আঠা দিয়ে ফাটা জুতো মেরামত করে ফুটবল খেলা, দি মারিয়ার গল্প হার মানাবে রূপকথাকেও
Angel Di Maria journey : কেন এমন চোখের জল? এত কষ্ট? অ্যাঞ্জেল দি মারিয়াকে এই প্রশ্ন করলে হয়তো একটু হাসবেন। ফিরে যাবেন ছোট্টবেলার রোজারিওর বুকে।
বিশ্বের অনেক স্ট্রাইকার, ফুটবলারদের মতো পেশিবহুল চেহারা নয়। রোগা, বড়ো কান, গোল গোল চোখ – বরাবরই এমনই ছিলেন তিনি। কিন্তু মাঠে নামলে উইং ধরে তাঁর দৌড় এবং গোল করা, করানোর দক্ষতা চোখ মেলে দেখত পৃথিবী। গোল দেওয়ার পর বুকের কাছে আঙুলগুলোকে নিয়ে হৃদয় এঁকে দৌড় দিতেন তিনি। হৃদয়, হ্যাঁ! আর্জেন্টিনার ফুটবল দলটির অন্যতম স্পন্দন তিনি। লিওনেল মেসির সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দী আজ ইতিহাস। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামের ফাইনালে তাঁর চোখের জল দেখে নিজেদের আর ধরে রাখতে পারেননি ভক্তরা। কেন এমন চোখের জল? এত কষ্ট? অ্যাঞ্জেল দি মারিয়াকে এই প্রশ্ন করলে হয়তো একটু হাসবেন। ফিরে যাবেন ছোট্টবেলার রোজারিওর বুকে। তারপর একটু একটু করে সন্তানদের নিয়ে ফিরে যাবেন বাড়ি। লাইমলাইটের ওপারে থাকা এক কিংবদন্তি হিসেবে…
১৮ ডিসেম্বর বিশ্বকাপ জেতার পর তাঁর কান্না, উল্লাস নজর এড়ায়নি কারও। এটা যে তাঁরও শেষ বিশ্বকাপ। ৩৪ বছর বয়স হয়েছে তাঁর। চোট আঘাতে মাঝেমধ্যেই ভোগেন। কিন্তু স্বপ্ন ছিল দু’চোখে। সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরি করছে একটি বিশেষ লেখা। ২০১৮ সালে সেটি লিখেছিলেন দি মারিয়া। ‘দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউন’-এর সেই বিশেষ লেখাটি দেখে আরও একপ্রস্থ কেঁদেছেন অনেকে। কেউ কেউ অবাক হয়ে দেখেছেন এক মধ্যবিত্ত স্বপ্নের উত্থানের গল্প। দেখেছেন বারবার হেরে যাওয়া, রক্তাক্ত হয়েও ফিরে আসা। ‘ভেনি ভিদি ভিসি’-র মন্ত্র দি মারিয়ার সঙ্গে ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে আছে।
ফাইনালে ম্যাক অ্যালিস্টারের বাড়ানো বলটি ধরার আগে কি মনে পড়ছিল রোজারিও-র কালো বাড়িটার কথা? যে বাড়িটার রঙ আদতে সাদা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কয়লার গুঁড়ো একটু একটু করে সেই চেহারা বদলে ফেলে। সেখানে লেগে প্রতিদিনের হেরে যাওয়া, কান্না, জিততে চাওয়া, জিতে ফেরার গল্পগুলো। বাড়িতেই টিনের ছাদের নিচে, রোদে গরমে বসে চারকোল তৈরি করতেন দি মারিয়ার বাবা। কাজ করতে করতে হাত কালো হয়ে যেত। গায়ের জামায়। প্যান্টে, মুখেও লেগে যেত কয়লার গুঁড়ো। ছোট্ট অ্যাঞ্জেল তাঁর বোনের সঙ্গে সক্কাল সক্কাল উঠে বাবাকে সাহায্য করতেন। তারপর সোজা চলে যেতেন স্কুলে। সেই কালো বাড়ি ছাড়িয়ে দৌড় দিতেন বহুদূরে। দৌড়… এই দৌড়ই দি মারিয়াকে বদলে দেয় একদম। বদলে দেয় তাঁর জীবন। বদলে দেয় তাঁর পরিবার…
আরও পড়ুন : অলিম্পিকে সোনা থেকে বিশ্বকাপ, মেসি, দি মারিয়া যেন আর্জেন্টিনার ‘গুপি-বাঘা’
ছোটো থেকেই দি মারিয়া ছিলেন হাতে পায়ে দুরন্ত। এক জায়গায় বসে থাকা যেন তাঁর কপালে নেই। আগে দি মারিয়ার পরিবারের কাজের জায়গা চারকোল তৈরি ছিল না। বরং বাড়ি থেকেই ব্লিচ, ক্লোরিন, সাবান ইত্যাদি সামগ্রী বিক্রি করতেন তাঁর বাবা-মা। কিন্তু একটি ঘটনা পুরো পরিবারটিকেই দিল বদলে। খরিদ্দারদের যাতায়াতের জন্য বাড়ির দরজা খোলা থাকত সবসময়। সেই খোলা দরজা দিয়েই একদিন বেরিয়ে গেলেন ছটফটে দি মারিয়া। তখন তিনি খুবই ছোট্ট। হঠাৎ রাস্তায় তাঁর সামনে চলে আসে একটি গাড়ি। সে যাত্রা তিনি বেঁচে গেলেন। বাঁচিয়ে দিলেন তাঁর মা।
তারপরই জীবনে চলে এল কয়লার কালিমা। বৃষ্টির মধ্যে একটা মাত্র টিনের চালের নিচে বসে রয়েছে গোটা পরিবার। বাড়ির কর্তা চারকোল বানিয়ে চলেছেন। তাঁর দুই ছোট্ট সন্তান স্কুল থেকে এসে তাঁর কাজে সাহায্য করছে। বেশি করে তৈরি করে বিক্রি না করতে পারলে যে খাওয়া জুটবে না! এরকম কত রাত, কত দিন আধপেটা খেয়ে ঘুমিয়েছেন দি মারিয়া। চোখে ছিল অপার স্বপ্ন। তিনি ছুটছেন, পরিবারের ‘রানার’ হয়ে এগিয়ে চলেছেন অনেক দূরে। সেই ছুটে চলাই তাঁকে নিয়ে এল ফুটবলে। তাঁর দুরন্তপনা কমাতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন অ্যাঞ্জেলের মা। সেই ডাক্তার যেন দেবদূত! লিখে দিলেন প্রেসক্রিপশন – “ওকে ফুটবলে ভর্তি করিয়ে দিন।” সেদিন থেকেই জুড়ে গেল একটা বল, ছেঁড়া বুট আর অবিরাম ছুটে চলা।
হ্যাঁ, ছেঁড়া বুট পরেই খেলতে যেতেন তিনি। গোটা মাঠ জুড়ে এতো ছুটতেন, এতো ফুটবল খেলতেন দি মারিয়া যে তাঁর জুতো ছিঁড়ে যেত। বাড়ি ফেরার পর সেটি আঠা দিয়ে জুড়ে দিতেন মা। নতুন আরেক জোড়া কেনার টাকা ছিল না যে! সেই ছেঁড়া জুতো পরেই এলাকার দলের হয়ে ৬৪ টি গোল করেন দি মারিয়া। রেডিও স্টেশন থেকে ফোন এল। কল করলেন সেই সময়ের রোজারিও সেন্ট্রালের কোচ। দি মারিয়াকে তাঁর চাইই চাই।
আরও পড়ুন : সবচেয়ে কম বেতনের কোচ তিনি, মেসিদের বিশ্বকাপ জয়ের রূপকথার সওদাগর স্কালোনি
২০২১-এর কোপা আমেরিকা জয়ের দিন গোলটি করার পর দি মারিয়ার মনে পড়েছিল ‘গ্রেসিয়েলা’র কথা? সে-ই তো ছিল তাঁর উত্থান পতনের সঙ্গী। গ্রেসিয়েলা - হলুদ, লরঝরে, জং ধরা একটি সাইকেল। দি মারিয়ার কাছে শিশু বয়সের পক্ষীরাজ ঘোড়া। মা নিয়ে যেতেন সেন্ট্রালের অ্যাকাডেমিতে, সঙ্গে থাকত কিট ব্যাগ, আর ছোট্ট বোন। সেই শুরু পথ চলা। “রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার”।
কিন্তু এই দি মারিয়াই একবার হার মেনেছিলেন। ছোটো বয়স থেকেই তিনি রোগা, সেরকম শক্তিশালী চেহারা নয়। এদিকে সেন্ট্রালের কোচ চান শক্তিশালী, আক্রমণাত্মক মানসিকতার খেলোয়াড়দের। দি মারিয়া তাঁর গুডবুকে ছিলেন না। ট্রেনিংয়ের সময় একদিন হেড মারার জন্য লাফাননি অ্যাঞ্জেল। সঙ্গে সঙ্গে কোচের চিৎকার, “তোমার দ্বারা কিছুই হবে না। অকর্মণ্য তুমি। যাচ্ছেতাই। জীবনে কিছুই করতে পারবে না। ফেলিওর। কমপ্লিট ফেলিওর।” বাড়িতে আসার পর দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন দি মারিয়া। না, আর কোনওদিন ফুটবল খেলবেন না। এদিকে বাড়ির অবস্থাও ভালো না। বাবাও বলে দিয়েছেন, হয় আর এক বছর, নয়তো আমার সঙ্গে কাজে যোগ দেবে। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের সেই প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে রোজারিও-র ঘরে।
দি মারিয়া বুঝলেন, এই বোধহয় শেষ। ফুটবল খেলা আর হল না তাঁর। শিরদাঁড়া হয়ে দাঁড়ালেন তাঁর মা। ফের বুটে আঠার প্রলেপ পড়ল, গ্রেসিয়েলা গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। ভোরের আলো দি মারিয়ার মুখ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল দিগন্তে। সুযোগ এল বেনফিকায়। প্লেনে চড়ে বাবাকে নিয়ে চলে যাওয়া সেখানে। রাতের বেলা শুনতেন, ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন বাবা। অঝোরে কেঁদে চলেছেন। পরিবার অনেক দূরে রয়েছে। এত দূরে কি মানুষ থাকে? ফিরে যেতে হবে, মনে হল দি মারিয়ার। এভাবে কষ্ট দেওয়ার কোনও মানে নেই।
আরও পড়ুন : সংসার সামলে মডেলিং এবং নিজস্ব বুটিক, ‘মেসির স্ত্রী’ পরিচয়কে যেভাবে ছাপিয়ে গেলেন আন্তোনেল্লা
কিন্তু জীবন কখন কার জন্য কী রেখে দেবে, কেউ জানে? ২০ বছর বয়সে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে জায়গা, সেখান থেকে লিওনেল মেসির সঙ্গে ফুটবল মাঠে জুটি বাঁধা। সেই জুটিই অলিম্পিকে সোনা এনে দিল দেশকে। ফাইনালে গোল করলেন দি মারিয়া। একটা গোল, দ্য ওয়ান শট, জীবন বদলে দিল। একাকীত্ব গ্রাস করেছিল দি মারিয়াকে। কী করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। অলিম্পিকের পর বেনফিকায় জায়গা পেলেন, আর তারপর সুযোগ এল রিয়াল মাদ্রিদে। বিশ্বকাপ হাতে নিতে নিতে মনে পড়ছিল বাবার কথা। দি মারিয়া শুনেছিলেন, তাঁর বাবা আর দাদুও খুব ভালো ফুটবলার ছিলেন। প্রতিভা ছিল, কিন্তু দু’জনেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে খেলার ক্ষমতা হারান।
মনে পড়ছিল ২০১৪-র ফাইনাল। পায়ে চোট, থাইয়ের পেশি ছিঁড়ে গিয়েছে। পেনকিলার আর ইনজেকশন দিয়েও তিনি নামতে চান। একবার ছুটতে চান। তিনি জানেন, রিয়াল মাদ্রিদে আর জায়গা হবে না। তাঁর বদলি পেয়ে গিয়েছে ক্লাব। শুধু একবার… একবার প্রমাণ করার সুযোগ দিতে হবে। সেবার হল না। আর্জেন্টিনার কোচ সাবেল্লার কাছে তাঁর কান্না, দুর্বলতার নয়, কিছু করে দেখানোর কান্না। কিন্তু সুযোগ এল না।
০-১। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের এই স্কোরবোর্ড ভূতের মতো তাড়া করেছিল দি মারিয়াকে। আর কি প্রমাণ করার সুযোগ পাওয়া যাবে না? মেয়েদের কাছে গল্প বলা যাবে না ওই কালো বাড়িটার? রোজারিও-র ছেলেটা কি সবসময় ছুটেই যাবে? কোথায় তাঁর ফাটা জুতো? সব ভুলে অ্যাঞ্জেল দি মারিয়া ফের ছুটেছেন। কোপা আমেরিকা, বিশ্বকাপ ফাইনাল। তিনি কি শুনেছেন সেই কবিতাটি –
“রানার! রানার! ভোর তো হয়েছে – আকাশ হয়েছে লাল
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?”
ভোর এসেছে। রোজারিও-র বাড়িটার কালো আঁচড় খসে বেরিয়ে পড়েছে সাদা রূপ। উড়েছে হারকিউলিস, ম্লান শরীরে ঝকঝকে হেসেছে গ্রেসিয়েলা। হেসেছে মফস্বলের সেই রাস্তাগুলি, হেসেছে টিফিন ফেরত বন্ধুরা। কোপা আমেরিকা আর বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দি মারিয়া আজ ইতিহাসের অধ্যায়। ‘ফেলিওর’ নন তিনি। বিশ্বকাপের ওই দৌড়, ওই গোল, ওই কান্না যেন লেগে আছে সোনালি ট্রফিটার গায়ে। যে স্বপ্ন এতদিন বুনে রেখেছিলেন তিনি। দুরন্ত দস্যি ছেলেটার স্বপ্ন। ছেঁড়া বুটে বিশ্বজয় করার স্বপ্ন। পেরেছেন, তিনি পেরেছেন।