মাত্র ২৭ বছর বয়সেই পদ্মভূষণ! ভারতীয় বিজ্ঞানকে একাকী করে চলে গেলেন নার্লিকার

Jayant Narlikar: 'হয়েল-নার্লিকার তত্ত্ব' সেই সময়ে বিজ্ঞানীমহলে ব্যপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই থিয়োরি মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের জন্য একটি বিকল্প ব্যাখ্যার প্রস্তাব দেয়, যা সেই সময়ের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে রীতিমতো চ্যালে...

বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছিল? বিগব্যাং কী? মহাবিশ্বের বিবর্তনের জন্য প্রচলিত মতবাদের ভিতরে কোনটা বেশি গ্রহণযোগ্য? ব্ল্যাকবোর্ডে বিভিন্ন রংয়ের চক ব্যবহার করে যিনি দেশের অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীদের শেখাতেন, সেই শিক্ষক আর নেই। প্রয়াত হয়েছেন নার্লিকার। জয়ন্ত বিষ্ণু নার্লিকার — নিজেই একজন ইতিহাস। আমাদের দেশের জন্য তো বটেই, আন্তর্জাতিক জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানের জগতে এক ভাস্বর মাইল ফলক ছিলেন নার্লিকার।

পরাধীন ভারতের মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরে জন্ম এই ক্ষণজন্মার। বাবা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের অধ্যাপক। সেই সুবাদে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য কেমব্রিজে যান। সেখানে তিনি ম্যাথেমেটিক্যাল ট্রাইপোস-এ টাইসন মেডেল পান। সেখানেই সাক্ষাৎ পান বিশিষ্ট ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েলের। ফ্রেড তখন স্টেডি স্টেট থিয়োরি নিয়ে মত্ত। সেই ভাবনার শরিক হলেন নার্লিকারও। তাঁদের যৌথ গবেষণার ফসল 'হয়েল-নার্লিকার তত্ত্ব' সেই সময়ে বিজ্ঞানীমহলে ব্যপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি ‘কোয়াসি স্টেডি স্টেট কসমোলজি তত্ত্ব’ বা ‘কনফর্মাল গ্রাভিটি তত্ত্ব’ নামেও পরিচিত। এই থিয়োরি মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের জন্য একটি বিকল্প ব্যাখ্যার প্রস্তাব দেয়, যা সেই সময়ের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে (এই তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বের একটি নির্দিষ্ট শুরু ও শেষ রয়েছে) রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে। এই তত্ত্বের মতে, মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারণশীল অবস্থায় রয়েছে এবং সেখানে ক্রমাগত নতুন নতুন পদার্থ তৈরি হচ্ছে।

আরও পড়ুন- কয়লা খনিজ তেল বাড়ন্ত! কেন পৃথিবীতে এক টুকরো সূর্য সৃষ্টি করতে চাইছেন বিজ্ঞানীরা

ম্যাকের নীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্ব দাবি করে যে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুর ভর অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে তার মিথোস্ক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। আইনস্টাইন এই নীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু এটিকে তাঁর তত্ত্বে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। তাঁদের এই তত্ত্ব একটি ক্রিয়েশন ফিল্ড বা 'সৃষ্টি ক্ষেত্রের' প্রস্তাব করে, যেটি একটি অনুমান নির্ভর ঋণাত্মক শক্তি ক্ষেত্র যা পদার্থের ক্রমাগত সৃষ্টির জন্য দায়ী। এটি স্টেডি স্টেট ইউনিভার্স বা স্থিতিশীল মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করেছিল। এক কথায় মহাবিশ্বের শুরু বা শেষ বলে কিছু নেই, এটি অনন্তকাল চলতে থাকবে। হয়েল-নার্লিকারের এই তত্ত্বটি ছায়াপথের গঠন, পদার্থের বন্টন এবং মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণ (Cosmic microwave background) সম্পর্কে এক বিকল্প ধারণার জন্ম দেয়। এই তত্ত্বের সাহায্যে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগে পাওয়া তারার ব্যাখা দেওয়া সম্ভব, অন্যদিকে বিগব্যাং তত্ত্বে তা সম্ভব নয়, কারণ আমরা জানি বিগব্যাং তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বছর! জটিল গাণিতিক তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত এই কোয়াসি স্টেডি স্টেট তত্ত্ব সার্বিকভাবে গৃহীত না হলেও, এটি মহাজাগতিক গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়।

কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে তাঁর গবেষণা বিজ্ঞানীমহলে যথেষ্ট সমাদৃত। তিনিই 'self gravitating' সিস্টেমের ধারণা দেন, যা কৃষ্ণগহ্বরের আশেপাশের স্থান-সময়ের জ্যামিতিতে পদার্থের মহাকর্ষীয় প্রভাব বিবেচনা করে। তাঁর গবেষণা সক্রিয় ছায়াপথের নিউক্লিয়াসের অধ্যয়নেও বিস্তৃত ছিল। এই সম্পর্কিত গবেষণায় তিনিই ম্যাগনেটিক ফিল্ড ইজেকশান মডেলের প্রস্তাব করেন।

কেমব্রিজ থেকে দেশে ফিরে নার্লিকর TIFR-এ তাত্ত্বিক অ্যাস্ট্রোফিজিক্স গ্রুপে যোগ দেন যেখানে তিনি ১৭ বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে টিআইএফআর-এর তাত্ত্বিক জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করে। ১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) নার্লিকরকে ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইইউসিএএ) প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেয়। অজিত কামদেভি, নরেশ দাধিচির মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানী রামিলে গড়ে তোলেন আইইউসিএএ, যেটি আজ, শুধুমাত্র ভারতে নয়, বিশ্বব্যাপী জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি। তাঁর নেতৃত্বে আইইউসিএএ অসংখ্য তরুণ বিজ্ঞানীকে লালন করেছে। ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত তিনি আইইউসিএএ-র পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

শুধু একজন মৌলিক বিজ্ঞানী বা প্রথম সারির বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের স্থপতিই নয়, তিনি ছিলেন এক নিষ্ঠাবান বিজ্ঞান প্রচারক। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিজ্ঞানচর্চার প্রচার ও প্রসার ঘটাতে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁর। ২০১৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন তিনি। এমনকী এবছরও ফেব্রুয়ারি মাসে কেরলের ত্রিবান্দ্রমে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় বিজ্ঞান সম্মেলনেও অনলাইনে যোগদান করেন।আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের জনসংযোগ প্রায় থাকে না বললেই চলে, সেখানে নার্লিকর একেবারে ব্যতিক্রম। জীবনভর বলে গেছেন জ্যোতিষশাস্ত্রের অসাড়তার বিরুদ্ধে। সুধাকর কুন্তে, নরেন্দ্র দাভোলকার এবং প্রকাশ ঘোড়পড়েকে সঙ্গে নিয়ে জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্ববাণী করার অসাড়তা তিনি হাতেনাতে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন।

আরও পড়ুন-প্রকাণ্ড ডানা, অপার্থিব সৌন্দর্য! মহাকাশে কীভাবে লুকিয়ে দানবাকৃতি মহাজাগতিক প্রজাপতি?

প্রথিতযশা বিজ্ঞানীর পাশাপাশি তিনি একজন কল্পবিজ্ঞান লেখকও৷ তাঁর কল্পকাহিনি কিশোর পাঠকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। তিনি ইংরেজি, হিন্দি ও তাঁর মাতৃভাষা মারাঠিতে অনেগুলি জনপ্রিয় বিজ্ঞানধর্মী লেখা লিখেছেন। নব্বইয়ের দশকের অনেক ছাত্রছাত্রীই নার্লিকারের লেখা, বিশেষ করে তাঁর কথাসাহিত্য পড়ে বড় হয়েছেন। ‘অ্যাথেন্সা প্লেগ’ নামক কাল্পনিক গল্পে নার্লিকর মারাত্মক ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাবের ধারণা দেন, যেটি পূর্বে কাল্পনিক মনে হলেও কোভিড-১৯ মহামারীর সময় গোটা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক রোবট বা চ্যাট জিপিটি, এখন আমাদের অবাক না করলেও, আগে তা ভাবনাতীত ছিল। তাঁর একটি কাল্পনিক প্রবন্ধে একটি অতি-বুদ্ধিমান রোবটের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে চ্যাটজিপিটির ধারণা দিয়েছেন নার্লিকার, একটু অন্যভাবে। এছাড়াও জটিল বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তুলে ধরার জন্য তিনি আজীবন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখে গেছেন। ‘Black Holes’, ‘The return of vaman’, ‘The cosmic explosion’, ‘Tales of the future’ প্রভৃতি তাঁর কয়েকটি কালজয়ী সৃষ্টি।

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: জয়রাম রমেশ, রাজ্যসভার সংসদ

বিজ্ঞান সাধনা, বিজ্ঞান মনস্কতার প্রচার ও প্রসার, অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম— এসবেরই সম্মিলিত সমাহার তাঁর গোটা জীবন। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই পদ্মভূষণ পাওয়া এই বিরল প্রতিভার ঝুলিতে একে একে যুক্ত হয়েছে অ্যাডাম'স পুরস্কার (১৯৬৭), কলিঙ্গ পুরস্কার (১৯৯৬), পদ্মবিভূষণ (২০০৪), মহারাষ্ট্র ভূষণ (২০১১) প্রভৃতি। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হচ্ছে, দেশে এমন কোনও বিজ্ঞান শিক্ষার্থীকে পাওয়া যাবে না, যাঁরা নার্লিকারের নাম শোনেননি।

ভারতের বিজ্ঞানাকাশের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হয়েছে সদ্য। জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের পত্রিকা 'যোজনা' ১৯৬৪ সালের জুলাই সংখ্যায় তাঁকে নিয়ে একটি লেখা ছেপেছিল, ‘Should we get Jayant back?’, তখন নার্লিকার ২৬ বছরের তরুণ। নার্লিকারের প্রয়াণের পর ভারতীয় বিজ্ঞানমহলে সেই প্রশ্নটিই যেন ঘুরে ফিরে আসছে। 

More Articles