বুকে অপারেশন, ৯৫ বছরেও অ্যাথলেটিক্সে বিশ্বজয়! ভারতে অনুপ্রেরণার অন্য নাম 'স্প্রিন্টার দাদি'

95 Years Old Sprinter Dadi Gold Medal : বারবারই বলা হয়, বয়স আসলে সংখ্যামাত্র। ৯৫ বছর বয়সে এসেও ব্যতিক্রম ভারতের ‘স্প্রিন্টার দাদি’।

মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। দিল্লি বিমানবন্দরে মানুষের ব্যস্ত ভিড়। তার মধ্যেই একটি অংশের দিকে চোখ গেল সবার। ক্যামেরার ঝলকানি, রিপোর্টারদের ছোটাছুটি সেই ভিড়ের দিকে। অনেকেই ঘিরে রেখেছেন বিশেষ কাউকে। নিশ্চয়ই কোনও মন্ত্রী বা নেতা হবেন, কিংবা কোনও বিদেশি অতিথি। অথবা কোনও ক্রিকেটার দেশের মাটিতে পা রেখেছেন। কিন্তু দেখা গেল, ওপরের কোনওটাই সত্যি নয়। ভিড়ের মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। বয়স ৯৫ বছর। মাথার সমস্ত চুলই পেকে গিয়েছে। পরনে ট্র্যাকস্যুট, সঙ্গে ফুলের তোড়া। তবে সেসবের বাইরে তাঁর গলায় জ্বলজ্বল করছে তিন তিনটে সোনার মেডেল। আর সেখানে লেখা ‘ওয়ার্ল্ড মাস্টার্স অ্যাথলেটিকস ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপ’।

আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। বয়স ৯৫ বছরই বটে। এই বয়সে এলে অধিকাংশ মানুষেরই কর্মক্ষমতা কমে যায়। শুধু তাই নয়, সঙ্গী হয় বিভিন্ন রোগ, মানসিক অস্থিরতা। বার্ধক্য তাঁদের কাবু করে ফেলে। কিন্তু বারবারই বলা হয়, বয়স আসলে সংখ্যামাত্র। ৯৫ বছর বয়সে এসেও ব্যতিক্রম ভারতের ‘স্প্রিন্টার দাদি’। এই নামেই তাঁকে ডাকেন আপামর ভারতীয়। আর ডাকবেন নাই বা কেন! বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে, আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্সের প্রতিযোগিতায় তিনিই তো সোনা ঝরিয়েছেন! ৬০ মিটার দৌড়, সঙ্গে ডিসকাস থ্রো আর শট পাট – এই তিন বিভাগে সোনা জিতেছেন ভারতের এই ‘স্প্রিন্টার দাদি’।

আসল নাম ভগওয়ানি দেবী দাগার। আদতে দিল্লির বাসিন্দা এই বৃদ্ধার জীবন আর পাঁচজনের মতোই ছিল। কম বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তারপর শুরু হয় সংসার। সেভাবেই হয়তো কেটে যেত বাকি জীবন। কিন্তু ভাগ্যদেবতা অন্যকিছু ভেবে রেখেছিলেন তাঁর জন্য। কিন্তু এই ‘সোনার দৌড়’-এর আগে তাঁকে পেরোতে হয়েছে অজস্র দুঃখের পথ। সেখানে কেউ তাঁর জন্য গোলাপ বিছিয়ে রাখেনি। বরং পদে পদে ছিল কাঁটা বিছানো। একের পর এক ঝড় এসেছে, সমস্তটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। সেই ঝড়ের সামনে পড়লে আর পাঁচজন হয়তো মুখ থুবড়ে পড়তেন। কোথায় হারিয়ে যেতেন, কেউ জানতেন না। হয়তো কেউ খবরও নিত না। কিন্তু সেই মারের সাগর পাড়ি দেওয়ার মন্ত্রই নিজের ভেতর খুঁড়ে খুঁড়ে বের করেছেন ভগওয়ানি দেবী।

হরিয়ানার খেরকা গ্রাম থেকে ভগওয়ানি দেবীর যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর বিয়ে, সন্তান। তখনও ৩০ পেরোননি তিনি। একেবারে তরতাজা যুবতী। এমন সময় নেমে এল দুর্যোগ। বাড়িতে স্বামী ছাড়াও ছিল এক মেয়ে আর এক ছেলে। তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। সেই সময়ই পরপর মারা গেলেন ভগওয়ানি দেবীর ছেলে আর স্বামী। একেবারে একা হয়ে পড়লেন তিনি। যাই হোক, সঙ্গে মেয়ে আর সদ্যোজাত পুত্রসন্তান রয়েছে। কিন্তু সেখানেও ফের নেমে এল ঝড়। চার বছরের মধ্যে ভগওয়ানি দেবীর বড় মেয়েও মারা গেলেন। দাঁতে দাঁত চেপে সেই দুঃখ সহ্য করলেন তিনি। পরিবারকে তো বাঁচাতে হবে! ছেলের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে তো! ব্যস, মাঠে ঘাটে কাজ করা শুরু করলেন তিনি। আর বিয়ে? না, আর সেদিকে যাননি তিনি।

সেভাবেই কেটে যাচ্ছিল জীবন। একটু একটু করে চামড়ায় ভাঁজ পড়ছিল। নাতি নাতনিও এল জীবনে। সব ঠিকঠাক চলছে যখন, তখন ফের একবার ধাক্কা। হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন ভগওয়ানি দেবী। ২০০৭ সালে বাইপাস সার্জারিও হল। ততদিনে বয়স আর আর দুঃখ আরও একটু চেপে বসেছে। কিন্তু কী করবেন তিনি? কীভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন?

সেসময়ই জীবনে এল অ্যাথলেটিক্স। অবশ্য খেলার সঙ্গে যোগাযোগটা ছোট থেকেই ছিল। শিশু বয়সে নিজের গ্রামে চুটিয়ে কবাডি খেলতেন ভগওয়ানি দেবী। সেটাই ছিল একমাত্র অভিজ্ঞতা। কিন্তু খেলতে তাঁর ভালো লাগত, এই গল্পই শোনাতেন নাতি নাতনিদের। সেটাই মাথায় গেঁথে যায় বিকাশ দাগারের। সম্পর্কে ভগওয়ানি দেবীর নাতি বিকাশ নিজে একজন প্যারা অ্যাথলেট। খেল রত্ন সম্মানও পেয়েছেন। তিনিই ঠাকুমার হাতে তুলে দিলেন শট পাটের লোহার বলটি। প্রথমে রাজি না থাকলেও একবার চেষ্টা করে দেখলেন ভগওয়ানি দেবী। প্রথমবার সেই বলটি ছুঁড়লেন, প্রায় চার মিটার দূরে গিয়ে পড়ল সেটি। বিকাশ দাগার পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তখন যেন তাঁর ঠাকুমার চোখে এক আগুন দেখেছিলেন তিনি। খেলার আগুন, মাঠে নেমে লড়ে জেতার আগুন। সঙ্গে ছিল কিছু করে দেখানোর জেদ।

নাতি বিকাশই তাঁর কোচ। যাবতীয়ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ২০২২ সালে নামলেন ওয়ার্ল্ড মাস্টার্স চ্যাম্পিয়নশিপে। সেবার ফিনল্যান্ডে আয়োজিত হয়েছিল এই টুর্নামেন্ট। তখন ৯৪ বছর বয়স ভগওয়ানি দেবী দাগারের। একবার ভাবুন, বুকে বাইপাস সার্জারি, সেইসঙ্গে নব্বই পেরনো এক বৃদ্ধা। এত এত দুঃখের বোঝা কাঁধে নিয়ে নামলেন, কেবল জীবনের যুদ্ধে জিতবেন বলে। এ যেন স্বয়ং জীবনের উদ্দেশ্যেই চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া। এসো, এসো তুমি, আর কত দুঃখ দেবে! এখন আমার খেলার পালা।

প্রথমবারেই তাক লাগিয়ে দিলেন ভগওয়ানি দেবী। ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় সোনা আর শট পাট, ডিসকাস থ্রোয়ে ব্রোঞ্জ। মোট তিনটে মেডেল প্রথমবারেই জিতে নিলেন তিনি। দেশের মুখ উজ্জ্বল করলেন। তখন থেকেই গোটা ভারত তাঁকে চিনল ‘স্প্রিন্টার দাদি’ হিসেবে। তাঁর জীবনীশক্তি যেন সবাইকে হারিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু এখানেই থামেননি তিনি। এবছর ফের ওয়ার্ল্ড মাস্টার্স চ্যাম্পিয়নশিপে নেমেছিলেন স্প্রিন্টার দাদি। পোল্যান্ডের তোরানে বাড়তি প্রস্তুতি নিয়ে খেলে দেখালেন তিনি। এবার দৌড়, শট পাট আর ডিসকাস থ্রো – তিন বিভাগেই সোনা জিতলেন তিনি! ৬০ মিটার স্প্রিন্ট শেষ করলেন মাত্র ৩৬.৫৯ সেকেন্ডে!

এবার তাঁর লক্ষ্য? এখনই ঠিক করে ফেলেছেন ভারতের আদরের স্প্রিন্টার দাদি। এবছর নভেম্বরে ফিলিপিন্সে এশিয়ান মাস্টার্স চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেবেন তিনি। আর সামনের বছর সুইডেনে ফের নামবেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। খেলার নেশা লেগে গিয়েছে তাঁর। বয়স? বার্ধক্য? অসুখ? এসব তাঁর কাছে সামান্য শব্দ। স্প্রিন্টার দাদি এখন দৌড়ে যাচ্ছেন, জীবনকে দেখিয়ে দিচ্ছেন, আসলে তিনিও পারেন জিততে। কেবল তিনি কেন, সবাই পারেন প্রতিকূলতা ভেঙে ওপরে উঠতে। শুধু দরকার একটা লক্ষ্য, পরিশ্রম আর দৃঢ়তা।

More Articles