বরযাত্রীর বাসে 'দো ঘুঁট মুঝে ভি...', মাধ্যাকর্ষণ ভুলে সোজা কাকুর টাকে গিয়ে নামল মাসি!
Wedding Season: আমাদের কীর্তি দেখছে গোটা মামাবাড়ি। হঠাৎ আমার মনে পড়ল, ইউরেকা বলার সময় আর্কিমিডিস ল্যাংটো ছিলেন।
বাড়িতে সম্প্রতি বিয়ে গেল। আর নিজের বাড়ির বিয়ে মানে তো বোঝেনই! সেখানে সেলিব্রিটি সেজে বিয়ে আর বউভাতে গিয়ে দেঁতো হাসি হেসে আর সেলফি তুলে কাটিয়ে দেওয়া যায় না। বাড়ির বিয়ে অনেকটা দেবীপক্ষের মতো, মহালয়া দিয়ে যার শুরু, বিসর্জনের ডেট ক্লাবের হাতে। আর বিয়ে মানে তো শুধু বিয়ে নয়,আজকের ব্যাস্ত জীবনে এটা একটা পুনর্মিলন উৎসবও বটে। কতগুলো মুখ, যাদের ছাড়া গরমের ছুটি অসম্পূর্ণ মনে হতো, যে ভাইবোন শিলিগুড়িতে থাকে বলে আবার কবে দেখা হবে ভেবে আঁকড়ে ধরে কাঁদতাম, তাদের সঙ্গে আর দেখা হয় কই? আর দেখা হয় না বলে খুব যে বেদনা বোধ করি তাও তো নয়। কারও শহর বদলেছে, কারও মন। কিন্তু এই উৎসবের সূত্রেই যখন আবার একসঙ্গে বসি, চেনা দুষ্টুমি ঝিলিক মেরে যায় অচেনা বাইফোকালে। মা, মাসিদের লুকিয়ে কখন ছাদে জলের গেলাস আর বোতল নিয়ে উঠতে হবে তা বুঝতে এখনও আমাদের কথা খরচ করতে হয় না, চোখের ইশারাই যথেষ্ট। চেনা, বোকা চুটকিতে গমগম করে মামাবাড়ির রাতের ছাদ আর আমরা ভুলেই যাই আমরা এক একজন এখন এক একটা দায়িত্ববান দামড়া। মনে পড়ে, দেড় দু' দশক আগে কাটানো বিয়ের মুহূর্ত, অথচ মনে হয় গত জন্মের ঘটনা যেন।
২০০২, রাজাদার বিয়ে। মামারবাড়ির দিকের সবচেয়ে বড় দাদা রাজাদা। আমি সবে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছি, সবাই মিলে আসানসোলে বরযাত্রী যাওয়া হচ্ছে, আনন্দের হটস্পটে সবার ওয়াইফাই টানটান। আর আমার মা, মাসিদের নাচের বাতিক আছে। হুগলি সেতু ছাড়াতেই বাসে গান বাজানো শুরু! আমার মামাবাড়িতে অপসংস্কৃতি একদম অনুমোদিত নয়, তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো হয় টয় না। শুরুই হয় মুংড়া, আর দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে থেকে। তা সেরকমই গান বাজছে, আর গান বাজলে আমার ছোটমাসি, যাকে আমি নাম ধরে বিজু বলে ডাকি সে আউলা হয়ে যায়! নাচতে না দিলে কামড়েও দিতে পারে। তো গানের সঙ্গে বিজুর উদ্দাম নৃত্য চালু। আমরাও আনন্দে হাততালি দিচ্ছি।
আরও পড়ুন- সরস্বতীপুজোয় খুঁজি ব্যক্তিগত বনলতা সেনকে, মুখে যার শ্রাবস্তীর কারুকাজ ব্রণ হয়ে ফুটে থাকে…
এত অবধি ঠিক ছিল, হঠাৎ মেজমেসোর ভাই দুলালকাকুর কেমিক্যাল লোচা হয়ে গেল কেন কে জানে? দুলালকাকু অবিকল সন্তোষ দত্তর মতো দেখতে এবং এমনই সরল যে আমাদের স্থির বিশ্বাস ছিল তিনি হাইলাইটস দেখে বেটিং করলেও হারবেন। তো দুলালকাকু হঠাৎ বিজুর সঙ্গে নাচতে শুরু করলেন, ওই বনের পাখি আর খাঁচার পাখির চিরাচরিত কেস! না দেখা হলেই বেটার। দেখা হলে কী হয় তা জানতে পারল দুলালকাকু, লেটার। ড্রাইভারের সাডেন ব্রেক, আমার মাসি নাচতে নাচতে পিক আপ নিয়েই ছিল, এবার মাধ্যাকর্ষণের মায়া ছাড়িয়ে উড়ে গিয়ে দুলালকাকুর টাকে ল্যান্ড করল। শেষ! ওই ছিল দুলালকাকুর শেষ নাচ। শুধু তাই নয়, এমন ডুকরে ডুকরে কাঁদলেন গোটা বিয়ে জুড়ে যে বাসি বিয়ের দিন কে বাপের বাড়ি ছেড়ে আসছে, বৌদি না দুলালকাকু- গুলিয়ে গেল।
এর ঠিক দু' বছর পরের ঘটনা, শিলিগুড়িতে আমার দিদি মিমিদির বিয়ে হয়েছে। আমি, বুড়ো দু'জনেই খুব কেঁদেছি আমাদের দিদি বিয়ে হয়ে চলে যাচ্ছে বলে। ইনফ্যাক্ট এত কেঁদেছি যে শরীরে আর অবশিষ্ট কিছু নেই। আমি আর বুড়ো দু'জনেই বুঝলাম একটু দম দেওয়া দরকার। কিন্তু একে তো দু'জন হদ্দ ক্লান্ত, তার উপর মাঝ ডিসেম্বরের শিলিগুড়ির বাঘা শীত, দূরে যাওয়া সম্ভব নয়। বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই বিয়েবাড়ি ভাড়া নেওয়া ছিল, সেখানে খেতে গিয়ে শুনলাম আমাদের যতক্ষণ ভাড়া ছিল সেই টাইম ওভার। অগত্যা বেরিয়ে আসতে গিয়ে তোরণটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তোরণ বলতে ওই সানাইয়ের ডিজাইন করে বিয়েবাড়িতে যা লাগানো হয় আর কী। আমি বললাম ইউরেকা! বেশি দূর না গিয়ে তোরণের পিছনে দাঁড়িয়েই সিগারেট মেরে দিই। যেমন ভাবা তেমন কাজ, তোরণের আড়ালে গিয়ে পিছন ফিরে সিগারেট ধরিয়ে সুখ দুঃখের কথা বলছি। হঠাৎ দৈবাদেশের মতো গলা শুনতে পেলাম, ”ছিঃ! দিদি বিয়ে করে চলে গেল আর তোরা এসব করছিস?" আমি আর বুড়ো পিছন ফিরে দেখি তোরণ নিয়ে ডেকোরেটর বেপাত্তা হয়ে গেছে আমাদের অজান্তে, আমাদের কীর্তি দেখছে গোটা মামাবাড়ি, শ্রেষ্ঠাংশে আমার ও বুড়োর বাবা। হঠাৎ আমার মনে পড়ল, ইউরেকা বলার সময় আর্কিমিডিস ল্যাংটো ছিলেন।
আরও পড়ুন- হাতকাটা দুঃখরা ফুলহাতা হয় শীতেই, খোসা ছেড়ে আসে কমলালেবু, না হওয়া প্রেমরা…
ঠিক এরকম ঘটন অঘটন মিলিয়েই এই বিয়েবাড়িটাও কেটে গেল। এখন আমাদের দেখে সিগারেট ট্যাপ করার লোক বেড়েছে, কমে গেছে আমাদের সিগারেট ট্যাপ করার মতো গুরুজন। মেজমাসি আর নেই, বাকি মাসিদের হাঁটু চলে না। মেসো মারা যাওয়ার পর বিজুর নাচ জন্মের মতো ঘুচেছে। এখন আমাদের নাচের কথা কিন্তু সময় এবং প্রতিযোগিতা আমাদের সব সুর, সব তাল কেড়ে নিয়েছে। আমাদের প্রজন্ম তাই আর মা-মাসিদের মতো নাচতে চাইলেও পারে না, আমাদের নাচায় ইএমাই। সেই নাচে আনন্দ নেই, শুধু দৌড় আছে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে বলেছি, “আবার দেখা হবে” কিন্তু আমিও জানি এর অনেকটাই সত্যি নয়। আমি সত্যি জানি না বালুরঘাটের দিদাকে আবার কবে দেখব, বা আদৌ দেখব কিনা, নাকি শুধু হোয়াটস্যাপের একটা ব্লু টিক বলবে আরেকজন কমে গেল যে আমার ডাকনাম জানত। আসলে বিশ্বস করুন, সেলিব্রিটি হওয়াটা মৃগনাভির মতোই একটা বিষয়। আপনি হাজার চেষ্টা করুন ঝাড়তে পারবেন না। আপনার শৈশবের সঙ্গী আপনাকে ছোট সিগারেট দিতে লজ্জা পায়! কী আশ্চর্য লাগে নিজের অভিনয়েই, যখন বলি "আবার দেখা হবে"।
যদিও জানি…