‘বাসন্তী’ই আসলে বাংলার আদি দুর্গা, জানেন কোন ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই পুজোর নেপথ্যে?
Basanti Puja : কবে থেকে শুরু হয়েছিল বাঙালির ‘আসল’ দুর্গার আরাধনা? জানেন, কী এর ইতিহাস?
একই রকম দাকের বাদ্যি, একই রকম আবহ। ষষ্ঠীতে আবাহন, তারপর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, অতঃপর দশমীতে দেবীর বিসর্জন। তবে সময়টা মোটেই আশ্বিনের মাঝামাঝি নয়, ভরা চৈত্র মাসেই নতুন রূপে সেজে ওঠেন বাংলার দুর্গা। সহজ করতে বলতে গেলে আদি দুর্গা। বসন্তের দেবী বলেই যাঁর নাম বাসন্তী। আজকের দিনে বাঙালির যে দুর্গাপুজো ঘিরে এত উত্তেজনা তার কাহিনী অবশ্য কমবেশি সকলেই জানেন। অকাল বোধন, নামেই তো পরিচয়। পুরাণ অনুযায়ী, শ্রীরামচন্দ্র রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার আগে দেবী দুর্গার যে আরাধনা করেছিলেন, তার সময়কাল ছিল আশ্বিন মাস। অর্থাৎ আদি দুর্গাপুজোর সময়কাল ধরে বিবেচনা করলে অকাল তো বটেই। তার পর থেকে যদিও সেই অকাল বোধনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে বাঙালি। খানিকটা হলেও আড়ালে চলে যায় বাঙালির আদি দুর্গার কথন।
বছরে চারটি নবরাত্রি আসলেও তার মধ্যে দুটো নবরাত্রিই পালন করা হয় গোটা দেশে। যার মধ্যে একটি হল শরৎ নবরাত্রি অর্থাৎ এখনকার দুর্গাপুজোর সময়, আর অন্যটি হল বসন্ত নবরাত্রি অর্থাৎ আদি দুর্গাপুজোর সময় কালে। এখন এই বসন্ত নবরাত্রি মেনে পালন করা হয় বাসন্তী পুজো। শারদীয় দুর্গাপূজার মত এই বাসন্তী পুজোতেও আরাধনা করা হয় দেবী দুর্গার। যদিও সময়ের সঙ্গে যতোই জনপ্রিয় হয়েছে শরতের নবরাত্রি ততই যেন ফিকে হয়ে গিয়েছে এই বসন্তের নবরাত্রি তথা বাসন্তী পুজো পালনের রেওয়াজ। একটা সময় বাংলার এই আদি দুর্গা পুজো উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটিও বহাল ছিল, তবে সে সবকিছুই এখন অতীত। এই বাসন্তী পূজা এখন কেবল কিছু জমিদার বাড়ি তথা বনেদি বাড়িতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
আরও পড়ুন - হিন্দু দেবতার দেখভাল করেন মুসলিমরা, ধর্মের ভেদাভেদ মিলেমিশে যায় বাংলার এই শিব মন্দিরে
আসুন জেনে নেওয়া যাক পুরাণের কিছু কথা। শরতের দুর্গাপুজো যেমন শ্রীরামচন্দ্রের হাতে শুরু তেমনই কি বসন্তের এই আদি দুর্গাকে ঘিরেও কিছু রহস্য রয়েছে?
কথিত আছে যে, সমাধি নামক বৈশ্যের সঙ্গে মিলে চন্দ্র বংশীয় রাজা সুরথ বসন্ত কালে চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে ঋষি মেধসের আশ্রমে প্রথমবার দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন। বসন্তকালে দেবী রূপের বন্দনা করা হয়েছিল বলেই নাম হয়েছিল বাসন্তী। সেই নামেই বাংলায় ছড়িয়ে পড়েন মহামায়া। এমনকী দেবী দুর্গার প্রথম পুজারী হিসাবেও চন্ডীতে রাজা সুরথের কাহিনীর উল্লেখ রয়েছে।
হিন্দু পুরাণ ঘেঁটে জানা যায়, এই রাজা সুরথ ছিলেন প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের একজন সুশাসক। যোদ্ধা হিসেবেও যথেষ্ট খ্যাতি ছিল তাঁর। শোনা যায়, তিনি নাকি কখনোই কোনও যুদ্ধে পরাজিত হননি, এতটাই ক্ষমতার জোর ছিল তাঁর। কিন্তু এই সময়েরও বদল ঘটে, একসময় প্রতিবেশী রাজ্য যবন সুরথের রাজ্য আক্রমণ করে। আচমকা এই আক্রমণের জন্য কোনও ভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না রাজা সুরথ, তাছাড়া এই সময় সুযোগ বুঝে তাঁর নিজের সভাসদরাও বেইমানি শুরু করে। ধনসম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায় তারা। নিজের কাছের মানুষদের থেকে পাওয়া এরূপ প্রতারণামূলক আচরণে রাজা স্তম্ভিত হয়ে যান রাজা সুরথ। এরপরই তিনি রাজ্যপাট হারিয়ে বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে একসময় মেধস আশ্রমে এসে উপস্থিত হন।
আরও পড়ুন - শিব নয়, পায়ের নীচে থাকে অসুর, সিংহ! চমকে দেবে ৩০০ বছরের পুরনো বাংলার এই কালীর রহস্য
অন্যদিকে একই রকম প্রতারণার শিকার হন বনিক রাজ্য সমাধিও। তবুও তাঁরা দুজনে শুভ চিন্তায় করেন, আর এই কথা শুনে ঋষি মেধস তাঁদের জানান সবই মহামায়ার ইচ্ছে, আর তাঁর মুখেই প্রথম মহামায়ার বর্ণনা শোনেন তাঁরা। এরপর তপস্যা শুরু করেন তাঁরা। রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য পশ্চিমবঙ্গের গড় জঙ্গলে মাটি দিয়ে দেবী দূর্গার মূর্তি তৈরি করে প্রথম পূজা করেন। সেটিও ছিল এই বসন্তকাল। শোনা যায়, এই পুজোর পর মহামায়ার বর পেয়ে সুরথ রাজা নিজের সমস্ত হারানো সম্পত্তি ফেরত পান এবং রাজ্যে ফিরে আসেন। আর এই কাহিনীই অনুপ্রাণিত করেছিল স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্রকেও। তাই তিনি শরৎকালেই দেবীর অকাল বোধন করেন।
প্রাচীন রাজাদের মধ্যে একটা বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, মহামায়ার আশীর্বাদ না পেলে যুদ্ধে জয় সুনিশ্চিত নয়। ফলে, সেই থেকেই রাজবাড়ী এবং বেশ কিছু জমিদার বাড়িতে বসন্তকালে বাসন্তী তথা অন্নপূর্ণা পূজো করার রেওয়াজ শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই রেওয়াজ প্রজন্মের হাত ঘুরে অনেকটা ফিকে হয়েছে ঠিকই, তবে একেবারেই হারিয়ে যায়নি। আজও এই বাংলার বহু পুরনো বাড়িতে পূজিতা হন দেবী বাসন্তী অর্থাৎ বাংলার আদি দুর্গা। আগামীকাল এই বছরের বাসন্তী পুজোর অষ্টমী, ইতিমধ্যেই তার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। গত কাল নিয়ম মেনেই শুরু হয়েছে ষষ্ঠীর আরাধনা। টানা চারদিনের পুজো শেষ হবে ৩১ মার্চ শুক্রবার। ওই দিনই এবছরের বাসন্তী পুজোর বিজয়া।