অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ, হাসিনার হাতেই ছারখার বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার

Bangladesh Quota Protest: সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম লিখতে পারতেন হাসিনা। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী শাসক হিসেবে।

 ক্ষুব্ধ যারা, লুব্ধ যারা,

মাংসগন্ধে মুগ্ধ যারা, একান্ত আত্মার দৃষ্টিহারা
শ্মশানে প্রান্তচর, আবর্জনাকুণ্ড তব ঘেরি
বীভৎস চিৎকারে তারা রাত্রিদিন করে ফেরাফেরি,
নির্লজ্জ হিংসায় করে হানাহানি।
শুনি তাই আজি
মানুষ-জন্তুর হুহুঙ্কার দিকে দিকে উঠে বাজি’।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মধ্যিখানে কাঁটাতারের বেড়া উঠলেও, দুই বাংলার মধ্যে আজও নাড়ির স্পন্দন হয়ে বিরাজ করছেন কবি। শত শত মানুষের রক্তে স্নাত বাংলাদেশকে নিয়ে আলোচনায় এই মুহূর্তে তাঁর লেখা ছত্রগুলি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ১৯৩৫ সালের মে মাসে, নিজের জন্মদিনে পৈশাচিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়ে ছত্রগুলি রচনা করেছিলেন কবি। আর ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দাঁড়িয়ে, তাঁর ‘সোনার বাংলা’র বুকেই ফ্যাসিবাদী শক্তির ছায়া গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে। রুটি-রোজগারের সমানাধিকারের দাবি জানাতে গিয়ে সেখানে ঝরে গিয়েছে প্রায় দুইশত প্রাণ। প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন যাঁরা, রোজ একটু একটু করে মরছেন তাঁরা। আবার হিংসার আগুনে ছায়া সমেত হারিয়ে গিয়েছেন কেউ কেউ। খুন করে দেহ লোপাট করে দেওয়া হয়েছে কি না, সেই চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাঁদের প্রিয়জনেদের। এত কিছুর মধ্যেও নির্বিকার শেখ হাসিনা সরকার। ইন্টারনেট, টেলিফোন পরিষেবা বন্ধ করে রেখে, বাংলাদেশকে গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে, কিছুই ঘটেনি গোছের ভাব করছে দুনিয়ার সামনে। কিন্তু সত্যকে কবেই বা লুকিয়ে রাখা গিয়েছে? তাই যত সময় যাচ্ছে হাসিনা সরকারের বর্বরতা, নৃশংসতাও বেরিয়ে আসছে একটু একটু করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হওয়ার সুবাদেই বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র হাসিনা। সেই উত্তরাধিকারই তাঁকে একটানা চতুর্থবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন করেছে। কিন্তু যত সময় এগিয়েছে বাবার সঙ্গে হাসিনার ফারাক স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য যখন সংরক্ষণ চালু করেছিলেন মুজিবুর, তাঁর সেই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ছিল সহযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সব হারানো মানুষগুলিকে সহায়-সম্বল জোগানোর প্রচেষ্টা। কিন্তু মেয়ে হাসিনার হাতে সেই সংরক্ষণ ব্যবস্থা হয়ে ওঠে ভোটযুদ্ধের হাতিয়ার, যা নির্বাচনের সময় আওয়ামি লিগের ঝুলি ভরায়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তনের প্রতি সমর্থন ছিল যাঁদের, তাঁদের বিশ্বাসঘাতক, অর্থাৎ ‘রাজাকার’ বলার চল শুরু হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘রাজাকার’দের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ঘটনা বাড়তে থাকলে, ক্ষমাশীল হওয়ার বার্তায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন মুজিবুর। কিন্তু হিংসার আগুনে যখন জ্বলছে গোটা দেশ, নাগরিকদের একাংশকে নিজেই ‘রাজাকার’ বলে দাগিয়ে দিলেন হাসিনা। সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনে যে বেনজির হিংসা চোখে পড়েছে, তাতে হাসিনা সরকারের মদত থাকার অভিযোগও এই প্রথম নয়। গত কয়েক বছরে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মারাত্মক সব অভিযোগ সামনে এসেছে, যার মধ্যে রয়েছে, গুম-খুন, মারধর, নির্বিচারে গ্রেফতারি, এমনকি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বিষপ্রয়োগও।

আরও পড়ুন: ১১ মাস জেলও খেটেছেন! তবু কেন বাংলাদেশের জনগণের মন রাখতে ব্যর্থ শেখ হাসিনা?

১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের Convention Against Torture (CAT)-এ অনুমোদন জানায় বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে দেশে হেফাজতে থাকাকালীন নির্যাতন এবং মৃত্যু (প্রতিরোধ)আইনও চালু হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা Amnesty International জানিয়েছে, গত এক দশকে হেফাজতে নির্যাতনের একটি মাত্র মামলাতেই অপরাধ প্রমাণ হয়েছে। কারণ হেফাজতে নির্যাতন চালিয়েও বাংলাদেশ পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনী অব্যাহতি পেয়ে যায়। এবছর ২ জুন পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হয় ৪০ বছর বয়সি আফরোজা বেগমের। মাদক রাখার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু আফরোজার ছেলে আরিফ হোসেন মুন্না জানিয়েছেন, নিজের চোখে দুই পুলিশ অফিসারকে মায়ের হাতে মাদক চালান করতে দেখেন তিনি। এর পর বেধড়ক মারধর করা হয় আফরোজাকে। অভয়নগর থানায় নিয়ে যাওয়া হলে পর দিন সকালে হেফাজতে মৃত্যু হয় তাঁর। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদে একটি রিপোর্ট জমা দেয় বাংলাদেশ সরকার, যাতে বলা হয়, ২০১৩ সালের হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু আইনে মাত্র ২৪টি মামলা দায়ের হয়েছে দেশে। যদিও বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্রে’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত সরকারি অফিসারদের শারীরিক নির্যাতনের দরুণ ১৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই একই সময়ে জেল হেফাজতে থাকাকালী ৯২৩টি মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসে। (Bangladesh Human Rights Violations)

আফরোজার ছেলে আরিফ জানান, বাড়িতে হানা দেওয়ার আগে, দীর্ঘদিন ধরেই তাঁদের হেনস্থা করছিল পুলিশ। মোটা টাকা দাবি করছিল। ওইদিন মাঝরাতে আচমকা দুই মাদক ব্যবসায়ীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে হাজির হন দুই পুলিশ অফিসার। বাবাকে না পেয়ে আফরোজার শরীরে তল্লাশি চালানো হয়। পাখায় চুল বেঁধে চড়-থাপ্পড় মারা হয় একটানা। আফরোজার কাছ থেকে ১ লক্ষ ৮৮ টাকা এবং ৩০টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে বলে দেখানো হয় পরে। এর পর গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় আফরোজাকে। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করলে গোটা পরিবারকে শেষ করে দেওয়া হবে বলে হুমকিও দেওয়া হয় আরিফদের। ২০১৩ সালের আইনের আওতায় এখনও পর্যন্ত একটি মামলাতেই অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। সেই মামলায় ইশতিয়াক হোসেন জনি এবং তাঁর ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকিকে ঢাকার পল্লবী থানায় নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালানো হয়। তাঁদের থেকে মোটা টাকা দাবি করে পুলিশ। এর পর সাব ইনস্পেক্টর জহিদুর রহমানের নির্দেশে লাঠিসোঁটা দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়, লাথি মারা হয় এলোপাথাড়ি। রকি আঘাত সারিয়ে বেঁচে ফিরলেও, জনি গ্রেফতার হওয়ার পরদিনই মারা যান। সেই নিয়ে আদালতে গেলে লাগাতার হুমকি, হেনস্থার শিকার হতে হয় গোটা পরিবারকে। টাকার লোভ দেখিয়ে মামলা তুলে নিতেও চাপ দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার ট্রায়াল কোর্ট জহিদুর এবং দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টরকে যাবজ্জীবনের সাজা শোনায়। জনির পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণও দিতে বলা হয় তিন জনকে। কিন্তু আজও সেই টাকা হাতে পায়নি জনির পরিবার।

Bangladesh Anti Quota Protests again raises questions of Sheikh Hasina being an authoritarian ruler following the paths of fascism

হেফাজতে জনির মৃত্যুতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া জহিদুরের বিরুদ্দে আগেও একই অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে মাহবুবুর রহমান সুজন নামের এক ব্যবসায়িকে খুনের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। অভিযোগ, লোকজন সঙ্গে নিয়ে আচমকা একদিন সুজনের বাড়িতে চড়ও হন জহিদুর। টাকা-পয়সা, মূল্যবান জিনিসপত্র লুঠ করে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিদারুণ অত্যাচার চালানো হয় সুজনের উপর। তাঁর পাঁচ বছরের ছেলে এবং স্ত্রীও আঘাত পান। এর পর ভুয়ো অস্ত্র মামলা সাজিয়ে গ্রেফতার করা হয় সুজনকে। মীরপুর মডেল থানার দু’টি লকআপে আটকে রাখা হয় সুজন, তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেকে। পুলিশি অত্যাচারের জেরে সুজনের মর্মভেদী চিৎকারও কানে যায় তাঁর স্ত্রী ও ছেলের। পরে সুজনের মৃতদেহ হাতে পান তাঁরা। সুজনের মা সেই নিয়ে থানায় ডায়েরি করেন। সেই ডায়েরি তুলে নিতেও হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। পরে নার্কোটিক মামলা দায়ের করে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রেফতার করা হয় সুজনের মাকে। ছ’মাস জেল খেটে জামিন পান সুজনের মা। সুজনের মৃত্যুর মামলা এখনও ঝুলছে আদালতে।

 

২০১৫ সালে কোনও রকমে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরেন প্রবাসী বাংলাদেশী মোশিউর রহমান। BBC-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন তিনি। লন্ডন নিবাসী মোশিউরের রাজনৈতিক সংযোগ রয়েছে। হাসিনার আওয়ামি লিগের মূল প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (BNP)-র। ২০১৫ সালে লন্ডন থেকে ঢাকা বিমান বিমানবন্দরে নামেন মোশিউর। অভিযোগ, বিমানবন্দর থেকেই আটক করা হয় তাঁকে। তার পর নিদারুণ অত্যাচার চলে। মাত্র কয়েক দিনের জন্য দেশে ফিরেছিলেন মোশিউর। কিন্তু অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘদিন চোখে পট্টি বেঁধে, দুই হাত পিছনে বেঁধে, ঝুলিয়ে রাখা হয় তাঁকে। দীর্ঘ ছ’মাস মোশিউরকে বন্দি করে রাখা হয় বলে অভিযোগ। নিদারুণ শারীরিক নির্যাতন চলে। খুন করে দেহ পুঁতে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। এর পর যাও বা মুক্তি পান মোশিউর, ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাড়া যাবে না বলে নিদান দেওয়া হয় তাঁকে। এর পর লন্ডনে পাকাপাকি আশ্রয় চেয়ে সফল হন মোশিউরের স্ত্রী। এখন লন্ডনেই একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তাঁরা। আজও খুঁড়িয়ে হাঁটেন মোশিউর। কোনও কাজকর্ম করতে পারেন না তিনি। ঘুমের মধ্যে এখনও ধরফড়িয়ে ওঠেন, কথায় জড়তা এসে গিয়েছে তাঁর।

 

বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রক যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু এমন একাধিক অভিযোগ রয়েছে। লন্ডন নিবাসী ৩০ বছর বয়সি মানবাধিকার আইনজীবী আবরার ইলিয়াস জানিয়েছেন, অপহরণের পর গত ১১ বছর ধরে বাবার খোঁজ পাননি তিনি। BBC-কে আবরার জানিয়েছেন, ২০১২ সালে ঢাকায় স্কুলের পাঠ শেষ করেন তিনি। বাবা ইলিয়াস ছিলেন খ্যাতনামা রাজনীতিক, BNP-র আহ্বায়ক। ওই বছর গাড়ির চালক এবং ইলিয়াস আচমকাই নিখোঁজ হয়ে যান। হাসিনার বিরোধিতা করাতেই ইলিয়াসকে অপহরণ করা হয় বলে দাবি পরিবারের। এর পর লন্ডনে পড়তে চলে যান আবরার। এখনও বাবার খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে তিনি। মা রোজ আকুল হয়ে কাঁদেন বলে জানিয়েছেন। যদিও এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকের। কিন্তু সরকারি নির্দেশে বিরোধীদের উপর এমন ধরপাকড় অহরহ চলে বলে অভিযোগ। আন্তর্জাতিক TIME ম্যাগাজিনকে BNP-র এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, জানুয়ারি মাসের নির্বাচের সময়ই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন বিরোধী পক্ষের লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাঁর দাবি, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত ভাবে হাসিনা সরকার প্রায় ২৫০০ জনকে খুন করেছে। BNP-র ২০০০ সদস্য এখনও জেলে বলে জানিয়েছেন তিনি। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গুম-খুনের অভিযোগও রয়েছে বিস্তর।

Asian Human Rights Commission-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ সালে হাসিনার আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২২ সালে জুন মাস পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে নিখোঁজ ৬১৯ জন। বিচার বহির্ভূত ভাবে খুন করা হয়েছে ২৬৫৮ জনকে। বাংলাদেশের আধা সামরিক বাহিনী Rapid Action Battalion (RAB)-র বিরুদ্ধেও মারাত্মক অভিযোগ সামনে এসেছে। ২০২০ সালে অবসরপ্রাপ্ত আর্মি মেজর সিনহা মহম্মদ রাশেদ খান খুন হন। সেই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন বাহরচড়ার প্রাক্তন চিফ ইনস্পেক্টর লিয়াকত আলি এবং টেকনাফ থানার প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক প্রদীপ কুমার। মামলার তদন্তভার ওঠে RAB-এর হাতে। সেই RAB-এর বিরুদ্ধেই মারাত্মক অভিযোগ তোলেন লিয়াকত এবং প্রদীপ। জানান, উলঙ্গ করে উল্টো করে তাঁদের ঝুলিয়ে রাখে RAB, সেই অবস্থায় বেধড়ক মারধর চলে। পুরুষাঙ্গে, কানে বিদ্যুতের শক দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ ওঠে। লিয়াকত জানান, তাঁদের বুকের লোম উপড়ে নেওয়া হয়। অচেতন করে রাখতে ইঞ্জেকশনেও দেওয়া হয়। পরে ফের উল্টো করে ঝুলিয়ে অত্যাচার চলে। পরে লিয়াকত এবং প্রদীপকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনায় আদালত। বিচার বহির্ভূত ভাবে খুন, গুম করে দেওয়ার একাধিক ঘটনার জেরে ২০২১ সালে আমেরিকা RAB-কে নিষিদ্ধ করে। এমন আরও একাদিক ঘটনা সামনে এসেছে। ২০২১ সালে চিটাগং জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট, জেলর, জেলের ফিজিশিয়ানের বিরুদ্ধে এক বন্দিকে বিদ্যুতের শক দিয়ে এবং ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার অভিযোগ ওঠে।

সম্প্রতি সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন, আন্দোলনের অন্যতম মুখ নাহিদ ইসলামকেও অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র নাহিদ। তিনি জানিয়েছেন, গত ১৯ জুলাই এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলেন। রাতে হঠাৎই সেখানে চড়াও হন কয়েক জন। নিজেদের পুলিশ অফিসার বলে পরিচয় দেন। ছাদ থেকে লাফিয়ে পালাতে উদ্যত হন নাহিদ। কিন্তু ধরা পড়ে যান। চোখ, হাত বেঁধে জোর করে একটি গাড়িতে তুলে অচেনা একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রীতিমতো জেরা করা হয় তাঁকে। কেন আন্দোলন করছেন, আসল উদ্দেশ্য কী, কেন আন্দোলন তুলে নেওয়া হচ্ছে না, করা এই আন্দোলনে মদত জোগাচ্ছে, লাগাতার প্রশ্ন করা হয়। উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে এর পর শুরু হয় অত্যাচার। লোহার রট দিয়ে পেটানো হয় তাঁকে। অচৈতন্য হয়ে পড়েন তিনি। দু’দিন পর জ্ঞান ফিরলে ঢাকার পূর্ব দিকের একটি রাস্তায় নিজেকে পান তিনি। ওই দু’দিনে তাঁর পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধবরা খোঁজাখুঁজিতে খামতি রাখেননি। পুলিশের দ্বারস্থও হন। কিন্তু কোনও সাহায্য মেলেনি। হাসপাতালে ভর্তি হলে নাহিদের শরীরে একাধিক জায়গায় কালশিটে দাগ, রক্ত জমে থাকতে দেখা যায়।

Bangladesh Anti Quota Protests again raises questions of Sheikh Hasina being an authoritarian ruler following the paths of fascism

শুক্রবার রাত পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, চিকিৎসাধীন নাহিদ এবং আরও দুই ছাত্রনেতাকে ফের হেফাজতে নিয়েছে সাদা পোশাকের পুলিশ। ধানমণ্ডি হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। পাঁচ দিন নিখোঁজ থাকার পর ফিরে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া আসিফ মহম্মদ, আবু বকর মজুমদার, রিফত রশিদ। চোখে ফেট্টি বেঁধে তাঁদেরও অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ। কিন্তু এই পাঁচদিনে তাঁদের সঙ্গে কী ঘটেছে, তা খোলসা করেননি তাঁরা। গত কয়েকদিনে প্রায় ২০০০ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এর মধ্যে BNP-র শীর্ষস্তরের নেতা-সহ পড়ুয়ারাও রয়েছেন। BNP জানিয়েছে, তাদের ১৫০০ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকার হাসপাতালগুলিতে রোগী ধরছে না কার্যত।

সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনে শুক্রবার রাত পর্যন্ত ২০৯ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। সরকারি বিধিনিষেধের সঠিক পরিসংখ্যা যদিও জানা যাচ্ছে না। তবে আসল হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। সেই আবহেই BNP-জামায়ত শিবিরের বিরুদ্ধে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ তুলেছেন হাসিনা। তাঁর বার্তা, “যারা এসবের সঙ্গে জড়িত, বাংলাদেশের আনাচে কানাচে যে যেখানে আছে, খুঁজে বের করুন এবং শাস্তির ব্যবস্থা করুন।” এ ব্যাপারে দেশবাসীর সাহায্যও চেয়েছেন তিনি। কিন্তু সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন ছাড়াও গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের আমলে বিরোধীদের কন্ঠস্বর রোধ থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী মহম্মদ ইউনুসকে চক্রান্ত করে জেলে পাঠানো, অপহরণ, নির্যাতন এবং খুনের যে ভূরি ভূরি অভিযোগ সামনে এসেছে, তাতে তাদের কড়া বার্তা দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জও। পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়, “বেআইনি ভাবে অসংখ্য মানুষের হত্যা, লোকজনকে গুম করে দেওয়া, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার এবং হাজার হাজার মানুষকে বন্দি করে রাখার ঘটনায় উদ্বিগ্ন আমরা।” সংবাদমাধ্যমকে খবর পরিবেশনে বাধা দেওয়া নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। অবিলম্বের ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়র্ক পরিষেবা ফেরানোর পাশাপাশি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মাপকাঠি মেনে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং পদক্ষেপ করতে বলেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ।

 ছাত্র আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ ধারণ করলেও, হাসিনা এতে আদৌ দমবেন কি না, সেই নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। কারণ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আওয়ামি লিগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র লিগের হাতেই হিংসাত্মক আকার ধারণ করে এবং তাতে পুলিশ ও সেনার মদত দেয় বলে অভিযোগ উঠছে। তার পরও হাসিনা যেভাবে BNP, জামায়ত, এমনকি দেশকে বদনাম করার জন্য আমেরিকার ঘাড়ে দোষ ঠেলছেন, নিজের দেশের নাগরিকদেরই ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন, দেখলেই গুলি করে মারার নির্দেশ দিচ্ছেন, তাতে তাঁর আচরণে স্বৈরাচারিতা এবং ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যই প্রতিফলিত হচ্ছে বলে মত বিরোধীদের।

আরও পড়ুন:হাসিনা সরকারকে না হটানো অবধি নড়বে না পড়ুয়ারা: শহিদুল আলম

অ্যাডল্ফ হিটলার এবং জোসেফ স্তালিনের সঙ্গেও তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে তাঁর। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে যখন হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসে, রীতিমতো আইন এনে ইহুদিদের স্বাধীনতা, অধিকার, সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়। অন্য নাগরিকদের থেকে ইহুদিদের আলাদা করতে গড়ে তোলা হয় আলাদা পাড়া। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তারা ১৩ লক্ষ ইহুদিকে খুন করে। বিরেোধী শিবিরের রাজনীতিকদের ধরে ধরে জেলে পোরা হয়। গ্যাস চেম্বারে দমবন্ধ করে মারা থেকে বন্দিদের অনাহারে ফেলে রাখা, শারীরিক অত্যাচার চলত। নিরীহ মানুষকে চাবুকপেটা করা, উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে মারধরের ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। একই ভাবে ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ সলের মধ্যে ১৫ লক্ষ সোভিয়েত-বিরোধী বলে চিহ্নিত করেন স্তালিন। নিরীহ নাগরিকদের ভুয়ো মামলায় ফাঁসিয়ে জেলবন্দি করা শুরু হয়। বিচার বহির্ভূত ভাবে সেখানে হত্যা চালানোর পাশাপাশি, শারীরিক নির্যাতনও চলানো হতো। দাসত্বে বাধ্য করা হতো বন্দিদের। উঁচু জায়গা থেকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলা, মুখে ফুটন্ত গরম জল ঢেলে দেওয়া, সেপটিক ট্যাঙ্কে ডুবিয়ে রেখে অত্যাচারের কথাও জানা যায়। সব মিলিয়ে গুলাগের বন্দি শিবিরে প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষ মারা যান বলে প্রচারিত হয়।

২০১৪ সালেই হাসিনাকে ‘নব্য হিটলার’ বলে কটাক্ষ করেন খালেদা জিয়া। তাঁর বক্তব্য ছিল, “হাসিনা হলেন নব্য হিটলার। হিটলারের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই দেশ চালাচ্ছেন উনি।” সংরক্ষণ বিরোদী আন্দোলনের পর এখনও পর্যন্ত হাসিনার যে প্রতিক্রিয়া, তাতে খালেদার সেই কটাক্ষকে সমর্থন করছেন অনেকেই। যে কারণে বৃহস্পতিবার মীরপুর মেট্রো স্টেশনের ক্ষয়ক্ষতি দেখে হাসিনা চোখের জল ফেললেও, তাকে ‘কুম্ভীরাশ্রু’ বলে কটাক্ষ করছেন অধিকাংশ নাগরিকই। মেট্রো স্টেশনে গিয়ে চোখের জল ফেললেও, একটি বারের জন্যও নিহত পড়ুয়াদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করার গরজ কেন দেখালেন না হাসিনা, উঠছে প্রশ্ন। বাংলাদেশি সমাজকর্মী তথা মানবাধিকার কর্মী রূপম রজ্জাক সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, ‘মেট্রো স্টেশনের ক্ষয়ক্ষতি দেখে কেঁদে ফেললেন। উনি। কিন্তু যে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ গেল, তাঁদে জন্য কোনও সমবেদনা নেই। বাংলাদেশের মানুষ এই নাটক দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। ওঁর মতো খুনির জন্য কারও মনে সহানুভূতি নেই’। কূটনীতিকদের মতে, সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম লিখতে পারতেন হাসিনা। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী শাসক হিসেবে।

More Articles