অলিম্পিকে বুক কাঁপানো দৌড় মহাযুদ্ধের 'খলনায়ক'

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: দুই কালো প্যান্থারের দৌড়বাজি শেষ হয়ে গিয়েছে।
স্টপ ওয়াচে দিকে তাকিয়ে কাঁপছিল গোটা স্টেডিয়াম। সেখানে স্থির হয়ে রয়েছে ৯.৭৯ সেকেন্ড! জাতীয় পতাকা নিয়ে আবেগে ভাসছিলেন কানাডার নাগরিকরা। বিশ্বের দ্রুততম মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন বেন জনসন।

দৌড় যেন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে। একইসঙ্গে অনৈতিকতার উদাহরণ ঘাড়ে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন বেন জনসন। তিনি এমন এক দৌড়বিদ যাঁর জন্য বিশ্বজোড়া সম্মান বরাদ্দ ছিল মাত্র একটা দিন। এই ২৪টি ঘণ্টার জন্য তিনিই বিশ্বসেরা অতিমানব।

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল বেন জনসনের বধ্যভূমি। এখানেই তাঁর দুরন্ত গতি সর্বচ্চো পর্যায়ে পৌঁছেও ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে আবিরত। এখনও অলিম্পিক আসে, ১৯৮৮ সালের  সেই মহাদৌড়ের কথা আলোচিত হয়। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে কানাডার জনসন আমেরিকান কার্ল লিউইসের দৌড় যুদ্ধ-বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের স্মরণীয় তথা ডোপিং সালতামির একটি মাইল ফলক।

অলিম্পিক কেঁপেছিল জনসনের ডোপিং কেলেঙ্কারির ঘটনায়। ডোপিং এখন অতি পরিচিত। অলিম্পিক ইতিহাসে বেশ কয়েকবার ডোপ কেলেঙ্কারির কথা এসেছে। কিন্তু ১৯৮৮ সালের বেন জনসন কার্ল লিউইস দৌড়টাই বিশ্ববাসীর কাছে ডোপ কেলেঙ্কারির থার্মোমিটার হয়ে গেল।

১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখটা না তো জনসন কোনোদিন ভুলবেন, না ভুলবেন লিউইস। সেই দৌড়ের বাকি প্রতিযোগীরাও কোনোদিন ভুলবেন না। তাঁরাও সাক্ষী। তাঁরাও দৌড়েছিলেন। সবাইকে পিছনে ফেলে দুই কালো প্যান্থার তখন একে অপরকে তাড়া করছিল। দমবন্ধ করা ৯.৭৯ সেকেন্ড পর বিশ্বজুড়ে আলোড়ন ছড়ায়-জনসন তখন ইতিহাসের অংশীদার হয়ে গিয়েছেন।

জনসনের জয়ে সিওল থেকে অটোয়া বিশ্বের দুই প্রান্তের দুই মহানগর ছাড়িয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট দেশ জামাইকা জুড়েও হিল্লোল তুলেছে। হোক জনসন কানাডার নাগরিক, জন্মভূমি জামাইকা তো তার সন্তানের জন্য গর্বিত হবেই। সে দেশের কিংসটন টাউনের রাজপথে তখন চিৎকার জনসন জনসন

অলিম্পিকের নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক প্রতিযোগিতার শেষে প্রতি প্রতিযোগীর ডোপ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। কেউ মাদক নিয়ে অতিরিক্ত ক্ষমতার প্রয়োগ করেছে কিনা তা জানা হয়। বিখ্যাত দৌড় শেষে ডোপ টেস্ট হলো। নির্দিষ্ট পরিমান মূত্র জমা দিলেন সবাই। আগেই সোনার পদক তালিকায় ঢুকে গিয়েছে বেন জনসনের নাম আর রুপোর পদক তালিকায় লিউইস।

উন্মাদনার দিন কাটল। অভিমানব অভিধায় বেন জনসন তখন বিশ্বজোড়া আলোচিত নাম। জনসন-লিউইস দৌড় যুদ্ধের বহু আলোচিত পরের অধ্যায়টি ভয়ানক। মনোবিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার বিষয়। কারণ এই পর্বে রয়েছে তীব্র মানসিক যন্ত্রনা নিয়ে নিজেকে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের অভিশাপ ধিক্কার থেকে লুকিয়ে রাখা কতটা কঠিন তারই পরীক্ষা। এমন ঘটনা তো মনোবিজ্ঞানীরা লুফে নেবেনই।

১৯৮৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করল ভয়ঙ্কর বাক্য- ডোপ টেস্টে পাশ করতে পারেননি বেন জনসন। তাঁর সোনার পদক বাতিল করা হচ্ছে। তিনি অলিম্পিক থেকে বিতাড়িত হলেন।

বিশ্ব হতবাক। স্টপ ওয়াচের ৯.৭৯ সেকেন্ড যেন লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। কানাডা জুড়ে প্রবল বিক্ষোভ। অলিম্পিকের বুকে তখন হাতুড়ির মতো আঘাত করেছে Stanozolol ড্রাগ।  জনসন এই মাদক সেবন করেছিলেন দৌড়ের আগে। অলিম্পিক কমিটি তাদের নিষিদ্ধ তালিকায় থাকা Stanozolol এর অস্তিত্ব জনসনের মূত্র নমুনায় পাওয়ার পরেই মহা দৌড়ের বিজয়ী হিসেবে ঘোষিত হলেন কার্ল লিউইস।

জনসন লিউইস এই দৌড় যুদ্ধ বিশ্বকে উপহার দিল ডোপ কেলেঙ্কারি। এর পরবর্তী সাড়া জাগানো ডোপ কেলেঙ্কারিতে মাঠ ছাড়েন কিংবদন্তি ফুটবলার মারাদোনা। তিনি পরে ফিরে এসেছিলেন মাঠে। তবে জনসন আর ফিরতে পারেননি। বিশ্ব শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াঙ্গন থেকে মাথা নিচু করেই চলে গিয়েছিলেন। শুরু হয় তাঁর নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই, নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা। তীব্র মানসিক যন্ত্রনার সেইসব দিন ঘণ্টা মিনিট সেকেন্ড তিনি দৌড়েছেন নিজের সঙ্গে।

সময় সবকিছু থিতিয়ে দেয়। জনসনের জীবন থেকে সরেছে নিজেকে লুকিয়ে রাখার পর্ব। কিন্তু তাড়া করে চলেছে সেই সিওল অলিম্পিকের ৯.৭৯ সেকেন্ড। এর থেকে মুক্তি নেই তা জানেন জনসন। 

তাৎক্ষণিক জয়ী নায়ক হয়েও গৌরব অধরা হয়ে গেছে। আবার পরাজিত নায়ক হতেও পারেননি। খলনায়কের তকমাধারী বেন জনসনের ডোপ কেলেঙ্কারি বিতর্কিত। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তার প্রমাণ তেমন পোক্ত নয়।

গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ- এবং মানে বিশ্বশ্রেষ্ঠ রঙ্গমঞ্চ; আধুনিক অলিম্পিকের জন্মদাতা পিয়ের দ্য কুবেরত্যাঁ এমনটা বলেছিলেন ১৮৯৪ সালে। তিনি ঠিকই বলেছিলেন।

 

সৌজন্য:

  • BEN JOHNSON'S `MYSTERY STEROID' WAS STANOZOLOL: Desert News
  • Olympics history: Biggest cheating scandals in the Olympics : Sportstar

More Articles