, মানুষের ভালো লাগুক বা খারাপ লাগুক, এখনও পর্যন্ত এক ধরনের ভার্সেটাইল কেরিয়ার গ্রাফের ভেতর দিয়েই আমি গেছি। কাজেই না, টাইপকাস্ট হওয়ার ভয় আমি পাইনি।
'কলকাতার কিং' কোনও দর্শকই প্রায় দেখার সুযোগ পেলেন না, 'জোজো'-র মতো কিছু ছবিও দর্শক সেভাবে দেখেননি। আবার মঞ্চে খুব কম মানুষ 'এফএম মহানগর' দেখলেন। আফসোস হয় এই অভিনয়গুলো নিয়ে?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: সিনেমা তো শুধু নির্মাণ নয়, পরিবেশনাও তার অঙ্গ। যাঁরা 'কলকাতার কিং' বানিয়েছিলেন, তাঁরা হয় চাননি ছবিটা পরিবেশনা করতে, নয়তো অন্যরকম কোনও পরিকল্পনা করেছিলেন পরিবেশনার। আমি পরবর্তীতে শুনেছি, বিদেশে ছবিটা বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে, কোনও এক বছরের কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও দু'-একটা স্ক্রিনিং হয়েছিল, আমি নিজেও দেখেছি তেমন একটা স্ক্রিনিং। মানুষ এই ছবিটা দেখল না, এটা বলা ঠিক নয়। কারণ, 'কলকাতার কিং' সেভাবে মানুষের দেখার সুযোগই হয়নি। একই কথা বলব 'জোজো'-র ক্ষেত্রে। কারণ প্রথমত এই ছবিটা অত্যন্ত কম টাকায় তৈরি হওয়া ছোট বহরের ছবি। অর্ঘ্যদীপ খুবই কম রিসোর্সে চেষ্টা করেছিল একটা গল্প বলার। যদিও ছবিটার পনেরোটা মতো হোর্ডিং পড়েছিল কলকাতা শহরে, সেটা একটা ভালো দিক। কিন্তু ওই একই যুক্তি এক্ষেত্রে খাটে। এটা একটা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা, তার কিছু ব্যবসায়িক মডেল আছে। তার জন্য প্ল্যানিং লাগে, রিসোর্স লাগে। ভালো ছবি নির্মাণটাই তো শেষ কথা নয়, ভালো ছবি পৌঁছে দেওয়ার এক্সারসাইজটাও জরুরি। মানুষ ভালো ছবি দেখবেন, বেছে নেবেন, এটা যদি আমরা চাই, তাহলে তো যেনতেনপ্রকারেণ ছবিটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কারণ আমি একটা ছবি বানালাম, আমার মনে হলো, এটা গতানুগতিক ছবির থেকে অনেক ভালো ছবি, তাহলে তা কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বা আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মাপকাঠি হয়েই রয়ে যাবে, সেটা মানুষের কাছে পৌঁছবে না।
এর সঙ্গে একথাও বলতে হয় যে, ছবি পরিবেশনা বা ছবি অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক রকমের বাধা আছে। এটা খুব জটিল এবং কঠিন দুনিয়া। সিনেমা মানে একটা বিজনেস স্ট্রাকচারের মধ্যে ঢোকা। ব্যাপারটা এমন নয় যে, আমি বানাব, মানুষ দেখবে। ব্রিজটা এত সহজ নয়, ব্রিজটা খুব জটিল এবং যানজটপ্রবণ। ব্রিজটাতে জ্যাম হয়ে থাকে ভীষণ, ট্রাফিক আস্তে আস্তে সচল হয়।
'এফএম মহানগর'-এর শো খুব আশ্চর্যভাবে অ্যাকাডেমিতে দু'বার হয়েছে, দু'বারই হাউজফুল ছিল। জ্ঞান মঞ্চে ছাব্বিশ-সাতাশ জন দেখতেন। কেন, আমি জানি না। কারণ, ওই একই সময় আমি অন্য যে নাটকটা করতাম, 'অ্যান্টনি ও সৌদামিনী', সেটার প্রায় সব শো হাউজফুল হতো। নাটকটা বেশ কঠিন। আমি খুব আনন্দ পেতাম। আমার নাটকে পাওয়া চরিত্রদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্র, নাটকটাও অনবদ্য। কিন্তু ঠিক আছে, ইট ইজ হোয়াট ইট ইজ। এই ধরনের নাটক যে হইহই রইরই করে মানুষ দেখবেন, এমনটা আমরা ভাবিওনি। পরিচালক চেয়েছিলেন কুড়িটা শো করতে, কিন্তু তেরোটা না চোদ্দটা শো করে বন্ধ করে দিতে হয়, কারণ একেবারেই আর মানুষ দেখছিলেন না। এখন আমি তো 'এটা ফ্লপ নাটক', এই হিসেবে অভিজ্ঞতাটাকে নিইনি। আমার মনে আছে, সবচেয়ে বেশি রিহার্সাল করেছিলাম এই নাটকটার জন্য। ষাটটা রিহার্সাল করেছিলাম। সেই স্মৃতি, চরিত্রের স্মৃতি, চরিত্রটা তৈরি করার স্মৃতি- সেগুলো আমার সঙ্গে রয়েছে। এবং সেই স্মৃতিগুলো আমার কাছে চমৎকার নিঃসন্দেহে। অভিনেতা হিসেবে আমার গ্রো করার পথে ওটা একটা ফলক বলা যায়। হ্যাঁ, মানুষ বেশি দেখেনি ঠিকই। কিন্তু সেটা তো পার্ট অফ আওয়ার প্রফেশন। একজন অভিনেতা বা একজন পরিচালকের পেশাগত জীবন যদি সত্যিই লম্বা হয়, তাহলে তাকে এই সাফল্য-ব্যর্থতার টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যেতেই হবে।
আমি সারাজীবনে চারটে সিনেমা করলেও আমার কোনও অসুবিধে থাকবে না। কিন্তু এটা জরুরি যে, আমি ভালো সিনেমা করতে পেরেছি কি না।
'রাজা লিয়র' বা 'দেবী সর্পমস্তা'-য় আপনার শরীরী অভিনয় দর্শকদের চমকে দিয়েছিল। কিন্তু যে কোনও অভিনয়ে, মঞ্চে হোক বা পর্দায়, শরীর-মনের সমন্বয়টা আপনার কাছে কতটা জরুরি?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: এর উত্তর কথ্য বা লেখ্য-তে দেওয়া আমার পক্ষে খুব কঠিন। এটা সত্যি বলতে গেলে অভিনেতার শরীরেরই ব্যাপার। শরীর কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রেও ততটা জরুরি। সিনেমার অভিনয় নিয়ে একটা ধারণা আছে, ওটা বোধহয় কেবল মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি বদলানো আর সংলাপ বলা, ব্যাপারটা তা নয়। চলচ্চিত্রের অভিনয়েও শরীরের প্রয়োগ রীতিমতো জরুরি। কিন্তু এটাকে তত্ত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার হয়নি। এটা একটা চর্চার ব্যাপার, এটা একটা অভিজ্ঞতা, যা কেবল নিজের শরীর দিয়েই লব্ধ হয়। একজন অভিনেতা তার শরীর দিয়েই বুঝতে পারে, মাথা আর শরীর হাত ধরাধরি করে সত্যে পৌঁছচ্ছে কি না। এটা বলে বোঝানো যাবে না। আমার কাছে এটা ফিজিক্যাল এবং অর্গানিক। আমি তো অধ্যাপক নই, যতটা গভীরভাবে আমি এটাকে অনুভব করতে পারি নিজের শরীর দিয়ে, ততটা সুচারুভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। বললে বানিয়ে বলা হয়ে যাবে।
মঞ্চে 'মেফিস্টো'-র পর আবার আসছেন 'মারীচ সংবাদ'-এ। এই অনসম্বল অভিনয়টা ইতিহাস হতে চলেছে প্রায়। এই অভিজ্ঞতাটা যদি একটু বলেন।
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: 'মেফিস্টো'-র জন্য আমি খুবই উদগ্রীব। 'মেফিস্টো'-র ক্ষেত্রে আমার খুবই আগ্রহব্যঞ্জক লাগে দর্শকের জার্নিটা। ২০২১-এর নির্বাচনের আগে মানুষ একভাবে এই নাটকটাকে দেখেছেন, রিঅ্যাক্ট করেছেন, পরবর্তীতে তা বদলে গেছে। এরপর আবার কিছুটা বিরতি দিয়ে যখন অভিনয় হতে চলেছে, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা সত্যিই দেখার। 'মারীচ সংবাদ'-এর এই অভিনয় নিঃসন্দেহে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটতে চলেছে, সেটা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, কাজেই এই অভিজ্ঞতাটা আগে হোক, তারপর বোধহয় আরও ভালোভাবে এটা বলতে পারব।
আপনি জানিয়েছেন, কিছুদিন বিরতি নিয়ে আবার পরিচালনায় ফিরবেন। মঞ্চাভিনয়, চলচ্চিত্র অভিনয়, নির্দেশনা- সব ক্ষেত্রেই আপনি মাঝেমধ্যে বিরতি নিয়েছেন। এই বিরতিটা নেওয়া কি শিল্পীর জন্য দরকারি?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: মাঝেমধ্যে বিরতি নেওয়াটা ছোটবেলার একটা প্র্যাকটিস। বয়স যথেষ্ট কম থাকার সময় থেকেই এই প্র্যাকটিসটা করব বলে ঠিক করেছিলাম। আমার কিছু মাস্টারমশাই আমাকে সেটা শিখিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে তাঁরা যে সেগুলো খুব অনুসরণ করেছেন, তা নয়। তবে আমি চেষ্টা করেছি বজায় রাখার। হ্যাঁ, মাঝে কিছুটা সময়, লম্বা সময় আমি নতুন নাটকের অভিনয় থেকে বিরতি নিয়েছিলাম। আবার পরিচালনা থেকেও আমি কিছুটা বিরতি নিতে চাই। কারণ, আমার মনে হয় যে, অভিজ্ঞতা, একই জিনিসকে আরও দু'বছর সময় দিয়ে দেখা, আরও কিছু পড়া, বাড়তে থাকা বয়সের সঙ্গে, বাড়তে থাকা অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেগুলোকে ঝালিয়ে নেওয়া- একটা ভালো ছবি যদি আমি বানাতে চাই তাহলে এগুলো খুব জরুরি। আর আমাকে কোনও দিনই সংখ্যা খুব একটা ফ্যাসিনেট করেনি, আমাকে একশোটা অভিনয় করতে হবে বা আমাকে পঞ্চাশটা পরিচালনার কাজ করতে হবে- আমি যেহেতু এরকম কোনও সংখ্যার টার্গেট কোনও দিনই নিজের জন্য বেঁধে দিইনি, ফলত দরকার হলে আমি সারাজীবনে চারটে সিনেমা করব, তাতে আমার কোনও অসুবিধে থাকবে না। কিন্তু এটা জরুরি যে, আমি ভালো সিনেমা করতে পেরেছি কি না। সবসময় তা খুব ভালো নাও হয়ে উঠতে পারে, সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে। কিন্তু ইনটেন্টটা ভালো হওয়ার প্রয়োজন, সৎভাবে কাজটা করার প্রয়োজন, সে থিয়েটার হোক বা সিনেমা। সেই কারণেই বিরতির প্রয়োজন। আমার যে প্রসেস, তাতে আমার সময় লাগে, আমার 'মন্দার' করতে এক বছরের বেশি সময় লেগেছিল। 'বল্লভপুরের রূপকথা' করতে ঠিক এক বছর, গত পুজোর পর আমার কোভিড যখন হয়, তখন আমি প্রথম সিনটা লেখা শুরু করি, তারপর প্রতীকের সঙ্গে কাজ শুরু হয় ফার্স্ট ড্রাফটটা নিয়ে, আর ঠিক ২৫ অক্টোবর ছবিটা রিলিজ করল। এবার এভাবে একটা একটা করে বছর যদি আমি দিতে থাকি, তাহলে তো আমি আর অভিনয়টা করতে পারব না।
অতিমারীতে অসুখের থেকেও বেশি যেটা চোখে পড়ল, তা হল সময় ও সমাজের কোথাও একটা মোচড়, একটা বদল। শিল্পী হিসেবে আপনাকে কোথাও বদলে দিল সেটা?
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: অতিমারী আমাদের সবাইকে বদলেছে। অতিমারী খুবই দুর্ভাগ্যজনক একটা সময়কাল। অসুস্থ যাঁরা হয়েছেন, এত মানুষ মারা গেছেন, সেটা তো একটা চরম দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। তার চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক, আমার ধারণা, অতিমারী আমাদের মানুষ হিসেবে আরও ক্ষুদ্র করে দিয়েছে। অতিমারী থেকে আমাদের কোনও পজিটিভ গেন নেই। আমার অন্তত চারপাশ দেখে যা মনে হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে অতিমারীর পর সবচেয়ে বড় যে ঘটনা ঘটল, সেটা হলো একটা যুদ্ধ। আমরা পৃথিবীর একপ্রান্তে বোমা-গুলি-কামান-কামান চলতে দেখলাম, অন্য প্রান্তে দেখলাম উড়ন্ত প্লেন থেকে ঝুলন্ত মানুষ। মানবিকতাকে নাড়িয়ে দেওয়া সব ছবি। সমাজের ছোট ছোট ক্ষেত্রে যে বদলগুলো দেখছি, সেগুলো কোনওটাই পজিটিভ নয়, কোনওটাই নয়। অতিমারীর প্রথমে যে স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখে মনে হয়েছিল, মানুষ বুঝি একটা উত্তরণের দিকে যাবে, কিন্তু যা ঘটল, তার পুরোটাই অবতরণ। অতিমারী আমাদের মৃত্যু, জরা, অতল অন্ধকার এবং একটা ঝাপসা ভবিষ্যৎই দিল, এখন এসে তাই মনে হয়। অতিমারী থেকে প্রায় কিছুই ভালো বের করে আনতে পারিনি আমরা, ওই কয়েকদিনের লুডো খেলা, একটু সাহিত্যচর্চা এবং ডালগোনা কফি বানানো ছাড়া।