জলের গান ব্যান্ডের রাহুল আনন্দের বাড়ি ভাংচুর! কেন বাংলাদেশে আক্রান্ত শিল্পী?

Rahul Ananda Joler Gaan: জলের গানের রাহুল আনন্দের বাড়িতে সোমবার হামলা চালিয়ে, তাঁর বাড়িতে থাকা সহস্রাধিক বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করে দেয় দুষ্কৃতীরা।

স্ত্রী উর্মিলা শুক্লা ও ১৩ বছরের পুত্রকে নিয়ে প্রায় এক কাপড়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে রাহুল আনন্দকে। কে রাহুল আনন্দ? বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্যান্ড জলের গানের মূল গায়ক। যার হাতে কথা বলে অজস্র বাদ্যযন্ত্র। যার গানে মোহিত হয়ে পাখির মতোই উড়ে বেড়ায় দুই বাংলার প্রাণ, সেই রাহুল আনন্দের বাড়ি প্রায় ধ্বংস করে দিল দুষ্কৃতীরা। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে অবাধ লুঠতরাজ চলেছে তারই জের ধরে রাহুল আনন্দের ঘর তছনছ হলো! শিল্পীর মর্যাদা, সুরের মর্যাদা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বাংলাদেশে।

জলের গানের দলনেতা রাহুল আনন্দের বাড়িতে সোমবার ৫ অগাস্ট হামলা চালিয়ে, তাঁর বাড়িতে থাকা সহস্রাধিক বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করে দেয় দুষ্কৃতীরা। শিল্পী রাহুল আনন্দের এই বসতবাড়ি থেকেই জলের গান ব্যান্ডের অনেক গান লেখা হয়েছে, সুর হয়েছে। এমনকী গানের রেকর্ডিংও হতো এখানেই। দলের রিহার্সাল হোক বা রেকর্ডিং, মিক্সিং, এডিটিং, রাহুল আনন্দের এই বাড়িতেই হতো। সমস্তটা নস্যাৎ করে দিল দুর্বৃত্তরা। রাহুল আনন্দ এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছিলেন। নিজের দলের সদস্যদের নিয়ে রাজধানীর রবীন্দ্রসরোবরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তবু, হাসিনা দেশছাড়া মাত্রই গুঁড়িয়ে গেল তাঁর গান, তাঁর ভিটে। রাহুল আনন্দের বাড়িতে এমন হামলার নিন্দায় সরব এপার বাংলার মানুষও। হামলার বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে জলের গান। বিবৃতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে ওই বাড়িতে রেকর্ড করা শেষ গান।

আরও পড়ুন- এই মুহূর্তে কেমন আছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা?

ভক্তরা জানেন, অনুরাগীরা জানেন, রাহুল আনন্দের এই বাড়িতে সকলের অবাধ যাতায়াত ছিল। নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়ায় জলের গান লিখেছে, "জলের গানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি শুধু রাহুল আনন্দের বসতবাড়ি ছিল না; ছিল পুরো দলটির স্বপ্নধাম, আনন্দপুর। যেখানে তৈরি হয়েছে কত গান, কত সু্র, আর দাদার ভাবনাপ্রসূত শত শত বাদ্যযন্ত্র। শুধু তা-ই নয়। জলের গানের অফিশিয়াল স্টুডিও হিসেবেও ব্যবহৃত হতো বাড়িটি। দলের সকলের দলগত সংগীতচর্চা থেকে শুরু করে, সকল স্টুডিও ওয়ার্ক-রেকর্ডিং, মিক্সিং, এডিটিং এখানেই হতো।"

 

বিবৃতিতে ব্যান্ডটি লিখেছে, "যাঁরা নিয়মিত এই বাড়িতে যাতায়াত করতেন, তাঁরা জানেন যে রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার বাড়িটির সাদা গেটটি সব সময় খোলাই থাকত। তাতে তালা দেওয়া হতো না। যে কেউ, যেকোনো দরকারে যেন দাদার কাছে পৌঁছোতে পারে, সেই ভাবনায়। আর যাঁরাই দিনের যেকোনো প্রান্তে এই বাড়িতে এসেছেন, সকলেই একটি চিত্রের সাথে খুব পরিচিত, তা হলো রাহুল আনন্দ মাটিতে বসে একটি সিরিশ কাগজ হাতে নিয়ে তাঁর নতুন বাদ্যযন্ত্রের কাঠ ঘষছেন।"

আরও পড়ুন- যাঁদের জন্য লেখিকাকে নির্বাসন, তাঁদের হাতেই দেশছাড়া হাসিনা! কী বলছেন তসলিমা?

গত বছর রাহুল আনন্দের বাড়িতে এসেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। গানে, গল্পে, আড্ডায় রাহুল আনন্দের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ সময়ও কাটান। রাহুল আনন্দের সাজানো বাড়িটি সত্যিই আনন্দধাম। অজস্র বাদ্যযন্ত্র সেখানে, সারাক্ষণই সুরের মেজাজ। অথচ নতুন করে 'স্বাধীন' হওয়া বাংলাদেশে সেই সমস্ত সুর ভূলুণ্ঠিত। জলের গান জানাচ্ছে, "আমাদের দেশিয় কাঠে তৈরি, আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্র। শুধুই কি আমাদের? এই দলের? জলের গানের? না! এই প্রয়াস সকল নবীন মিউজিশিয়ানদের জন্য, যারা বিশ্বাস করবে, আমরাও আমাদের বাপ-দাদার মতো নিজেদের বাদ্যযন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারি! এই প্রয়াস সেই স্বকীয়তার; যার বলে এই দেশের মানুষ গর্বের সাথে বলতে পারে, এই আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্রে বেজে ওঠা অনন্য শব্দতরঙ্গ, যা কি না পুরো পৃথিবীর বুকে কেবল এই বাংলাদেশের মাটিতেই ঝনঝন করে বাজে, সুর তোলে, স্বপ্ন দেখায়। যেই স্বপ্নের ঝিলিক সুদূর ফ্রান্স থেকে আরেকজন মিউজিশিয়ানকে আমাদের দেশে টেনে আনে। পুরো পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষের চোখের আলো পড়ে আমাদের এই দেশে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের এই বাড়িটিতে। তবে কি এই ঠিকানায় আবাস হওয়াটাই কিছু মানুষের এত ক্ষোভের কারণ? এত রাগের বহিঃপ্রকাশ? যারা ইতিমধ্যে সেখানে গিয়েছেন কিংবা ফেসবুকে পোস্ট দেখেছেন, তারা সকলেই খবরটি জানেন। হ্যাঁ!, রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার এবং আমাদের সকলের প্রিয় জলের গানের এই বাড়িটি আর নেই। সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং আশীর্বাদে বাড়ির সকল সদস্য নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন এবং এখন নিরাপদে আছেন। কিন্তু রাহুলদা এবং আমাদের দলের সকল বাদ্যযন্ত্র, গানের নথিপত্র এবং অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ছাড়াও দাদার পরিবারের খাট-পালং, আলনা আর যাবতীয় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! সব!”

রাতারাতি সমস্ত ছাই করে দেওয়া মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্য উঠল কি? জলে গানও জানাচ্ছে, এই বাদ্যযন্ত্র, গান বা সাজানো সংসার আবার গড়ে উঠবেই, হয়তো দীর্ঘ সময় লাগবে। তাও, সেসব ফিরবেই আবার কিন্তু যে ক্রোধ আর প্রতিহিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশে তা নিভবে কি? বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিসর ফিরবে কি? স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। রাহুল আনন্দের প্রায় ৩০০০ বাদ্যযন্ত্র ভেঙে গুঁড়িয়ে, পুড়িয়ে দিলেও সঙ্গীত থামবে না। কিন্তু এই ঘা মনে করাবে, যে দেশে শিল্পকে ধ্বংস করতে চাওয়া হচ্ছে, সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কাই সমীচীন।

More Articles