আনিস কাণ্ড মনে করাচ্ছে রিজওয়ান স্মৃতি, সুবিচার পেয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কার স্বামী?
বামঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতা আনিস খানের খুনের প্রতিবাদে উত্তাপ ছড়াচ্ছে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তেই । আমতা, পাঁচলা এইসমস্ত জায়গায় ক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতায়। একাধিক জায়গায় মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, শহীদ স্মরণ এর মঞ্চে মোমবাতি জ্বালানো, আনিস খানের সুবিচারের দাবিতে প্রতিবাদ নেমে এসেছে কলকাতার রাজপথে। আনিস খানের বাবা সালেম খান চাইছেন সুবিচার। আজ থেকে বছর ১৫ আগেও ঠিক এই ভাবেই রিজওয়ান-উর রহমান এর জন্য কলকাতার রাজপথে নেমে এসেছিল প্রতিবাদ। সেদিন ছেলের জন্য ইনসাফ চেয়ে ছিলেন রিজওয়ান-উর রহমানের মা কিশোয়ার জাহান। কান্নাভেজা গলায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সামনে আর্তি রেখেছিলেন, ' মুঝে ইনসাফ চাহিয়ে.... মেরে বেটে কে লিয়ে ইনসাফ চাহিয়ে।'
সময় বদলালেও, সন্তানহারা বাবা মায়ের যন্ত্রণা কোনোদিনই বদলায় না। আজকে আনিসের মৃত্যুর ঘটনায় যেভাবে পুলিশের বিরুদ্ধে আঙুল উঠছে, সেদিনও ঠিক একইভাবে পুলিশ অফিসারদের একাংশের বিরুদ্ধে উঠেছিল চক্রান্তের সামিল হওয়ার অভিযোগ। আজ যেমন পুলিশের বেশে কারা আনিসের বাড়িতে হানা দিয়েছিল, সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সেভাবেই রিজওয়ানুরের মৃত্যুর মামলাতেও আতসকাচের তলায় এসেছিল পুলিশের ভূমিকা। প্রশ্নের মুখে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের শাসন ব্যবস্থা। আজ, আনিস খান হত্যা মামলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি সিটের মাথা জ্ঞানবন্ত সিংয়ের বিরুদ্ধে উঠেছিল রিজওয়ানুর মামলায় প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ। সেদিন সুবিচারের দাবিতে শুরু হয়েছিল এক আপসহীন লড়াই। আজকে আনিসের বাবা যেভাবে ছেলের মৃত্যুর বিচার চাইছেন, ঠিক এভাবেই কলকাতার রাজপথে উত্তাল হয়ে উঠেছিল আজ থেকে ঠিক বছর ১৫ আগে।
কী ঘটেছিল আজ থেকে ১৫ বছর আগে?
দিনটা ছিল, ২০০৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। পাতিপুকুর রেল লাইনের ধার থেকে উদ্ধার হয়েছিল পেশায় গ্রাফিক্স ডিজাইনার রিজওয়ান-উর রহমানের মৃতদেহ। এক অসম প্রেমের মর্মান্তিক উপাখ্যান রচিত হয়েছিল সেদিন। রিজওয়ানুর ছিল গরিব মুসলিম ঘরের এক ছেলে। ছোট থেকেই পড়াশোনায় বেশ তুখোড়। গ্রাফিক্স ডিজাইনিং এবং ছবি আঁকার দিকেও ঝোঁক ছিল ছোট থেকেই। সেই সূত্রেই, রিজওয়ানুরের আলাপ হয় লাক্স কোজি কোম্পানির মালিক অশোক টোডির মেয়ে প্রিয়াঙ্কা টোডির সঙ্গে। আলাপের পরে বন্ধুত্ব, তারপর সেই বন্ধুত্ব গড়ায় প্রেম পর্যন্ত। তারপর ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে একটি বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তারপরেই শুরু সমস্যা। পরিবারকে না জানিয়েই তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তারপর আবার প্রিয়াঙ্কাকে নিজের বাড়িতেও নিয়ে এসেছিলেন রিজওয়ানুর। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে রিজওয়ানুরের বিয়ে মেনে নিতে পারেননি তার বাবা অশোক টোডি। মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার জন্য বারবার চাপ দেওয়া হয় রিজওয়ানুরের পরিবারকে।
অনেকে মনে করেন, রিজওয়ানুরের পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা একমাত্র কারণ ছিল না। তার ভিন্ন ধর্মের হওয়া ছিল আরো একটি বড় কারণ। প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখিয়ে তারা কোনমতেই মেয়েকে নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু, সমস্যা হয়ে যায় যখন রিজওয়ানুর তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। টোডি পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রিজওয়ান-উর রহমান। কিন্তু তার আগেই, সব শেষ! ২০০৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, দুর্গাপূজার হাতে গোনা দিন আগে পাতিপুকুর রেল লাইনের ধারে উদ্ধার হয় রিজওয়ান-উর রহমানের নিথর দেহ। নিজের প্রেমের জন্য প্রভাবশালী পরিবারের সঙ্গে লড়াইয়ে হার মানেন রিজওয়ান-উর রহমান। কিন্তু রিজওয়ান-উর রহমানের মৃত্যু কিভাবে হল? সেটা কি আত্মহত্যা ছিল নাকি এর পিছনে কারো প্ররোচনা ছিল? নাকি, রিজওয়ান-উর রহমান কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন, একের পর এক রহস্য কার্যত উত্তাল হয়ে উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গ।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
হাওড়ার আমতায় আনিস কাণ্ডে যেভাবে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, ঠিক সেভাবেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল রিজওয়ান-উর রহমান এর মৃত্যুতেও। বিশেষ করে প্রভাবশালী টোডি পরিবারের সঙ্গে নাকি লালবাজারের একাংশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথম থেকেই রিজওয়ানুর রহমানের পরিবার অভিযোগ তুলে আসছিল, তাদের ছেলেকে হত্যা করেছে ওই টোডি পরিবার। কিন্তু পুলিশের তরফ থেকে সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, রিজওয়ান-উর রহমান খুন হননি, বরং তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। এছাড়াও, তৎকালীন বাম সরকারের বিরুদ্ধেও উঠতে শুরু করেছিলো প্রশ্ন। রিজওয়ান-উর রহমান এর তিলজলার বাড়িতে যখন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আসেন, সেই সময় রিজওয়ানুরের মা তাকে আর্জি জানিয়েছিলেন যেন তার ছেলের মৃত্যুতে সিবিআই তদন্ত করা হয়। পাশাপাশি, তৎকালীন কলকাতা পুলিশের অফিসার জ্ঞানবন্ত সিং এর বিরুদ্ধেও উঠেছিল প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ। যদিও ভিজিলেন্স সেল এই ঘটনায় জ্ঞানবন্ত সিং এর জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পায়নি। তবে সিবিআই তদন্ত হয়েছিল এই মামলায়।
তদন্ত শেষের পর সিবিআই জানায়, ঘটনাটি আত্মহত্যা হলেও তাতে অন্য কারো প্ররোচনা ছিল। অশোক টোডি, প্রদীপ টোডি, অনিল সারোগি, পুলিসকর্মীর সুকান্তি চক্রবর্তী এবং কৃষ্ণেন্দু দাস, আইপিএস অজয় নন্দা, এবং সৈয়দ মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। শুরু হয় মামলা। পুলিশের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ ছিল, প্রিয়াঙ্কাকে বিয়ে করার পর যখন রিজওয়ান-উর রহমান তাকে নিজের পার্কসার্কাসের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, সেই সময় প্রভাবশালী টোডি পরিবারের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুলিশের দ্বারস্থ রিজওয়ানুরের পরিবার। তবে প্রিয়াঙ্কা জানিয়েছেন, পুলিশ নাকি তাকে পুরোপুরি কিছু না জানিয়ে তাকে কিছু বিশেষ কাগজে সই করিয়ে নেয়। জানা যায় ওই পরিবারের সঙ্গে পুলিশের একাংশের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এই কারণে রিজওয়ানুরের পরিবারকে একাধিকবার পুলিশি জেরার মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি, অপহরণ এবং খুন করার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু তার পরেও, লাভ তেমন কিছু হয়নি। সিবিআই তদন্তেও আত্মহত্যার বিষয়টি আরো প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা
রিজওয়ান-উর রহমান ঘটনা রীতিমতো টলিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার ভিত। সমস্ত বিরোধী দলগুলি নেমে এসেছিল রাস্তায়। জায়গায় জায়গায় পথ অবরোধ, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা পশ্চিমবঙ্গ। এই বিক্ষোভের আঁচ গিয়ে পড়ে সরাসরি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। অবস্থা বেগতিক দেখে আসরে নামেন স্বয়ং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিক্ষোভ সামাল দিতে তিনি নিজে ছুটে যান রিজওয়ান-উর রহমানের বাড়িতে। আশ্বাস দেন ন্যায়বিচারের। কিন্তু, বাম সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আঁচ কোন অংশেই কমেনি। তৎকালীন সময়েও গঠিত হয়েছিল একটি সিট। কিন্তু, শেষমেষ সিবিআই তদন্ত পর্যন্ত গড়ায় এই মামলা।
তবে, রিজওয়ান-উর রহমান কাণ্ডে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাম সরকারকে রীতিমতো তুলোধোনা করে ছেড়েছিলেন। ন্যায়বিচারের দাবিতে একাধিকবার কলকাতার রাজপথে মেসির করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নাগরিক সমাজের তরফে এবং বিরোধী শিবিরের তরফে চাপ বাড়ানো হয় বাম সরকারের ওপর। বিরোধীদের ক্রমাগত চাপের মুখে পড়ে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কার্যত স্বীকার করেন, কলকাতা পুলিশের ৫ জন পুলিশ কর্তার ভূমিকা ছিল সন্দেহজনক। কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানবন্ত সিং এবং অজয় কুমার সহ ৫ জন পুলিশ কর্তার বিরুদ্ধে ওঠে প্রশ্ন চিহ্ন।
ভোটে প্রভাব
এই রিজওয়ান-উর রহমান হত্যাকাণ্ড বামেদের সংখ্যালঘু ভোটব্যাংকে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। বামেদের এই সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকের একটা বড় অংশ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে মমতার দিকে চলে যায় বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। সবথেকে বড় বিষয়টি হলো, রিজওয়ান-উর রহমানের দাদা রুকবানুর রহমানকে ২০১১ সালে নদীয়ার চাপড়া কেন্দ্র থেকে প্রার্থীও করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই থেকে টানা তিনবার ওই একই কেন্দ্র থেকে জিতে এসেছেন রুকবানুর। তিনি এখন তৃণমূল বিধায়ক।
রিজওয়ানুর রহমানের মামলা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?
প্রায় ১৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এখনো রিজওয়ানুর মৃত্যু মামলার কোন নিষ্পত্তি হয়নি। ব্যাঙ্কশাল আদালতে এই মামলার এখনো কোন রায় ঘোষণা হয়নি। সেশন কোর্টে এখনো চলছে সাক্ষ্য-প্রমাণ নেওয়ার কাজ। অন্যদিকে, বছর দুয়েক আগে বিবাহ সেরে এখন বেশ সুখেই প্রিয়াঙ্কা। সে দিকেও তেমন একটা কারো নজর নেই। হয়তো, আর কারো মনেও থাকত না রিজওয়ানুরের ব্যাপারটা। কিন্তু, আমতার এই ঘটনা আবারো স্মৃতি তাজা করল ১৫ বছর পুরনো সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের, থুড়ি আত্মহত্যার।
প্রতিশ্রুতিই কি সব?
২০০৭ সালে যখন রিজওয়ান-উর রহমানের ঘটনাটি ঘটেছিল সেই সময় তৎকালীন বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সঠিক কাজ করবে কলকাতা পুলিশ। পরিবারকে চাকরির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। কিন্তু, সুবিচার এখনো অধরা। ১৫ বছর পরে আনিস খান মামলায় মমতাও দিলেন সুবিচারের প্রতিশ্রুতি। সঙ্গেই রইল চাকরির প্রতিশ্রুতিও। নবান্নে এসে আনিসের বাবাকেও দেখা করার আহ্বান জানিয়েছেন মমতা। তৈরি হয়েছে সিট। হচ্ছে তদন্ত। গ্রেফতার কয়েকজন পুলিশকর্মী। সেবারেও তদন্ত এগিয়ে ছিল ঠিক একইভাবে। সেবারেও প্রশ্ন উঠেছিল পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। প্রশ্ন তুলেছিলেন মমতাই, তখন ক্ষমতায় ছিল বাম। ১৫ বছরের মধ্যেই পাল্টে গিয়েছে অনেক কিছু। তৎকালীন শাসকদল এখন বিরোধী শিবিরে। আর তৎকালীন বিরোধী এখন ক্ষমতায়। সেই সময় মমতা বলেছিলেন, সিআইডি তদন্তে সত্যি বেরোবে না, চাই সিবিআই। আর, ১৫ বছর পরে যখন আনিস খানের রহস্যমৃত্যুতে মৃতের পরিবার চাইছে সিবিআই, তখন রাজ্য পুলিশের উপর ভরসা রাখতে অনুরোধ করছেন মমতা।
রিজওয়ান-উর রহমান কাণ্ডে দোষীদের শাস্তি দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে যিনি ছিলেন অর্থাৎ তার দাদা রুকবানুর, তিনি এখন তৃণমূল বিধায়ক। রিজওয়ানুর কান্ডের অন্যতম অভিযুক্ত জ্ঞানবন্ত সিং এবারে আনিস কাণ্ডে গঠিত সিটের মাথা। রিজওয়ানুরের পরিবার তো সেদিন জ্ঞানবন্তের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে, সংবাদমাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে রিজওয়ানুরের দাদা এখন বলছেন, "এটা ঠিকই। কিন্তু পরবর্তীকালে সিবিআই জ্ঞানবন্ত সিংকে ক্লিনচিট দিয়েছিল।" এবং সেজন্যই অধুনা তৃণমূল বিধায়ক মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রী যখন দায়িত্ব দিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই ভেবে চিন্তেই কাউকে দায়িত্ব দিয়েছেন। সুতরাং, সিবিআই তদন্তের আর প্রয়োজন কি! এখন তো রিজকান্ডের অভিযুক্তরা ভালো মানুষ!