বেড়েই চলেছে মৃত্যুমিছিল! কমপ্লিট শাটডাউনেও বাংলাদেশে হিংসার বলি অন্তত ১৫
Bangladesh Quota Protest Deathtoll: মঙ্গলবার সংরক্ষণবিরোধী পড়ুয়াদের শান্তিপূর্ণ জমায়েতে গুলি চালায় পুলিশ ও আধাসেনা। সেদিন মোট ৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছিল। বৃহস্পতিবারের বাংলাদেশ সাক্ষী রইল আরও মৃত্যুর।
বাংলাদেশে বাড়ছে সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনের ঝাঁঝ। প্রায় এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন চলছে বাংলাদেশে। রাজধানী ঢাকা-সহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়েছে বিক্ষোভের আগুন। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। মঙ্গলবার সংরক্ষণবিরোধী পড়ুয়াদের শান্তিপূর্ণ জমায়েতে গুলি চালায় পুলিশ ও আধাসেনা। সেদিন মোট ৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছিল। বৃহস্পতিবারের বাংলাদেশ সাক্ষী রইল আরও মৃত্যুর। কমপ্লিট শাটডাউনের মধ্যেই দফায় দফায় সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে উঠল বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা। বৃহস্পতিবার এক সাংবাদিক-সহ নতুন করে অন্তত ১৫ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে।
মঙ্গলবারের ঘটনার প্রতিবাদে দেশ জুড়ে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচীর ডাক দিয়েছিল বিক্ষোভকারীরা। যা কার্যত বৃহস্পতিবার স্তব্ধ করে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। বন্ধ ছিল যান চলাচল। রাস্তাঘাটে পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়া অন্য কোনও যানবাহন দেখা যায়নি রাস্তায়। জরুরি পরিষেবা বাদ দিয়ে বন্ধ ছিল বাকি সমস্ত বেসরকারি অফিস, দোকান বাজার থেকে সব কিছুই। তার সঙ্গেই বিভিন্ন জায়গায় চলছে ধর্না, অবস্থান বিক্ষোভ এবং অবরোধ। ইতিমধ্যেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাংলাদেশের সমস্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বুধবার সন্ধেয় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
আরও পড়ুন: হাসিনা সরকারকে না হটানো অবধি নড়বে না পড়ুয়ারা: শহিদুল আলম
সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ এবং শাসকদল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের সংঘর্ষে মঙ্গলবার ছ’জনের মৃত্যু হয়েছিল বাংলাদেশের তিন শহর— ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রংপুরে। নিহতদের মধ্যে একজন, ওয়াসিম আকরাম চট্টগ্রাম কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায়। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। নিহত বাকি দুজনের মধ্যে ফয়সাল আহমদ শান্ত (২০) ওমরগণি এমইএস কলেজের ছাত্র। আর ফারুক (৩২) রট আয়রনের মিস্ত্রি। বুধবার রাত থেকেই উত্তপ্ত হতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন এলাকা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বুধবার রাতেও সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানোর অভিযোগ উঠল। সেই ঘটনায় অন্তত ৬ জনের জখম হওয়ার খবর মেলে। বৃহস্পতিবার 'সর্বাত্মক অবরোধ' সত্ত্বেও হিংসায় রাশ টানা যায়নি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর উত্তরা এলাকায় অন্তত ৬ জন নিহত হন বলে খবর। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ সাব্বির আহমেদ জানান, সংঘর্ষে নিহত এক ছাত্রকে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তাঁদের হাসপাতালে আনা হয়। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তরফে জানা যায়, নিহত ওই ছাত্র নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তাঁদের একজনকে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান এবং আরেকজন উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে মারা যান। বাড্ডায় নিহত হয়েছেন একজন। দুই জায়গাতেই আহত হয়েছেন কয়েকশো আন্দোলনকারী। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উত্তরায় নিহত দু'জনই আন্দোলনকারী। আর বাড্ডায় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত ব্যক্তি পথচারী ছিলেন। তিনি পেশায় বাসচালক বলে জানা গিয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে মেরুল বাড্ডা এলাকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা সড়ক অবরোধ করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে পাশের ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা তাতে যোগ দেন। দু'পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
বৃহস্পতিবারের অশান্তিতে সব মিলিয়ে মোট ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৯ জনেরই মৃত্যু হয়েছে পুলিশ ও ছাত্রলীগ–যুবলীগ নেতা–কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে। উত্তরার বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে রয়েছে তার মধ্যে চার জনের মরদেহ। হাসপাতালের পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, চারজনের মধ্যে দু'জন শিক্ষার্থী। অন্য দুজনের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। ধানমণ্ডিতে সংঘর্ষে ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষার্থী, রামপুরায় এক পথচারী, যাত্রাবাড়ীতে এক রিকশাচালক, সাভারে এক শিক্ষার্থী ও মাদারীপুরে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকাতেও সকাল থেকে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলেছে। সন্ধে বেলা সেখান থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় এক রিকশাচালককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন এক ব্যক্তি। পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত রিকশাচালকের নাম–পরিচয় জানা যায়নি। তাঁর বয়স তিরিশের কাছাকাছি।
এখানেই শেষ নয়। সকালে মেরুল বাড্ডা এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে তা পাশের রামপুরা ও মালিবাগ এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। রামপুরায় বিটিভি ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধরা। সংঘর্ষ চলছে শনির আখড়া এলাকাতেও। এদিকে সকাল থেকে রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র নিহত হয়েছেন বলে খবর। দক্ষিণ-পূর্বে নারায়ণগঞ্জে দু'জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে ১৫ বছরের কিশোর তাহমিদ তামিম ও ২২ বছরের এম ইমন মিয়া। নরসিংদীতে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় মৃত্যু হয় তাঁদের। সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে আনা হলে সেখানেই মারা যায় তাঁরা। চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দার হাট এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের পড়ুয়াদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন দু'জন। তাঁদের একজন পটিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র মোহাম্মদ ইমাদ বলে জানা গিয়েছে। অন্য জনের বয়স বছর কুড়ির কাছাকাছি। তাঁর পরিচয় জানা যায়নি।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সন্ধেয় মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসে আরও চারটি নিথর দেহ। তাঁদের মধ্যে একজন সাংবাদিক রয়েছে বলেও খবর। হাসান মেহেদী নামে ওই সাংবাদিক ঢাকা টাইমসের কর্মী বলে জানা গিয়েছে। যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকা থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনা হয়। বাকিদের মধ্যে একজনের নাম ওয়াসিম বলে শনাক্ত করা হয়েছে। বছর তিরিশের ওই যুবককে আনা হয় যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ত এলাকা থেকে। তাঁর মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নিহত নাজমুলকেও যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে আনা হয়েছে। আনুমানিক ২০ থেকে ২২ বছর বয়সী নাজমুলের শরীরে কোপের আঘাত রয়েছে। চতুর্থ দেহটি মোহাম্মদ নামে বছর কুড়ির যুবকের। প্রাথমিক ভাবে অনুমান ছররা গুলি লেগেই মৃত্যু হয় তাঁর। নিহত নাজমুল ব্যবসায়ী বলে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন:বাংলাদেশ শাটডাউন, হাসিনার পুলিশের নিশানায় সেই বিএনপি
যত দূর জানা যাচ্ছে, চলতি বছরের কোটা সংস্কার আন্দোলনের বলি এখনও পর্যন্ত ২১ জন। হাসপাতালে জখম হয়ে ভর্তি রয়েছেন অসংখ্য আন্দোলনকারী। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের অবস্থা সঙ্কটজনক বলেই খবর। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা করা যাচ্ছে। বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে মৃতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যদিও পড়ুয়াদের দাবি মেটানোর ব্যাপারে আদালতের উপরেই আস্থা রাখার কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। এ দিকে যেভাবে আন্দোলনের উত্তাপ বাড়ছে, তাতে আরও কত তরুণ প্রাণ যে সেই আগুনে আত্মাহূতি দেবে, তা বলা কঠিন। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এই মৃত্যুমিছিল, তা ভেবে আতঙ্কিত ওয়াকিবহাল মহল।