কেন ভারতের বিরোধিতা করে পাকিস্তানকে সমর্থন করছে আজারবাইজান, তুরস্ক?
Azerbaijan–Pakistan Relation: ভারত যখন প্রত্যাঘাত হিসেবে অপারেশন সিঁদুরের মাধ্যমে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা করে তারপরেই তুরস্ক ও আজারবাইজান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পদক্ষেপের প্রকাশ্যে নিন্দা করে।
পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে ভারতের প্রত্যাঘাতের পর, স্বাভাবিকভাবেই চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে এই প্রতিবেশী এবং শক্তিধর দেশগুলি ছাড়াও ভারত পাক সম্পর্কের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তুরস্ক ও আজারবাইজানের মতো দেশও। এই দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কও নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। ভারত-পাক সংঘাতের আবহে এই দুই দেশ পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে থাকায় ভারতজুড়ে তুরস্ক ও আজারবাইজানের পণ্য বর্জন এবং এই দেশগুলিতে ঘুরতে যাওয়া বাতিল করার ধুম পড়েছে। ইজমাইট্রিপ, মেকমাইট্রিপ এবং ইক্সিগোর মতো অ্যাপের তথ্য বলছে তুরস্ক ও আজারবাইজান পর্যটনের বুকিং কমছে দ্রুত। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা আপেল এবং মার্বেলের মতো তুর্কি পণ্য বর্জন শুরু করেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তুরস্ক ও আজারবাইজানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ধাক্কা খেল?
পহেলগাঁও হামলার জবাবে ভারত যখন প্রত্যাঘাত হিসেবে অপারেশন সিঁদুরের মাধ্যমে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা করে তারপরেই তুরস্ক ও আজারবাইজান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পদক্ষেপের প্রকাশ্যে নিন্দা করে। আজারবাইজান সরকার ভারতের সামরিক অভিযানের সমালোচনা করে একটি সরকারি বিবৃতি প্রকাশ করে। তাতে বেসামরিক হতাহতের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানায় আজারবাইজান সরকার।
তুরস্কের বিদেশ মন্ত্রক ভারতের বিমান হামলাকে 'উস্কানিমূলক' পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করে বড় সংঘাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। এই সংঘাত পর্বেই ভারত জানতে পারে, পাকিস্তান তুরস্কের তৈরি অ্যাসিসগার্ড সোঙ্গার ড্রোন ব্যবহার করছে, একে সোয়ার্ম ড্রোনও বলা হয়। ভারতীয় সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে পাকিস্তানের তুর্কি ড্রোন ব্যবহার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আগুনে আরও ঘি ঢালছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, ভারতের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রাচীরের মতো কঠিন, পাকিস্তান তা ভেঙে ফেলতে পারেনি। তুর্কি ড্রোন হোক বা অন্য কিছু, তা ভারতের প্রযুক্তির সামনে ব্যর্থ।
আরও পড়ুন- মোদি থাকতে কেন ট্রাম্প তড়িঘড়ি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে দিলেন?
ভারত, তুরস্ক এবং আজারবাইজানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা
তুরস্ক এবং আজারবাইজান দুইয়ের সঙ্গেই ভারতের বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে সীমিত, তবে ভারত দুই দেশের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালো জায়গায় রয়েছে।
ভারত-তুরস্ক বাণিজ্য
২০২৪-২৫ সালের এপ্রিল-ফেব্রুয়ারি মাসে, তুরস্কে ভারতের রপ্তানি ৫.২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২৩-২৪ সালে ছিল ৬.৬৫ বিলিয়ন ডলার। এটি ভারতের মোট রপ্তানির প্রায় ১.৫% বা ৪৩৭ বিলিয়ন ডলার।
একই সময়কালে, তুরস্ক থেকে ভারতের আমদানির পরিমাণ ছিল ২.৮৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ সালে ৩.৭৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। এটি ভারতের মোট ৭২০ বিলিয়ন ডলার আমদানির প্রায় ০.৫%।
ভারত-আজারবাইজান বাণিজ্য
২০২৪-২৫ সালের এপ্রিল থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ভারত তুরস্ক থেকে ২.৮৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা ২০২৩-২৪ সালে ছিল ৩.৭৮ বিলিয়ন ডলার। এটি ভারতের মোট ৭২০ বিলিয়ন ডলারের আমদানির প্রায় ০.৫%।
২০২৪-২৫ সালের এপ্রিল-ফেব্রুয়ারি মাসে আজারবাইজানে ভারতের রপ্তানি ছিল ৮৬.০৭ মিলিয়ন ডলারের, যা ২০২৩-২৪ সালের ৮৯.৬৭ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় সামান্য কম। এটি ভারতের সামগ্রিক রপ্তানির মাত্র ০.০২%।
তুরস্কে ভারত কী রপ্তানি করে?
খনিজ জ্বালানি এবং তেল (২০২৩-২৪ সালে ৯৬০ মিলিয়ন ডলার), বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, গাড়ি এবং এর যন্ত্রাংশ, রাসায়নিক, ওষুধ, ট্যানিং এবং রঞ্জনবিদ্যার জিনিসপত্র; প্লাস্টিক, রাবার; তুলা; মানুষের তৈরি তন্তু এবং ফিলামেন্ট, লোহা এবং ইস্পাত।
তুরস্ক থেকে ভারত কী আমদানি করে?
মার্বেল, তাজা আপেল (প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার), সোনা, শাকসবজি, চুন, সিমেন্ট, খনিজ তেল (২০২৩-২৪ সালে ১.৮১ বিলিয়ন ডলার), রাসায়নিক, প্রাকৃতিক বা সংস্কৃত মুক্তা এবং লোহা এবং ইস্পাত।
আজারবাইজানে ভারত কী রপ্তানি করে?
তামাক এবং তামাকজাত পণ্য (২০২৩-২৪ সালে ২৮.৬৭ মিলিয়ন ডলার); চা, কফি; শস্য; রাসায়নিক; প্লাস্টিক; রাবার; কাগজ ও কাগজের বোর্ড এবং সিরামিক পণ্য।
আজারবাইজান থেকে ভারত কী আমদানি করে?
পশুখাদ্য, সুগন্ধি তেল, সুগন্ধি, চামড়া (২০২৪-২৫-এর এপ্রিল-ফেব্রুয়ারি সময়কালে ১.৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
ভারত ও তুরস্ক ১৯৭৩ সালে একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে, ১৯৮৩ সালে, তারা অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার জন্য একটি যৌথ কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়।
ভারত ও এই দেশগুলির জনগণের মধ্যে সম্পর্ক কেমন?
তুরস্কে প্রায় ৩,০০০ ভারতীয় নাগরিক বসবাস করেন, যার মধ্যে ২০০ জন পড়ুয়াও রয়েছেন। আজারবাইজানে, ভারতীয় সম্প্রদায়ের আকার ছোট, ১,৫০০ জনেরও বেশি লোকের বাস সেখানে।
তুরস্ক ও আজারবাইজানে ভারতীয় পর্যটকদের সংখ্যা
২০২৩ সালে আনুমানিক ৩ লক্ষ ভারতীয় পর্যটক তুরস্ক ভ্রমণ করেছিলেন। ২ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় আজারবাইজান ভ্রমণ করেছিলেন। আর গত এক সপ্তাহে আজারবাইজান এবং তুরস্কের জন্য বুকিং ৬০% কমেছে। বুকিং বাতিল ২৫০% বেড়েছে বলে জানাচ্ছে মেকমাইট্রিপের ১৪ মে তারিখের এক বিবৃতি।
পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগানের সাক্ষাৎ
পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগানের সাক্ষাৎ
সম্প্রতি, অর্থনৈতিক ও সামরিক-কারিগরি সহযোগিতার মাধ্যমে আজারবাইজান-পাকিস্তানের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধের সময় পাকিস্তান আজারবাইজানকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল, আজারবাইজানের বিশেষ বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল এবং প্রশিক্ষণও দিয়েছিল। ২০২০ সালের নভেম্বরে আজারবাইজানের জয়ের পর বাকুর রাস্তা পাকিস্তানের পতাকায় ছেয়ে যায়।
২০২০ সালের পরে এই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। পাকিস্তানে তৈরি সামরিক জেট কেনে আজারবাইজান এবং পাকিস্তান কেনে আজারবাইজানের গ্যাস।
২০২৪ সালের ১১ জুলাই আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ পাকিস্তান সফরে যান। দুই দেশ বাণিজ্য, বাণিজ্য, টেলিযোগাযোগ এবং খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করেছেন। কেন আজারবাইজান আর পাকিস্তানের বন্ধুত্ব এত গাঢ় হলো?
আরও পড়ুন- ২০২২ সালেই সতর্ক করেছিলেন! রাহুল গান্ধির কথায় আমল দিলে এড়ানো যেত পাক হামলা?
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে স্বঘোষিত নাগোর্নো-কারাবাখ প্রজাতন্ত্রের সামরিক দখল এবং সেখানে বসবাসকারী ১,০৫,০০০ আর্মেনিয়কে জোর করে বাস্তুচ্যুত করার পর, আজারবাইজান নিজেকে দক্ষিণ ককেশাসে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের যোগ্যতম দাবিদার বলে মনে করতে থাকে। এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে ওঠার জন্য আজারবাইজান দক্ষিণ ককেশাসের বাইরের বিষয়গুলিতেও নিজের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা বোধ করে।
এই প্রেক্ষাপটেই, আজারবাইজান অন্যান্য তুর্কি এবং মুসলিম দেশগুলির সঙ্গে নিজের সম্পর্ক স্থাপনে বিনিয়োগ করছে, যেমন তুরস্ক এবং মধ্য এশিয় রাষ্ট্রগুলি। সাম্প্রতিককালে, আজারবাইজানে তুর্কি এবং মধ্য এশিয় কর্মকর্তাদের মধ্যে সফরের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আজারবাইজান, তুরস্ক এবং কাজাখস্তান মধ্য এশিয়া, ক্যাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণ ককেশাস এবং তুরস্কের মাধ্যমে চিনকে ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য মধ্য করিডোর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগোতে চায়। আজারবাইজান কিছুকাল আগেই চিনের সঙ্গেও কৌশলগত অংশীদারিত্ব স্থাপন করেছে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাড়ানো আজারবাইজানের বৃহত্তর কৌশলেরই অংশ। এতে আজারবাইজানের বিদেশনীতির তুর্কি ও মুসলিম দিকটি যেমন শক্তিশালী হবে এবং বৃহত্তর ইউরেশিয়ায় আজারবাইজানের গুরুত্বও বাড়বে।

আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি আলিয়েভের সঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ
পাকিস্তানের সঙ্গে আজারবাইজানের সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টার আরেকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও আছে। বাকুর আগ্রহ, পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের থেকে যুদ্ধের কৌশল শেখা। জোর করে নাগোর্নো-কারাবাখ দখলের পর, আজারবাইজান ইরানের সীমান্তবর্তী দক্ষিণ আর্মেনিয়ার সিউনিক অঞ্চলও দখলে আনতে চায়। সিউনিক আজারবাইজানকে তুরস্ক থেকে আলাদা করেছে। রাষ্ট্রপতি আলিয়েভের ভাষায়, সিউনিক আসলে তুর্কি বিশ্বকে বিভক্ত করে, যা ইস্তাম্বুল থেকে কাজাখস্তান-চিন সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। যেহেতু সিউনিক আর্মেনিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্তের মধ্যে অবস্থিত, তাই আজারবাইজান যদি সিউনিক অঞ্চল দখল এবং নিজের সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা ভাবে তাহলে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হবে। কিন্তু ধীরগতিতে দখলের নীতি ইতিমধ্যেই চলছে, আর্মেনিয়ান ভূখণ্ডের আজারবাইজানের সৈন্যদের অনুপ্রবেশ চলমান।
পাকিস্তানকে সহযোগিতা করে ভারতকে প্ররোচিত করাও আজারবাইজানের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত। এই অঞ্চলে ভারতের ক্রমে বাড়তে থাকা প্রভাব আটকানোর লক্ষ্যে আজারবাইজান আর্মেনিয়া-ভারত সামরিক-প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন হয়েছে। বারবার আজারবাইজান অভিযোগ করেছে যে ভারতই আসলে আর্মেনিয়াকে উস্কাচ্ছে। প্রকাশ্যে ভারতের সমালোচনা করে এবং কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন করে, আজারবাইজান ভারতকে বার্তা দিতে চায় যে বাকু আগামীতে নয়াদিল্লির জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। পাকিস্তান নিজের ধ্বসে পড়া অর্থনীতি নিয়ে নাজেহাল। এমতাবস্থায় ইসলামাবাদ পাকিস্তানের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আজারবাইজানি বিনিয়োগ টানতে চায় এবং বাকুতে অস্ত্র বিক্রি করে টাকাও রোজগার করতে চায়।