দু'পেয়ে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ভারতেই, উঠে এল যে চমকপ্রদ তথ্য
Homo-erectus originated from India: মানবসভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসের পদক্ষেপে আদিমানব যখন চার পা ছেড়ে দু’পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল, সেই হোমো-ইরেক্টাস-এর সব থেকে পুরনো চিহ্ন মিলেছে ভারতে।
মানবসভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসের পদক্ষেপে আদিমানব যখন চার পা ছেড়ে দু’পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল, সেই হোমো-ইরেক্টাস-এর সব থেকে পুরনো চিহ্ন মিলেছে ভারতে। নয়াদিল্লির ন্যাশনাল মিশন অন মনুমেন্টস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটি এবং ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ বিভাগ এ শহরে একটি দুদিনের হাইব্রিড মোড কর্মশালার আয়োজন করেছিল। সেখানেই উঠে এল এই চমকপ্রদ তথ্য। ডিসেম্বরের ১৭ এবং ১৮ তারিখ উদয়াচলে এই কর্মশালা হয়। এতে যোগ দিয়েছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, প্রত্ন সংরক্ষণে উৎসাহী ও শিক্ষা জগতের মানুষজন।
ইতিহাসের দর্পণে দু’পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, বিবর্তনের আঙিনায় এক পট পরিবর্তন। এ জিনিস এক মিনিটে ঘটে না, কোনও বিশেষ এক এলাকা নির্ভরও নয়। আমরা অনেকেই শুনেছি, প্রথম মানুষ, প্রত্ন-বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম হোমো-ইরেক্টাস, তার প্রাচীনতম ফসিল পাওয়া যায় আফ্রিকায়। সাধারণ মানুষ অবাক বিস্ময়ে মেনে নেন, মানুষের জন্মস্থল আফ্রিকা। কিন্তু প্রত্ন অনুসন্ধানীরা প্রায় গোয়েন্দার মতো বিভিন্ন ছিন্ন সূত্র জড়ো করে তত্ত্ব প্রমাণ করেন। প্রত্নবস্তুর সযত্ন সংরক্ষণ কেন প্রয়োজন─তা বোঝাতেই হোমো-ইরেক্টাস নিয়ে এই চালু তত্ত্ব খণ্ডন করে বলিষ্ঠ তথ্য দিলেন পুনের ডেকান কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা ডাঃ শীলা মিশ্র। তিনি জানালেন, হোমো-ইরেক্টাসের সব থেকে প্রাচীন ফসিল পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়ার জাভাতে। আর ভারতীয় ভূখণ্ডে মেলে হোমো-ইরেক্টাস ব্যবহৃত পাথুরে অস্ত্র সামগ্রী। দু'য়েরই বয়স আনুমানিক চব্বিশ লক্ষ বছরের আশেপাশে। আফ্রিকায় উদ্ধার করা হোমো-ইরেক্টাসের ফসিল তুলনায় বেশ নবীন। তার বয়স কুড়ি লক্ষ বছরের কাছাকাছি। কোনও এক বস্তুকে এককভাবে দেখলে ইতিহাসকে ভুল বোঝার সমুহ সম্ভাবনা। তাকে সামগ্রিক প্রেক্ষিতের বিচারে দেখা উচিৎ। ইন্দোনেশিয়ায় সেই ফসিলের সমকালীন আর যে সব জীব জন্তুর জীবনের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেগুলোর জন্ম ভারতীয় ভূখণ্ডে। তাঁর আরও ব্যখ্যা, হোমো-ইরেক্টাসের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো নির্ঘাৎ এই ভূখণ্ড থেকেই ওখানে গিয়েছিল। এমনও হতে পারে যে, এই ভূখণ্ড থেকেই আফ্রিকায় পাড়ি দিয়েছিল একদল। এই সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরও একটি সম্ভাবনার কথাও বলেন, যা প্রত্নতত্ত্বের নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ভূখণ্ডে হোমো-ইরেক্টাসের ফসিল না মেলার কারণ উপমহাদেশীয় আবহাওয়া, তাপমাত্রা। তাঁর আরও দাবি, বিবর্তনের প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা কোনও এক বিশেষ ভূখণ্ডে বেঁধে রাখা সমীচীন নয়। বরং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের পরিবেশ বৈচিত্র, মাটি ইত্যাদি নিয়েই মানবসভ্যতার বিবর্তন এগিয়েছে।
আরও পড়ুন: নদীর অতলে তলিয়ে গেছে একের পর এক মন্দির, পুরুলিয়ার যে ইতিহাস চলে গেছে আড়ালে
মানবজাতির ইতিহাসের আঙিনায় বিভিন্ন মণি মুক্ত এদিক ওদিক পড়ে থাকে। তাকে জড়ো করে গেঁথে ইতিহাস জানা আসলে নিজেকেই জানা। প্রকারান্তরে নিজের সভ্যতাকে স্বীকার করে তাকে চিনতে শেখা। কিন্তু চরিত্রগতভাবে ভারত ইতিহাস বিস্মৃতির দেশ বলেই হয়তো এদিকে ওদিকে ছড়ানো টেরাকোটা মন্দির, প্রাচীন অট্টালিকাকে সাধারণ মানুষ একেবারে অন্যভাবে ব্যবহার করে তার তাৎপর্যকে অবহেলা করে। এই রাজ্যেই গড়ে বছরে একাধিক প্রত্নবস্তু আজ এখান থেকে কাল ওখান থেকে উদ্ধার হয়। হয়তো কোথাও পাওয়া গেল কোনও প্রস্তর মূর্তি। ইতিহাসের বাটখারায় তা যথেষ্ট মূল্যবান হলেও তাতে তেল, সিঁদুর, গোবর লেপে, কোনও দেবতার জামা পরিয়ে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুরু হয় পুজো। আমাদের দেশে প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ আসলে Problem of Plenty. গোটা দেশে প্রায় ষাঠ লাখ প্রত্নবস্তু ছড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে বহু ঐতিহ্যময় স্থাপত্য ও প্রাঙ্গণ। কিন্তু সেই সব সম্পদ সম্পর্কে আমরা কতটা ওয়াকিবহাল?
প্রত্ন-বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, বিশ্বের বৃহত্তম প্রত্ন-আকর সম্ভবত এই উপমহাদেশ। এই সুবিশাল প্রত্নভাণ্ডার পুনরুদ্ধার ও তার সুষ্ঠু সংরক্ষণের কর্মযজ্ঞ শুধু মাত্র সরকারের দ্বারা পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। তাই সাধারণ মানুষকে সচেতন করে, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে উদ্ধার করা ছড়ানো ছিটানো চিহ্ন-সূত্র কে এক মালায় গেঁথে সংরক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন। এবং এই গোটা প্রক্রিয়া যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য ও সময়-সাপেক্ষ। তাছাড়া, এই সব প্রাচীন প্রত্নবস্তু সংরক্ষণের অনেকটাই বিজ্ঞান নির্ভর। তার জন্য দরকার বিশেষ প্রশিক্ষণ। ন্যাশনাল মিশন অন মনুমেন্টস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটি তাই মূলত ছাত্রছাত্রী এবং স্কলারদের প্রশিক্ষিত করে কাজে লাগানোর জন্য এ দেশে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে সাধারণ মানুষের কথা বলা হচ্ছে কেন? তার ব্যাখ্যা দিলেন আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর জেনারেল অধ্যাপক কিশোর কুমার বাসা। তিনি মনে করেন, এই সব প্রত্নবস্তু সংরক্ষণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের হাতে কলমে প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল। তাই ন্যূনতম জ্ঞান থাকা জরুরি। সেই সঙ্গে কর্মশালায় প্রশিক্ষিতরা প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ ও সাধারণের মধ্যে সেতু হিসাবে কাজ করতে পারে। এঁদের সান্নিধ্যে আমজনতা সচেতন হবে।
আরও পড়ুন: মানুষ মরে গেলে কবর দিতে হয়, কবে শিখল আদিম মানুষ?
এই কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল ডাঃ গৌতম সেনগুপ্ত। বিশিষ্ট অতিথিবর্গের মধ্যে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জেনারেল এবং অফিশিয়াল ট্রাস্টি শ্রী বিপ্লব রায়। তাঁর বক্তব্যে বিপ্লব রায়, লালাবাজার ও তার সংশ্লিষ্ট এলাকাকে হেরিটেজ জোন ঘোষণা করার দাবি তোলেন। তাঁর মতে, এই এলাকায় রয়েছে সিনাগগ, কলকাতার প্রথম আগিয়ারি (পার্সি অগ্নি মন্দির) গীর্জা সহ বেশ কিছু পুরনো স্থাপত্য। তিনি মনে করেন, এলাকায় হকারের দৌরাত্ম্য মূলত এই অসচেতনতার জন্যই। হেরিটেজ ঘোষণা করা হলে এলাকায় বিশেষ নজর দেওয়া সম্ভব হবে।
উপস্থিত বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, এই বিপুল প্রত্নভাণ্ডার সামলানোর পাশাপাশি প্রত্ন-পাচারও একটা মস্ত সমস্যা। গোটা ব্যবস্থা সামলানোয় প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রিতা ও লাল ফিতের ফাঁসও গেরো। ব্যক্তিগত না সর্বজনীন? নাকি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি? এই ধরনের জটিলতার বলি হয় প্রত্নবস্তু। এ সমস্যার মোকাবিলা কীভাবে সম্ভব? কর্মশালায় যোগ দিতে আসা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সায়নী দাসের কাছে এর কোনও সদুত্তর না থাকলেও, তাঁর মতে ইন্টারনেটকে হাতিয়ার করে অন্তত নিজেদের ইতিহাস চিনতে শেখার প্রচার চালানো যেতে পারে।