কোথায় হলো ভুল? কেন ১০ ম্যাচ জিতেও ফাইনালে হার বিরাট-রোহিত-শামিদের?
Australia Wins World Cup 2023 : অতিরিক্ত শিশিরের কারণে একেবারেই ধ্বসে গেল ভারতীয় বোলিং। স্পিনারদের হাতে বল ঘুরল না, ফাস্ট বোলাররা গতি তুলতে পারলেন না।
গত ৫ অক্টোবর আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছিল ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ। দেড় মাসের দীর্ঘ যাত্রাপথ শেষ হলো সেই আহমেদাবাদের মাঠেই। মাঠ একই থাকলেও বদলে গিয়েছিল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রথম ম্যাচে যুযুধান পক্ষ ছিল নিউজিল্যান্ড এবং ইংল্যান্ড। আর ফাইনালে খেলা হলো ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে। বিশ্বকাপের যাত্রাপথের সূচনা অজিরা হার দিয়ে করলেও, শেষ পর্যন্ত জয়ের হাসি হাসলেন সেই হলুদ জার্সিধারীরাই। নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে ভারতকে ৬ উইকেটে হারিয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাসে নিজেদের ষষ্ঠ খেতাব ঘরে তুললেন অজিরা। অ্যালেন বর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্কের পর তালিকায় উঠে এল প্যাট কামিন্সের নাম। এই তালিকার প্রথম বোলার অধিনায়ক হিসেবে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়ে নিলেন প্যাট। চোখের জলেই অস্ট্রেলিয়াকে অভিনন্দন জানাল টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু, টানা ১০টা ম্যাচ অপরাজিত থাকার পরেও কীভাবে ফাইনালে এসে পরাজিত হলো ভারত? নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ।
টসে হার
নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে খেলা মানেই টসের ভূমিকা থাকবেই। যে দল টস জিতে যায়, সাধারণত সেই দল জিতে যায়। এই ম্যাচে প্রথমেই টসে জিতে যায় অস্ট্রেলিয়া। এই মাঠে শিশিরের কারণে সেকেন্ড ইনিংসে বল করতে বোলারদের সমস্যা হয়। বিশেষত স্পিনারদের হাতে বল ঘোরে না। আর তা ভালোভাবেই জানতেন প্যাট কামিন্স। সেই কারণেই টস জিতে সঙ্গে সঙ্গেই বোলিং করার সিদ্ধান্ত নেন কামিন্স। অস্ট্রেলিয়ার সবথেকে বড় অস্ত্র ছিল এই সিদ্ধান্তই। সেকেন্ড ইনিংসে স্পিনারদের হাতে বল ঘুরল না। পুরো ম্যাচ ঘুরে গেল অস্ট্রেলিয়ার দিকে।
আরও পড়ুন- দ্রাবিড় শিখিয়েছেন: যত্ন করে হারতে শেখাটাও জরুরি
ভারতের অতি রক্ষণাত্মক ব্যাটিং
রোহিতের আগ্রাসী ইনিংসের উপর ভর করে ম্যাচ আক্রমণাত্মকভাবেই শুরু করেছিল ভারত। কিন্তু রোহিতের বিদায়ের পর টিম ইন্ডিয়ার ইনিংস যত গড়িয়েছে, রানের গতি ততই শ্লথ হতে থেকেছে। প্রথম ১০ ওভারে ৮০ রান তোলা ভারত পরের ২০ ওভারে মাত্র ৭২ রান তোলে! ফলে মন্থর গতিতে চলতে থাকা এই ইনিংস ২৪০ রানের মধ্যেই আটকে যায়। গোটা টুর্নামেন্টে আজ পর্যন্ত ব্যাটিংয়ে কোনওরকম পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হয়নি ভারতকে। কিন্তু ফাইনালে সেই প্রথম হোঁচট খেতে হয়েছে দেশকে, তাও আবার অস্ট্রেলিয়ার মতো বিরাট বোলিং লাইন আপের সামনে। দুর্দান্ত শুরুর পরেও মাঝ ওভারের ব্যাটিং এতটাই ব্যর্থ ছিল যে, স্কোরবোর্ডে বড় রান যোগ করতে পারলেন না কোহলি-রাহুলরা। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানো আর অতিরক্ষণাত্মক ব্যাটিংই যেন কাল হয়ে গেল ভারতের।
প্রায় ৯৭ টা বল কোনও বাউন্ডারি ছাড়া খেলে ভারত। প্রথম পাওয়ার প্লে শেষ হওয়ার পরে ফাস্ট বোলারদের টার্গেট করতে গিয়ে একটা চার মারলেন আইয়ার। কিন্তু তারপরে ৯৭ টা বলে কোনও বাউন্ডারিই মারতে পারল না ভারত। ১০ ওভারের পর থেকে ভারত বাউন্ডারি ছাড়াই ১৬ ওভার কাটিয়ে দেয়। শেষে ম্যাক্সওয়েলের বলে একটা বাউন্ডারি মেরেছিলেন রাহুল। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হয়নি। তার কয়েকটা বল পরেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যান কে এল রাহুল। মন্থর ইনিংসকে গতি দেওয়া সম্ভব হলো না আর। লাগাম টেনে ধরলেন অজি বোলাররা। কোহলি আর রাহুল ইনিংস টেনে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেই ইনিংস নায়কচিত ছিল না, বরং ওই ইনিংসগুলিই ছিল ভারতের হারের কারণ।
কে এল রাহুল এবং বিরাট কোহলি মাঝের ওভারে স্ট্রাইক রোটেট করতে গিয়ে ম্যাচের গতি বাড়াতে পারলেন না। একই ভাবে স্লো খেললেন রবীন্দ্র জাদেজা। পঞ্চম বোলারদের টার্গেট না করে তারা চাইছিলেন ম্যাচ স্থির করতে। তাদের লক্ষ্য ছিল পরে ম্যাচের গতি বাড়াবেন। কিন্তু, তারা যা ভেবেছিলেন সেটা হলো না। ফাস্ট বোলারদের টার্গেট করার সময় ব্যর্থ হলেন ভারতীয় ব্যাটাররা। ফলে মাত্র ২৪০ রানে থেমে গেল ভারতের ইনিংস। একটা সময় মনেও হচ্ছিল এই ইনিংস ৩০০-এর কাছাকাছি যাবে। কিন্তু, শেষে প্রায় ৬০ রান কম রয়ে গেল। পরবর্তীতে, সুবিধা পেয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইন আপ।
মাঝারি মানের টার্গেট, মাঝারি মানের বোলিং
ফাইনালের ম্যাচে ভারতের ব্যাটিং যেমন খুবই মাঝারি মানের হয়েছে, তেমন বোলিং এবং ফিল্ডিংও বেশ সাধারণ। প্রথমদিকে মহম্মদ শামি এবং জসপ্রিত বুমরাহ ভালো শুরু করলেও বাকি বোলারদের বল ছিল অত্যন্ত সাধারণ। শামি এবং বুমরাহ বিশ্বকাপের অন্যান্য ম্যাচগুলির মতোই ভালো বোলিং করেছেন। দ্বিতীয় ওভারেই মহম্মদ শামির পেসের কাছে হেরে যান ডেভিড ওয়ার্নার। মিচেল মার্শও টিকতে পারেননি বুমরাহর সামনে। অভিজ্ঞ স্টিভ স্মিথকেও প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা লাগাতে হয় আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। সৌভাগ্যবশত উইকেট পেয়ে যান বুমরাহ। ৪৭ রানের মধ্যেই তিনটি উইকেট হারিয়ে মনে হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া পুরোপুরি ব্যাকফুটে চলে গেছে।
কিন্তু সেই জায়গা থেকে দলকে তুলে আনেন হেড। মাথা ঠান্ডা রেখে হেডের যোগ্য সঙ্গ দেন মার্নাস লাবুশেন। এই দুই ব্যাটারের ম্যারাথন জুটিতে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই চলে আসে অজিদের হাতে। তাঁরাই ছিলেন এই ম্যাচের 'হিরো'। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের পর ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে সেঞ্চুরি তুলে নেন ট্রাভিস হেড। অন্যদিকে ধৈর্যের পরিচয় দেন লাবুশেন। আর এই জুটির উপর ভর করেই ফাইনালের গণ্ডি টপকে যায় অস্ট্রেলিয়া। ১২০ বলে ১৩৭ রান করেন হেড এবং ৫৮ রানে অপরাজিত থাকেন লাবুশেন। বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত প্রথম স্কোয়াডে এদের মধ্যে একজনও ছিলেন না। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে এরা দু'জনই অস্ট্রেলিয়ার হাতে তুলে দিলেন বিশ্বকাপ।
প্যাট কামিন্সের চ্যালেঞ্জ
ম্যাচের আগে এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্যাট কামিন্স বলেছিলেন, তাঁরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছেন, ভারতকে শুধু হারাবেনই না, পাশাপাশি ভারতের ১ লক্ষ ৩২ হাজার জনতাকেও শান্ত করে দেবেন প্যাট। আর তাই করে দেখালেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। প্রথম থেকেই দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে ভারতীয় ব্যাটিংকে শান্ত করে রেখেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডাররা। ডেভিড ওয়ার্নার, ট্রেভিস হেড, মার্নাস লাবুশেন, যশ হেজেলউড সবাই নিজের পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে ফিল্ডিং করলেন। ফলে, প্রায় ২০ থেকে ৩০ রান এমনিতেই বেঁচে গেল ফিল্ডিংয়ের তরফ থেকে।
তার সঙ্গে ছিল প্যাট কামিন্সের দুরন্ত অধিনায়কত্ব। নিজে বোলার হওয়ার কারণে এবং একটা লম্বা সময় আইপিএল খেলার কারণে, ভারতের পিচ তিনি বেশ ভালোভাবেই চেনেন। সেই কারণে কোন জায়গাতে কখন ভালো বোলারদের নিয়ে আসতে হবে, কখন পঞ্চম বোলারকে দিয়ে ওভারগুলো বের করে নিতে হবে তা ভালভাবেই জানেন প্যাট। ফলে, বোলার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এবং ফিল্ডিং সাজানোর ক্ষেত্রে কোনও সমস্যায় পড়তে হলো না প্যাট কামিন্সকে।
দ্বিতীয় ইনিংসে যখন অস্ট্রেলিয়া বল করতে নামল, সেই সময় প্রথমদিকে ভারতীয় বোলাররা আগ্রাসী বোলিং করতে পারলেও, পরবর্তীকালে অতিরিক্ত শিশিরের কারণে একেবারেই ধ্বসে গেল ভারতীয় বোলিং। স্পিনারদের হাতে বল ঘুরল না, ফাস্ট বোলাররা গতি তুলতে পারলেন না। ভারতীয় বোলারদের টার্গেট একেবারেই ভুল প্রমাণ হলো। প্রথম থেকেই ভারতীয় বোলারদের টার্গেট ছিলেন লাবুশেন। এমনকী তিনি যখন ব্যাট করতে নামছেন, তখন তাঁকে খানিক স্লেজিংও করেন বিরাট কোহলি। কিন্তু, তার কোনও প্রভাবই পড়ল না লাবুশেনের উপরে। বরং উইকেটের উপরে একেবারে বরফের মতো জমে গেলেন তিনি। উল্টোদিকে তখন ঝড়ের গতিতে ব্যাট চালাচ্ছেন হেড। তাই লাবুশেনকে একটা দিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আর তিনি নিজের যথাযথ কাজটাই করে দেখালেন। স্ট্রাইক রেটের কথা না চিন্তা করে যেন পুরো টেস্ট ক্রিকেটের মতো ইনিংস খেলে গেলেন লাবুশেন। ফলে তাঁকে তো আউট করা গেলই না, উল্টে হেডও ম্যাচ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
এটাই চেয়েছিলেন প্যাট কামিন্স। সেই কারণে, ফাইনাল ম্যাচে দু'জনেই খেলে গেছেন প্রপার ক্রিকেটিং শট। কোনও রিভার্স সুইপ, কোনও ফ্লিক, কোনও এরকম আলংকারিক শট নয়। সোজা ব্যাটে ফ্ল্যাট শট খেলে ম্যাচ বের করেছেন দুই ব্যাটসম্যান। ফলে, ফিল্ডার সেট, বোলারদের নিয়ন্ত্রণ কোনওকিছুই যেন ঠিক হলো না ভারতের জন্য। প্রথমদিকে টিম ইন্ডিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে পরাজিত হয়ে একটা সময় যেখানে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাওয়ার মুখে ছিল কামিন্সের দল, সেখানেই টুর্নামেন্টের শেষ দুই ম্যাচে যথাক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতকে হারিয়েই বিশ্বকাপের খেতাব হাতে তুলে নিলেন কামিন্সরা।
আরও পড়ুন- চরম মুহূর্তে কেন ব্যর্থ রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা?
বিরাট রোহিতের চোখে জল
এবারের বিশ্বকাপ ভারতীয় দল আরও বেশি করে জিততে চেয়েছিল রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলির জন্য। সম্ভবত এটাই তাঁদের দু'জনের শেষ বিশ্বকাপ। সাদা বলের ক্রিকেটে দু'জনেই ভারতের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় উপরের দিকে থাকবেন। কোহলি একবার বিশ্বকাপ পেয়েছেন বটে, তবে তা নিতান্তই তরুণ তুর্কি হিসেবে। সেই বিশ্বকাপে ম্যাচ জেতানোর দায়িত্বভার কোহলির কাঁধে ছিল না। পাশাপাশি ২০১১ বিশ্বকাপে কোহলির পারফরমেন্স অভাবনীয় কিছু ছিল না। অন্যদিকে রোহিত বাদ পড়ে গিয়েছিলেন ২০১১ সালে টুর্নামেন্ট থেকে।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে, লিওনেল মেসির উদাহরণ দিয়ে রোহিত শর্মা বুঝিয়েছিলেন, ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে এসে বিশ্বজয় তাঁরা কত গভীরভাবে চাইছেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল রোহিতের কাছে। একসঙ্গে ট্রফি হাতে উদযাপন করার স্বপ্ন আর বাস্তবায়িত হলো না। দু'জনেই নিজেদের সর্বস্ব চেষ্টা করলেও কোথাও সেই এক্স ফ্যাক্টর যেন বাদ থেকে গেল। টুর্নামেন্টের প্রথম দশটা ম্যাচের মধ্যে একটাতেও হারেনি ভারত। টুর্নামেন্টে ৭৫৬ রান করে সচিন তেন্ডুলকারকেও ছাপিয়ে গেলেন কোহলি। তিনটি শতরান এবং নয়টি অর্ধশত রানের মালিক তিনি এই বিশ্বকাপে।
অন্যদিকে, ঝড়ের গতিতে ব্যাটিং করে রোহিত বারবার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নিজের রেকর্ড নয় বরং দলের সাফল্যই তাঁর কাছে আগে। কিন্তু দিনের শেষে এসে যাবতীয় প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে গেল। পদকের রং রয়ে গেল রুপোলিই। ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বজয় নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, থমথমে মুখ নিয়ে মাঠের মাঝেই দাঁড়িয়ে রইলেন ভারতীয় ক্রিকেটের দুই মহাতারকা। জয়ী দলের সদস্যদের শুভেচ্ছা জানানোর সময় রোহিতের চোখেও এসে গিয়েছিল জল। বিশ্বকাপ শেষ। ব্যর্থ দেড় মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম। ব্যর্থ সেইসব কৌশল, ব্যর্থ টিম মিটিং, ব্যর্থ বিরাট-রোহিতের রানের পাহাড়, ব্যর্থ মহম্মদ শামির ২৪ টা উইকেটের রেকর্ড, ব্যর্থ সিরাজের রোনাল্ডোসুলভ সেলিব্রেশন। সর্বোপরি, ব্যর্থ গোটা ভারতের আশা ভরসা, সমর্থন। নিজের চ্যালেঞ্জ জিতেই গেলেন প্যাট কামিন্স। টিম মিটিংয়ে কোথায় কী ভুল হলো সেই নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবেই। কিন্তু, ভারতীয়দের খানখান হওয়া স্বপ্ন তাতে জোড়া লাগবে না আর।