কোন 'ভুলের' শাস্তি? বাংলাদেশে মাঝরাতে কেন সাংবাদিককে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ?
Bangladesh Journalist Arrest: দিনমজুরের বক্তব্য বলে লেখা হয়, “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।”
"সিআইডি থেকে আসছি"। ভোররাতে সাংবাদিকের বাড়িতে ঢুকে এই পরিচয়ই দিয়েছিলেন তারা। সংখ্যায় প্রায় ১৪ থেকে ১৫ জন! জিজ্ঞাসাবাদের লক্ষ্যে সাংবাদিককে তুলে নিজেদের গাড়িতে করে নিয়েও চলে যান তারা। তারপর ৩০ ঘণ্টা কেটে যায়, সাংবাদিক কোথায়? খোঁজ মেলে না। ৩০ ঘণ্টা পার করে নাটকীয়ভাবে 'অপহৃত' সাংবাদিককে তোলা হয় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে! সেখানে তাঁর জামিনের আবেদনও খারিজ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান ঠিক কোথায় ছিলেন এই ৩০ ঘণ্টা? কেনই বা ভোররাতে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো বাড়ি থেকে?
সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের আমবাগান এলাকায়, শামসুজ্জামানের বাড়িতে ভোর চারটে নাগাদ ওই ১৪-১৫ ব্যক্তি নিজেদের সিআইডি সদস্য পরিচয় দিয়ে ঢুকে পড়েন। শামসুজ্জামানের শোয়ার ঘরে তল্লাশি চালিয়ে তাঁর ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, দু'টি মোবাইল ও একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক বাজেয়াপ্ত করেন, পরে শামসুজ্জামানকেও তুলে নিয়ে যান তাঁরা। ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে আশুলিয়া থানার পুলিশ আধিকারিকও উপস্থিত ছিলেন। অথচ পরে কেউই সাংবাদিকের সঙ্গে এই আচরণের প্রেক্ষিতে কিছুই স্বীকার করেননি। পরে জানা যায়, সৈয়দ মহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া নামের এক ব্যক্তি মঙ্গলবার রাত দুটো নাগাদ তেজগাঁও থানায় শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেছেন। কে এই সৈয়দ মহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া? কেনই বা মাঝরাতে মামলা দায়ের? সূত্রের খবর বলছে, সৈয়দ মহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া ঢাকার কল্যাণপুরের বাসিন্দা। তিনি যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক। আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন সৈয়দ মহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া।
আরও পড়ুন-দুইবোন মাত্র কথা বলতে পারেন আর, কীভাবে খাদের ধারে পৌঁছল বাংলাদেশের এই ভাষা?
গত ২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে প্রকাশের সময় দিনমজুর জাকির হোসেনের একটি 'বাইট' ব্যবহার করা হয়। দিনমজুরের বক্তব্য বলে লেখা হয়, “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।” কিন্তু সেখানে জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ভুল করে ছবি দেওয়া হয় একটি শিশুর। পোস্ট করে দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় অসংগতি নজরে এলে তা সরিয়ে ফেলা হয়। প্রতিবেদন সংশোধনও করা হয়। প্রতিবেদনে বক্তার নাম হিসেবে জাকিরের নামই ছিল। স্রেফ ছবিটি ভুল ছিল। এই প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন শামসুজ্জামান। এই ঘটনার জের ধরেই তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন গোলাম কিবরিয়া। শাসক দলের নেতাদের দাবি, ওই ছবিতে স্বাধীনতা দিবসের গর্বকেই যে শুধু খাটো করা হয়েছে তাই নয়, সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরির চক্রান্তও করা হয়েছে।
আরও পড়ুন- ‘বাংলাদেশি বাবু’ ও ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর! দেশের সবচেয়ে বড় রহস্য আজও অধরা
শামসুজ্জামানকে যখন তুলে আনা হয়, সে সময় স্থানীয় একজন সাংবাদিকও তাঁর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ওই সাংবাদিক জানিয়েছেন, সিআইডির সদস্য পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে শামসুজ্জামানের বাড়িতে এসে ঘরের মধ্যেই দাঁড় করিয়ে তাঁর ছবি তোলা হয়। তল্লাশির সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তবে শামসুজ্জামানের ক্ষেত্রেই থেমে নেই বিষয়টি। শোনা যাচ্ছে প্রথম আলো সংবাদপত্রের সম্পাদককেও গ্রেফতার করতে চলেছে পুলিশ! কঠোর ডিজিটাল আইনে সংবাদপত্রের বর্ষীয়ান সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে ওই একই দিন, গভীর রাতে!
রমনা থানায় ডিজিটাল আইনে যে মামলায় সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, তারই প্রধান আসামি করা হয়েছে সম্পাদক মতিউর রহমানকে। শামসুজ্জামান ও ‘অজ্ঞাতনামা আলোকচিত্রী’কে সহযোগী আসামি করা হয়েছে।
শামসুজ্জামানের বড় ভাই রবিউল ইসলাম পুলিশের কর্মকর্তা ছিলেন। ২০১৬ সালে গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গিরা হামলা চালালে যে পুলিশ সদস্যরা প্রথমে তাঁদের রুখতে গিয়েছিলেন, সেখানেই ছিলেন সে সময়ের গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম। তখন জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান রবিউল।
দুই ছেলের ছাত্রাবস্থাতেই স্বামীকে হারান শামসুজ্জামানের মা করিমন নেসা। দুই ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছেন তিনিই। রবিউলের মৃত্যুর পর শামসুজ্জামানই তাঁর সর্বস্ব। ছেলের এই গ্রেফতারিতে মায়ের কান্না থামানো যাচ্ছে না। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। প্রশ্ন তুলেছেন, "আমার ছেলে কি চুরি করেছে, নাকি ডাকাতি করেছে। আমার ছেলের কী অপরাধ? আমার ছেলেকে বললে ও নিজেই থানায় গিয়ে হাজির হতো। কেন এভাবে রাতে আমার ছেলেকে তুলে নেওয়া হলো?”
মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে বাংলাদেশের সরকার। বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেছেন, “এ ঘটনায় অবশ্যই মিথ্যা বলে রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে, স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে। সাংবাদিক ভুল করলে শাস্তি পাবেন না?” বিদেশ প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলছেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলন, ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মদান, এটা এতো ঠুনকো নয় যে যেকোনও কিছুর সঙ্গে এর তুলনা করা যাবে।” সাংবাদিকদের শাস্তি হিসেবে ভোররাতে তুলে নিয়ে যাওয়া, জামিন না মঞ্জুর! তাহলে নির্বাচনের আগে ভয়ের রাজনীতিতেই আস্থা রাখছেন শেখ হাসিনাও? উত্তর জানে বাংলাদেশের আমজনতা।