অঞ্জনের প্রিয় বন্ধু: শিকড়হীন আর শিকড়গাঁথাদের সংলাপ
Anjan Dutta Priya Bandhu: অর্ণব কমলা এজেন্সির চাকরি ছাড়ে সদর্পে। অঞ্জন বারবার বোঝান, চাকরির দিনগত আবর্তে আটকে থাকা অর্ণবদের ধর্ম নয়।
যখন 'প্রিয় বন্ধু' শুনেছি, তখন জানতাম না, আসমা চৌধুরী জয়িতা বা জয়ী, আদরের নামে, আদতে শিকড় খুঁজতে কোন দেশে যাবে! তখন ক্লাস ইলেভেন। বাংলার একটি সুপরিচিত এফএম চ্যানেল তখন বেশ কিছু অডিও প্লে সম্প্রচার করে, প্রতি রোববার দুপুরে। তখন স্মার্টফোনহীন, সামান্য মোবাইলের রেডিও অ্যাপ যেমন আছে, তেমন তখনও, রেডিও নামে যন্ত্রটাও আছে কিছু বাড়িতে। উত্তর কলকাতার, বাগবাজারি আবহে, শাক্ত-তামস পাঁচমিশালির মধ্যে মানিকতলার অর্ণব এসেছিল আমার কাছে, রেডিওর হাত ধরে। তার সঙ্গে প্রতিটি পল আমি মেলাতে পারতাম। তখনও শিখিনি, স্কুলের সহপাঠী থেকে 'প্রিয় বন্ধু' হয়ে ওঠা দূরের কারও সঙ্গে কথা বলার ভাষা।
অঞ্জন দত্ত, তারও আগে, অন্য একটি এফএম চ্যানেলে বাচ্চাদের নিয়ে একটি প্রোগ্রাম করতেন। সেই অনুষ্ঠানে তখনও মজে থাকতাম, কারণ, তখনও শৈশব কাটেনি। বয়ঃসন্ধি যখন আস্তে আস্তে টোকা দিতে শুরু করেছে মন-হরমোনের দরজায়, তখন প্রথম একটু একটু পাকিয়ে দিয়েছে 'চ্যাপটা গোলাপ'। যে স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ম ভাঙার মন আছে, নিয়ম ভাঙার বয়স নেই, তাদের কথা অঞ্জন ছাড়া আর কে লিখেছেন মনের মতো করে? কোন অঞ্জন? যাঁকে নিয়ে বাঙালির কল্পলোক পার্ক স্ট্রিট থেকে দার্জিলিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ, না কি সেই অঞ্জন, যাঁর টেলিফিল্মে দেখেছি 'দীপা সুলতানার তিনদিন', গোধরা-পরবর্তী গুজরাত দাঙ্গার (না কি সুপরিকল্পিত গণহত্যা!) বিক্ষুব্ধ সময়ের আখ্যান, বা 'বাবার ক্রিস্টমাস'-এর মর্মস্পর্শী উদযাপনের গল্প, বা রুদ্র সেনের রোড মুভি এবং 'গরম গরম গল্প'-র মতো কমেডি থ্রিলার বা 'রাশিয়ান রুলে'-র মতো রিভেঞ্জ ড্রামা ও হুডানিট থ্রিলারের ককটেল— সেই বিচিত্র, ছকে না বাঁধা, রংবেরঙের অঞ্জন?
আরও পড়ুন: অপ্রাপ্তির ভিতর দিয়ে বন্ধুত্বের সেতু গড়ে দেয় যে কবিতারা
আদতে অঞ্জন জানেন অচেনা গল্প সেই ভঙ্গিতে বলতে, যা চেনা লাগে হঠাৎই কোনও চলমান অশরীরি গোধূলিতে। এসব ম্যানড্রেকীয় নয়, বরং সহজ রঙের তাস। অঞ্জন তাই অর্ণবের দাদার যে গল্প বলেন, তেমন গল্প বুদ্বুদের মতো ভেসে ওঠে কিছু কিছু স্মৃতিতে। বন্ধুদের পোস্টার রাখার জন্য তালতলা থানায় পুলিশের মার খেয়ে, পরে 'কিডনি ফেলিওর' হয়ে মারা যাওয়া সেই দাদারা সত্তর জুড়েই ছড়িয়ে। ঠিক সেসময়ই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ। হয়তো পরে জয়িতা সেখানে নিজের দেশ খুঁজে পাবে। কিন্তু যে-সময়ের এপার-ওপার বাংলা বিক্ষুব্ধ, তখন অর্ণব তার দূরের শহরের জয়িতাকে যে যে চিঠি লিখেছে, সেসবে সময়ের চিহ্নগুলো পুঁজরক্তসমেত ফুটে উঠছিল।
চিঠিপত্রের প্রেমালাপ বিশ্বসাহিত্যে বহু ব্যবহৃত। কিন্তু অঞ্জন ও নিমা রহমান অভিনীত 'প্রিয় বন্ধু', শ্রুতিনাটকের বাইরেও যদি টেক্সট হিসেবে তার পাঠ সম্ভব হয়, তাহলে তাকে কি প্রেমের চিঠি বলা হবে? স্কুলের কাঁচা প্রেম পাকিয়ে ওঠে পরিণত বন্ধুত্বে, বয়স হলে প্রেমে পাক ধরে, কবীর সুমনের পঙক্তি মাথায় রেখেই তাই 'প্রিয় বন্ধু' ছাপিয়ে যায় প্রেমকে, তৈরি করে এক আবহমান যোগাযোগের সূত্র, ভূগোল পেরিয়ে। আর এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ছিন্নমূলের বয়ান। অর্ণবের মায়ের মৃত্যু অর্ণবকে বুঝতে শেখায়, তার মানিকতলার বাড়ি আসলে মায়ের আঁচলেই লেপটে ছিল এতদিন। কিন্তু তাও সে শিকড়হীন হয় না কিছুতেই। সে জয়ীর বিবাহপ্রস্তাব ফেরায়, ফেরায় বিলাসবহুল চাকরির প্রস্তাব। একা একা জিন খেয়ে বৃষ্টিস্নাত ঘোড়ার গাড়ি চড়ার কলকাতা সফরের বিষাদ সে বরণ করতে চায়।
বারবার ভাঙে চিঠির সূত্র। বারবার দূরত্বের সেতু তৈরি হয়। জয়ী বিয়ে করে, বিয়ে ভাঙে বারবার, শহর বদলাতে থাকে। অর্ণব অন্যদিকে কমলা এজেন্সির চাকরি ছাড়ে সদর্পে। অঞ্জন বারবার বোঝান, চাকরির দিনগত আবর্তে আটকে থাকা অর্ণবদের ধর্ম নয়। অঞ্জন তাঁর গান ও ছবির গল্পকে জোড়েন এমন ভবঘুরে চরিত্রদের বিনিসুতোয়। অঞ্জনের গোয়েন্দা সুব্রত শর্মা ক্রাইম রিপোর্টারের চাকরি ছাড়ে দুর্নীতির পাকচক্রকে প্রত্যাখ্যান করে, 'চলো লেটস গো'-র সঞ্জয় সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে বন্ধুদের সঙ্গে নানা উদ্যোগে মাততে মাততে, একদিন ঠিক পেয়ে যায় সিনেমাকে, রেস-খেলা শেখর একদিন গায়ক হয়ে যায়, অসীম বলে, জীবনে টাকা রোজগারের চেয়েও বড় কিছু আছে, সে পাহাড়ের বুকে এক মিশনারি হোমে আজীবনের গাঁটছড়া বাঁধে, 'রনো আর ভিকি'-র শেষে রনো তার উইগ খুলে ফেলে, ভেবে নেয়, সিরিয়ালের জগৎ সে ছেড়ে চলে যাবে। ভবিষ্যৎচিন্তা ও বাঙালির তথাকথিত সাফল্যের মাপকাঠিকে তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে অঞ্জন দত্ত খুঁজে নিতে বলেন মুক্তি, জীবনের যে মানে হয়তো কোনওদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্ণবও তাই হঠাৎ গান খুঁজে পায়। আর জয়িতা, সে শিকড়সন্ধানী হয় অবশেষে, শহরের পর শহরকে সে ভালবাসতে থাকে, কিন্তু সব শহরই তাকে ঠাঁইনাড়া করে, সাকিন দেয় না।
আরও পড়ুন: নির্ভেজাল, নিঃশর্ত বন্ধুত্বে বিশ্বাস করেননি সত্যজিৎ?
'প্রিয় বন্ধু' তাই শিকড়হীন আর শিকড়গাঁথা দুই নারীপুরুষের সংলাপ, যে সংলাপ ফুরোয় না। যে সংলাপ প্রেমের পরিণতি দেবে না কোনওদিন। অর্ণব যেমন কলকাতা ছাড়ে না, জয়ীও কলকাতা ফেরে না। দু'জনেই দূরত্বকে ভালবাসতে থাকে, আর দু'জনের মধ্যে তৈরি হতে থাকে তিলে তিলে, চিরদিনের সাঁকো।
এই শ্রুতিনাটক প্রায় মিউজিক্যাল। এর মধ্যে অঞ্জনের নিজের দু'টি গান 'প্রিয় বন্ধু'-র মূল সূত্র রচনা করে। একটি গান এই শ্রুতিনাটকের মাঝে আসে, যখন অর্ণব জানিয়ে দেয়, কলকাতা ছেড়ে সে যাবে না। প্রায় ভুতুড়ে সুরে ও গায়কিতে সেই গান চলে, কারণ কলকাতার ভূত আসলে পেয়ে বসে অর্ণবকে।
'করব যে আর কত ঘেন্না
নিজেই নিজের ছায়াটাকে
করব যে আর কত অপমান
আবার তো সেই আষ্টেপৃষ্ঠে
জড়িয়ে নিজের নরকটাকে
গাইব আমি ভালবাসার গান'
'আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ', সুনীলের এই উচ্চারণকেই উল্লেখ করা হচ্ছে যেন, শহরের প্রতি এই গাথায়। 'প্রিয় বন্ধু' তাই কলকাতা অপেরা, দূরের শহরে তা যায় চিঠির আকারে, ঘেঁটে দেখলে কি স্বরলিপি পাওয়া যেত? ভিয়েনাবাসী মিলেনাকে লেখা কাফকার বিরহের চিঠি নয়, বরং ন্যাবা আর জয়ী দূরেই থাকতে চেয়ে চিঠি লেখে পরস্পরকে। আজ কি জয়ী বাংলাদেশের শাহবাগের, চট্টগ্রামের জমায়েতে কোথাও লুকিয়ে? ন্যাবা কি সেদেশের জন্য গান বাঁধবে?