জাতীয় মহাকাশ দিবস: নভোচারীরা মহাকাশযানে ভেসে বেড়ান কীভাবে?

National Space Day: আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হতে পারে কোনো মাধ্যাকর্ষণ নেই, আদতে তাঁরা মহাকর্ষের মধ্যেই থাকেন, কেবল এটি অনুভব করেন না।

আজ জাতীয় মহাকাশ দিবস। চন্দ্র জয়ের স্মারক হিসেবে গতবছর থেকে পালন করে আসছি আমরা। দেশের মানবসম্পদের উন্নতি বা অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি যাই হোক না কেন, মহাকাশ দখলে যে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েক বছরে একের পর এক সফল অভিযান চালিয়েছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, ইসরো। নাসার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সার্বক্ষণিক ভূ-পাহারার জন্য মহাশূন্যে আমরা নাইসার পাঠিয়েছি সম্প্রতি। দিন কয়েক আগে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন ঘুরে এসেছে শুভাংশু শুক্লা। রাকেশ শর্মার পর প্রথম কোনো ভারতীয় মহাশূন্য জয় করে ফিরল।

মহাকাশচারীদের কথা আমাদের মনে এলেই সবার প্রথমে মনে পড়ে মহাকাশে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য। ছোটবেলায় ভাবতাম যদি এভাবে ভেসে বেড়ানো যেত, তাহলে মন্দ হত না। সাধারণত আমরা অনেকেই মনে করি মহাকাশের কোনো মাধ্যাকর্ষণ নেই, তাই মহাকাশচারীরা খেয়াল খুশি মতো ভেসে বেড়াতে পারেন। বিভিন্ন কল্পবিজ্ঞান ধর্মী সিনেমায় যেমন দেখায় আর কি। বাস্তবে তা কিন্তু সত্যি নয়। মহাকর্ষের মান কম হলেও মহাকাশে তা একেবারেই শূন্য নয়।

আরও পড়ুন- কোয়ান্টাম দূরত্বের আবিষ্কার কীভাবে বদলে দেবে যাবতীয় কম্পিউটারের চেহারা?

মাধ্যাকর্ষণের ধারণা নিউটনেরও অনেক আগের। এই মহাবিশ্বের যে কোনো দুটো বস্তু সর্বদা একে অপরকে আকর্ষণ করে। নিউটনই প্রথম হিসাব কষে প্রমাণ করেন যে সেই আকর্ষণ বল বস্তু দুটির ভরের সমানুপাতিক ও তাঁদের মধ্যেকার দূরত্বের ব‍্যাস্তানুপাতিক। সোজাকথায় তাদের ভর যত বাড়বে, টান তত বেশি হবে। আবার দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই টানের মান কমতে থাকে। এই মাধ্যাকর্ষণের জন্য পৃথিবী-সহ সমস্ত গ্রহ তাকে কেন্দ্র করে আজীবন ঘুরপাক খাচ্ছে। দুরত্ব বাড়তে বাড়তে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ হলেও মহাকর্ষের টান একেবারে শূন্য হয়ে যায় না। এককথায় মহাবিশ্বের সর্বত্রই মাধ্যাকর্ষণ বিদ্যমান।

তাহলে আমরা যে দেখি মহাকাশচারীরা মহাশূন্যে ভাসছে? আসলে মহাকাশযান ও তার ভেতরে থাকা মহাকাশচারীরা একইসঙ্গে যেমন পৃথিবীর দিকে পড়তে থাকে, তেমনই আবার ঘন্টায় প্রায় ১৮,০০০ কিলোমিটার বেগে পাশেও সরে যায়। এই দুই গতির ভারসাম্যে মহাকাশচারী সমেত মহাকাশযানটি পৃথিবীতে নেমে না এসে পৃথিবীকে ঘিরে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। সেই সময় মহাকাশচারীরা কোনো ওজন অনুভব করে না। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ঘটনাকে বলে ফ্রি ফল বা বিনা বাধায় পতন। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা লিফটে করে নীচে নামি, তখন আমাদের শরীর ওজনহীন বলে মনে হয়। তাই মহাকাশচারীদেরও দেখে মনে হয় তাঁরা ওজনহীন।

স্পেস ক্রাফ্টের মধ্যে মহাকাশচারীদের ভেসে বেড়াতে দেখা যায়, স্পেস ক্রাফ্টের বাইরেও কি তাঁরা ভাসতে পারবে? এককথায়, না। একটা সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা এই কথার সত্যতা যাচাই করতে পারি।

ধরা যাক, তীব্র গতিতে ছুটে চলা এক গাড়িতে করে জাতীয় সড়ক ধরে আরাম করে বন্ধুরা মিলে কলকাতা থেকে খড়্গপুর যাচ্ছি। সে সময় চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে যদি বাইরে আসার চেষ্টা করি, তাহলে আমাদের কি অবস্থা হবে? মহাকাশযানের ক্ষেত্রে তা আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হবে। কারণ, সেটি পৃথিবী থেকে ৪০০ কিলোমিটার উপরে যে জায়গা জুড়ে ঘুরতে থাকে, সেখানে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান ৮.৭ মি/ সেকেন্ড^২ (পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় ৯০%)। এই জায়গা থেকে পৃথিবীর দিকে কোনো বস্তুকে ছুড়ে দিলে বা এমনি ফেলে দিলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর থেকে নামতে নামতে যখন ট্রপোস্ফিয়ারে প্রবেশ করে তখন বায়ুর ঘর্ষণ এবং দহনের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে বস্তুটি জ্বলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন- আলোকে জমিয়ে ফেলা সম্ভব! বিজ্ঞান গবেষণায় যে ধরনের পরিবর্তন অনিবার্য

বাস্তবে পৃথিবী থেকে মহাশূন্যে এমন দূরত্বে পৌঁছানো সম্ভবই নয়, যেখানে মহাকর্ষের কোনো প্রভাব থাকবে না। আমাদের পৃথিবীর মহাকর্ষ টান সেখানে অনুভূত না হলেও অন‍্যন‍্য মহাজাগতিক বস্তুর (উপগ্রহ, গ্রহ বা অন‍্য নক্ষত্রের) টান সেখানে থাকবেই। সুতারং, আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হতে পারে যে কোনো মাধ্যাকর্ষণ নেই, আদতে তাঁরা মহাকর্ষের মধ্যেই থাকেন, কেবল এটি অনুভব করেন না। এই কারণেই পদার্থবিজ্ঞানীরা 'শূন্য মাধ্যাকর্ষণ'-এর পরিবর্তে 'মাইক্রোগ্রাভিটি' বলেন। যার অর্থ- অল্প হলেও মাধ্যাকর্ষণ থাকে।

প্রকৃতিতে যে চারধরণের বল (মহাকর্ষ বল, তড়িৎচুম্বকীয় বল, সবল নিউক্লিয় বল এবং দুর্বল নিউক্লিয় বল) দেখতে পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল বল এই মহাকর্ষ, তাই বলে হেলা ফেলা ভাবা একদম উচিৎ নয়। এই মাধ্যাকর্ষণ আছে বলেই চাঁদ, তারা, পৃথিবী এবং আমরা আছি, না হলে সবকিছু ভেঙে পড়ত , আমরাও থাকতাম না। মহাকর্ষের উপস্থিতি আমাদেরকে ওজনদার করে তোলে, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না।

More Articles