বিশ্বকাপের আগেই স্ত্রীর সঙ্গে তুলকালাম! আলোর আড়ালে থেকেই বিশ্বকাপ জয় রদ্রিগো ডি'পলের
Rodrigo De Paul Argentina World Champion: এ বছর জুলাই মাসে রদ্রিগোর প্রাক্তন স্ত্রী ক্যামেলিয়া হোমস তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
বিশ্বকাপের স্কোর শিটে তাঁর নাম আপনি দেখতে পাবেন না। নেই কোনও অ্যাসিস্টও। তবে একটি বিষয় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তাঁর ডেডিকেশনের কথা। তিনি বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন দলের মাঝ মাঠের অন্যতম স্তম্ভ, রদ্রিগো ডি'পল। ফ্রান্স আর্জেন্টিনা ম্যাচের সবাই মেসির কথা বলছে, ডি'মারিয়ার কথা বলছে, এমিলিয়ানো মার্তিনেজের কথা বলছে, এমবাপের কথা বলছেন। কিন্তু কেউই বলছেন না রদ্রিগো ডি'পলের কথা। ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জীবনের অন্যতম সেরা খেলা খেলেছেন তিনি। খেলার প্রথমার্ধে তো জিরু, এমবাপে, গ্রিজম্যান, তুয়েচেমেনিদের উঠতেই দেননি তিনি। এনজো ফার্নান্দেজকে সঙ্গী করে মাঝ মাঠেই রুখে দিয়েছিলেন ফ্রেঞ্চ আর্মিকে। গোটা বিশ্বকাপ জুড়েই মাঝ মাঠে চমকপ্রদ খেলা খেলেছেন তিনি। দরকারে আলভারেজ, ম্যাক অ্যালিস্টার, মেসিদের জন্য আক্রমণ তৈরি করেছেন আবার প্রয়োজনে মোলিনা, রোমেরোদের সঙ্গে ডিফেন্স সামলেছেন। আবার সময় মতো, পেনাল্টি শুটআউটেও নিজের ঠান্ডা মাথার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। সাত নম্বর জার্সিধারী এই প্লেয়ার আক্ষরিক অর্থেই টোটাল ফুটবলার।
আর্জেন্টিনা মিডফিল্ডে এক ভরসার প্রতীক রদ্রিগো ডি'পল। দুর্দান্ত ফর্মের মাধ্যমে দলে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেছেন অনেক আগেই। বিশ্বকাপের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচেই ডি'পল পূর্ণ ৯০ মিনিট খেলেছেন। ময়দানে মেসি এবং ডি'পলের জুটি চোখ জুড়িয়ে দেবে। মেসি যখন আক্রমণ তৈরি করেন তখন মেসিকে কভার করেন রদ্রিগো ডি'পল। খেলার মাঠে অনেকেই বলেন তিনি মেসির বডিগার্ড। কেউ যদি মেসিকে ফাউল করে বা ট্যাকল করে তাহলে তাঁর অবস্থা খারাপ করে দেবেন ডি'পল। এর কয়েকটি ঝলক অবশ্য এই বিশ্বকাপেই দেখা গিয়েছে। প্রতিপক্ষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য একজন ডি'পলই যথেষ্ট আর্জেন্টিনার। এবারের বিশ্বকাপেও প্রথম থেকেই মাঝ মাঠে নিজের কর্তৃত্ব দেখিয়ে খেলেছেন রদ্রিগো ডি'পল। বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডেও নজর কাড়া পারফরম্যান্স করেছিলেন রদ্রিগো ডি'পল এবং এই বিশ্বকাপের শেষে নিজেকে বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে একই আসনে বসালেন তিনি। গত বছর আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকা জিতেছিল। সেই টুর্নামেন্টেও নিজের ছাপ রেখে যান রদ্রিগো। তাঁর এবং এনজো ফার্নান্দেজের জুটিকে যেন বিশ্বকাপের জন্যই তৈরি করছিলেন কোচ লিওনেল স্কলোনি।

মাঠে মেসির বডিগার্ড তিনি
তবে রদ্রিগো ডি'পলের আরও প্রশংসা করতে হবে তাঁর মানসিক দৃঢ়তার জন্য। বিশ্বকাপের আগেই ব্যক্তিগত জীবনে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল তাঁর। অনেকেই মনে করেছিলেন এবারের বিশ্বকাপ খেলা হবে না রদ্রিগো ডি'পলের। এ বছর জুলাই মাসে রদ্রিগোর প্রাক্তন স্ত্রী ক্যামেলিয়া হোমস তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ বিবাহ বিচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি মতো সন্তানদের দেখভালের জন্য খোরপোষ দিচ্ছেন না তিনি। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে তখন আইনি লড়াইয়ে ব্যস্ত ডি'পল। আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও জানিয়ে দেওয়া হয়, ব্যক্তিগত জীবনের ঝামেলা মিটিয়ে তবেই দলে ফিরতে। কয়েক মাস আগেও যে বিশ্বকাপ নিশ্চিত মনে হয়েছিল, তা অনিশ্চিত হয়ে যায় ডি'পলের জন্য। শোনা যায় নিয়মিত ফোন করে রদ্রিগো ডি'পলকে সাহস জোগাতেন লিওনেল মেসি। কিন্তু পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে যায় যখন আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ডি'পলের রিপ্লেসমেন্ট খুঁজতে শুরু করে দেয়। অবশেষে মামলার মীমাংসা হয় এবং বিশ্বকাপের ফাইনাল স্কোয়াডে নিজের নাম নথিভুক্ত করান রদ্রিগো ডি'পল। কঠিন সময়ে সংযম না হারিয়ে, মাথা ঠান্ডা রেখে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যান ডি'পল। মাঠেও তাঁর সেই চরিত্রের প্রতিফলন হয়।

রদ্রিগোর ব্যক্তিগত জীবন টালমাটাল
হবে নাই বা কেন, ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তাঁকে সংঘর্ষ করতে হয়েছে। ২৪ মে, ১৯৯৪ সালে আর্জেন্টিনার সারান্দিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রদ্রিগো ডি'পল। বুয়েনেস আয়ার্সের নিকটস্থ এই শহরতলিতে ফুটবলের সেরকম পরিবেশ ছিল না। ফলত, ২০০২ সালে মাত্র আট বছর বয়সে সারান্দি ছেড়ে বুয়েনেস আয়ার্সে চলে আসেন ডি'পল। বুয়েনেস আয়ার্সে এসে এখানকার এফসি রেসিং ক্লাবের ইউথ অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়ে যান রদ্রিগো ডি'পল। এফসি রেসিংয়ের মূল দলে খেলার সুযোগ আসে ১০ বছর পর, ২০১২ সালে। ইউথ সেটআপে ভালো খেললেও তাঁকে মূল দলে ডাকা হচ্ছিল না। অবশেষে ২০১২ সালে তাঁকে দু'টি ম্যাচের জন্য ডাকা হয়। দুর্ভাগ্যবশত দু'টিতেই বিচ্ছিরি ভাবে হেরে যায় এফসি রেসিং। এরপর কোচ বদল হয় এবং টিমের দরজাও খুলে যায় ডি'পলের জন্য। ২০১৩ সালে মোটামুটি নিয়মিতভাবে এফসি রেসিংয়ের হয়ে শুরু করতে থাকেন তিনি। এই সিজনে এফসি রেসিংয়ের হয়ে ১৯ ম্যাচে ৪ গোল করেন তিনি। পরের সিজেনে প্রথম দলের নিয়মিত খেলোয়াড় হয়ে যান। ২০১৪ সালে এফসি রেসিংয়ের হয়ে ৩৫ ম্যাচে ৬ গোল করেন তিনি। এরপরই তিনি স্প্যানিশ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়ার নজরে চলে আসেন। ২০১৫ সালে ৬.৫ মিলিয়ন ডলারের মোটা ট্রান্সফার ফি দিয়ে পাঁচ বছরের চুক্তিতে এফসি রেসিং থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হয় ভ্যালেন্সিয়ায়।

অ্যাটলেটিকো দি মাদ্রিদের অন্যতম ভরসা রদ্রিগো ডি'পল
লা-লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগ, কোপা ডেল রে- সব মিলিয়ে ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে ৪৫টি ম্যাচ খেলেন ডি'পল। ২০১৬-১৭ মরশুমে তাঁকে লোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁর পুরনো ক্লাব এফসি রেসিংয়ে। এই মরশুমের শেষেই ডি'পলের ভাগ্য খুলে যায়। প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন ডলারের ট্রান্সফার ফি দিয়ে তাঁকে সই করায় ইতালির ক্লাব উডিনেসে। সেই থেকে ২০২১ পর্যন্ত উডিনেসের হয়ে ১৭০-এর বেশি ম্যাচ খেলেছেন, করেছেন ৩৪ গোল। মাঝমাঠে কীভাবে দায়িত্ব নিয়ে খেলতে হয়, কীভাবে অধিনায়কত্ব করতে হয়- তাঁকে শিখিয়েছে এই ক্লাবটি। ডি'পলের নেতৃত্বেই মিলান, রোমা, নাপোলিকে হারিয়েছে উডিনেসে। এরপর গতবছর জুলাই মাসে উডিনেসে ছেড়ে অ্যাটলেটিকো দি মাদ্রিদে যোগ দেন রদ্রিগো। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত অ্যাটলেটিকোর নিয়মিত মিডফিল্ডার তিনি। রদ্রিগোর আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় ২০১৮ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত দলের অন্যতম স্তম্ভ তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুতে রিজার্ভ বেঞ্চ, সেখান থেকে প্রথম একাদশে আসা, বিশ্বকাপে প্রায় অনিশ্চিত হয়েও সত্ত্বেও শেষমেষ বিশ্বকাপ জেতা- লড়াইয়ের আরেক নাম রদ্রিগো ডি'পল।

Whatsapp
