শতবর্ষে কোয়ান্টাম মেকানিক্স! কেন শতাব্দীর অন্যতম সফল তত্ত্ব এটি?
Quantum Science and Technology Turn 100: জাতিসংঘ ২০২৫ সালকে আন্তর্জাতিক কোয়ান্টাম বর্ষ (IYQ2025) হিসেবে ঘোষণা করেছে। সারা বছর ধরে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর এক চতুর্থাংশ পেরিয়ে এসেছি আমরা। আজ থেকে এক শতাব্দী আগে বিজ্ঞানের জগৎ তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল কোয়ান্টাম বিপ্লবে। আইনস্টাইনের বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতার ছোঁয়ায় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের আঁচ তখনও বেশ গনগনে। দেশে বিদেশে প্রতি নিয়ত বক্তব্য রেখে চলেছেন তিনি। দু-দশক আগে প্ল্যাঙ্কের দেওয়া শক্তির ধারণা আমূল বদলে দিয়েছে বিজ্ঞানীদের চিন্তার জগৎ। তাঁর মতে, বিকিরণের সময় শক্তির পরিবর্তন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে হয় না, হয় প্যাকেট- প্যাকেট আকারে, যার পারিভাষিক নাম, 'কোয়ান্টা'। এটি শক্তির নতুন একক। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।
তার পরের আড়াই দশক একে একে আইনস্টাইন, নীলস বোর, ল্যুই দ্য ব্রগলী, প্রমুখ দিকপালের হাতে নতুন এই তত্বের ভিত ক্রমশ শক্ত হয়। কোয়ান্টাম তত্ত্বের গোড়ার দিকের চারটি মূল স্তম্ভ- প্লাঙ্কের কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ তত্ব, আইনস্টাইনের আলোক তড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা, বোরের হাইড্রোজেন পরমাণু মডেল, ডিব্রগলির হাইপোথিসিস এইসময়ের ফসল। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত এই আড়াই দশককে বলা হয় প্রাচীন কোয়ান্টাম তত্ত্বের যুগ, তারপরেই মূলত আরম্ভ হয় কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের কাল।
১৯২৫ সালের জুন মাসে, ২৩ বছর বয়সি হে জ্বরে আক্রান্ত তরুণ হাইজেনবার্গ, আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য উত্তর জার্মানির এক ছোট্ট পরাগমুক্ত দ্বীপ হেলগোল্যান্ডে যান। সেই সময়, নিলস বোরের কাছ থেকে পাওয়া একটি সমস্যা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বিশেষ করে, তিনি ভাবছিলেন কীভাবে সহজেই কোয়ান্টাম সিস্টেমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাশি (ফ্রিকোয়েন্সি, প্রশস্ততা, স্থান, ভরবেগ ইত্যাদি) পরিমাপ করা যায়। এগুলিকে ধ্রুপদী রাশি হিসাবে বিবেচনা করার পরিবর্তে, তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গাণিতিক ভিত্তিগুলিকে বিশুদ্ধ গাণিতিক অপারেটর হিসাবে বিবেচনা করে লেখার চেষ্টা করছিলেন।
আরও পড়ুন- কোয়ান্টাম দূরত্বের আবিষ্কার কীভাবে বদলে দেবে যাবতীয় কম্পিউটারের চেহারা?
এই সেই হেলগোল্যান্ড, যেখানকার উত্তরের তাজা বাতাসে আরোগ্য লাভের জন্য ১০০ বছর আগে এসেছিলেন হে জ্বরে আক্রান্ত তরুণ হাইজেনবার্গ, এখানেই ভিত্তিপ্রস্থর রচিত হয় আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার। তাঁর কথায়, কোনো বস্তুর অবস্থান ও ভরবেগের গুণফল ভরবেগ ও অবস্থানের গুণফলের সমান নয়। অর্থাৎ, দুটি পর্যবেক্ষণযোগ্য পরিমাপ কখনই পরিবর্তনযোগ্য নয়। তবে, সাধারণ সংখ্যাগুলি প্রকৃতিতে বিনিময়যোগ্য বা কম্যুটেবল।
গণনার সময় তিনি আবিষ্কার করেন যে আমরা যদি ম্যাট্রিক্স আকারে রাশিগুলিকে গুণ করি তবে বিভিন্ন কোয়ান্টাম সিস্টেমের জন্য সমস্ত তথ্য গণনা করা সম্ভব। উত্তেজিত, হাইজেনবার্গ রাত ৩টের সময় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। খানিকটা হেঁটে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করলেন। সেই রাত্রির রোমাঞ্চকর অনুভূতি তাঁর নিজের লেখায় প্রতিফলিত হয় -"আমার গণনায় বর্ণিত নতুন 'কোয়ান্টাম' মেকানিক্সের সামঞ্জস্য সম্পর্কে হঠাৎ করে আমার আর কোনও সন্দেহ ছিল না, আমার অনুভূতি ছিল যে আমি জিনিসের পৃষ্ঠের বাইরে চলে গিয়েছি এবং একটি অদ্ভুত সুন্দর অভ্যন্তর দেখতে শুরু করেছি এবং এই চিন্তায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল যে আমাকে এখন গাণিতিক কাঠামোর বিষয়ে তদন্ত করতে হবে"।
পরের বছর আর এক পদার্থ বিজ্ঞানী শ্রয়েডিঙ্গার তরঙ্গ সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ নোবেল কমিটি ১৯৩২ সালে হাইজেনবার্গকে ও ১৯৩৩ সালে শ্রয়ডিঙ্গারকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে ।
এর পরে, অনেক পদার্থবিজ্ঞানীর মেধার ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, বিশেষত ফাইনম্যান ১৯৪৯ সালে শুইনগার এবং তোমোনাগার সঙ্গে কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স তৈরি করেছিলেন, ডেভিড বোম এবং ডি ব্রগলি ১৯৫২ সালে পাইলট তরঙ্গ তত্ত্ব (যা ডি ব্রগলি-বোম তত্ত্ব নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই কোয়ান্টাম নীতির উপর ভিত্তি করে প্রথম লেজার তৈরি হয় ১৯৬০ সালে। এটিতে আইনস্টাইনের অবদান অপরিসীম। ১৯৬৪ সালে, বেল এনট্যাঙ্গলমেন্টের ধারণা দিয়েছিলেন, এর পরীক্ষামূলক প্রমাণ মেলে ৭০-এর দশকে। তখন তৎকালীন বৈজ্ঞানিক মহল ‘স্পুকি অ্যাকশনের’ অস্তিত্ব স্বীকার করে।
আধুনিক যুগের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম সুপারপজিশন এবং এনট্যাঙ্গলমেন্টের হাত ধরে। আমরা সচারাচর যে কম্পিউটার ব্যবহার করি তা কাজ করে ‘বিট’ আদান প্রদানের মাধ্যমে। এই ‘বিট’ হতে পারে ০ বা ১। ১ মানে হ্যাঁ সূচক নির্দেশ আমরা কম্পিউটারকে দিচ্ছি, আর ০ মানে না সূচক। হয় ‘হ্যাঁ’, নয় ‘না’, যে কোনো একটি ভাষা বোঝে আমাদের পরিচিত ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার। ওদিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কাজ করে কোয়ান্টাম বিট বা ‘কিউবিটের’ মাধ্যমে। এই কিউবিট একই সঙ্গে ০ ও ১ দুটোই হতে পারে। ফলে কম্পিউটারের কাজ করার গতি ও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। অনেক জটিল সমস্যার সমাধানে- যেমন জলবায়ুর পরিবর্তন, ইলেকট্রনিক্স এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রকে উন্নত করতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জুড়ি মেলা ভার।
আরও পড়ুন- শতবর্ষে বোসন: তাঁর আবিষ্কারেই বিশ্বজয় বিজ্ঞানীদের! কেন নোবেল পেলেন না সত্যেন্দ্রনাথ?
জাতিসংঘ ২০২৫ সালকে আন্তর্জাতিক কোয়ান্টাম বর্ষ (IYQ2025) হিসেবে ঘোষণা করেছে। সারা বছর ধরে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ বছর জুন মাসে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান ও এর প্রয়োগ বিষয়ক একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে হেলগোল্যান্ডে, যেখানে আজ থেকে ১০০ বছর আগে হাইজেনবার্গ আবিষ্কার করেছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ম্যাট্রিক্স রুপ।
কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে গবেষণার অগ্রগতির লক্ষ্যে ভারত ২০২৩ সালের এপ্রিলে জাতীয় কোয়ান্টাম মিশন চালু করে। ৬০০০ কোটির এই মিশনের লক্ষ্য ২০৩১ সালের মধ্যে ৫০-১,০০০ ফিজিক্যাল কিউবিট-সহ কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা এবং গ্রাউন্ড স্টেশনগুলির মধ্যে (২০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত) কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গোড়ার দিকে সবকিছুই বিমূর্ত ছিল। যে সমস্ত বিজ্ঞানীদের কঠিন অধ্যাবসায় ও মেধায় ভর করে বিকশিত হয়েছিল শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানের শাখা, তাঁদের অনেকেই কোয়ান্টামের বিমূর্ততায় হতাশ হয়েছেন মাঝে মধ্যেই। মনে পড়ে কালজয়ী পদার্থ বিজ্ঞানী, ফ্যাইনম্যানের সেই বিখ্যাত উক্তি-“I think I can safely say that nobody understands quantum mechanics“, সেখান থেকে আজকের এই উত্তরণ, সত্যি অকল্পনীয়। LED, leaser, MRI Scanner থেকে শুরু করে আজকের কোয়ান্টাম কম্পিউটার, সবের পিছনেই রয়েছে এই বিষ্ময়কর কোয়ান্টাম মেকানিক্স। শতবর্ষ পেরিয়ে মনে হতেই পারে, প্রযুক্তিগত প্রয়োগ ছাড়া বিজ্ঞানের সফল এই শাখা সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু না, পদার্থ বিজ্ঞানীরা খুঁজে চলেছেন আরও কিছু মৌলিক প্রশ্নের-এন্টাঙ্গেলমেন্টের প্রকৃত কারণ কী? হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতিতে যে অনির্দিষ্টতা লুকিয়ে আছে, তার প্রকৃত কারণ কী? তবে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে অদূর ভবিষ্যতেই এর উত্তর মিলবে, কারণ পদার্থবিদ্যা তো আর জাদু নয়!

Whatsapp
