বিশ্বজুড়ে ভোট কারচুপি! গণতন্ত্র টিকবে?
Vote Manipulation HIstory Of World: আদালত স্পষ্ট করে জানায় যে, শুধুমাত্র একটি প্রিন্টআউট বা ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে যথেষ্ট নয়, কারণ এটি একটি বিশ্বাসযোগ্য নিরীক্ষণ বা যাচাই যোগ্যতা নিশ্চিত করে না।
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি অবাধ স্বচ্ছ নির্বাচন। জনগণের ইচ্ছের প্রতিফলন। একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী নির্বাচনী জালিয়াতি, ভোট কারচুপি এবং বিভিন্ন ধরনের কারসাজি এই মৌলিক স্তম্ভকে ক্রমাগত দুর্বল করে তুলছে। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগত ত্রুটি নয়, বরং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক বৈধতার পক্ষে একটি মারাত্মক হুমকি। যখন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে এবং সমাজে রাজনৈতিক সংকট ঘনিয়ে আসে। প্রখ্যাত নাট্যকার টম স্টপার্ডের (টম স্টপার্ড একজন চেক বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাট্যকার ও চিত্রনাট্যকার, যিনি মানবাধিকার, সেন্সরশিপ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং গভীর দার্শনিক বিষয় নিয়ে নাটক রচনার জন্য বিখ্যাত। তিনি তাঁর 'রোজেনক্র্যান্টজ এবং গিল্ডেনস্টার আর ডেড', 'আর্কাডিয়া', এবং 'ট্র্যাভেস্টিস' নাটকগুলোর জন্য পরিচিত, এবং বহু পুরস্কার জিতেছেন) একটি উক্তি এই সত্যকে তুলে ধরে: "It's not the voting that's democracy; it's the counting". এই উক্তিটি নির্দেশ করে যে, শুধু ভোটপ্রদানই যথেষ্ট নয়, বরং সেই ভোট সঠিকভাবে এবং সততার সাথে গণনা করা হয়েছে কি না, তা-ই গণতন্ত্রের আসল মাপকাঠি। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী জালিয়াতির বহুমুখী প্রকৃতি, এর কারণ এবং গণতন্ত্রের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আলোচনা করতেই এই প্রতিবেদন। আমার ভোট কার্যকর হবে, যখন ভোটারদের এই বিশ্বাস টলে যায়, তখন গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ অর্থহীন হয়ে পড়ে, এই ঘটনা রাজনৈতিক উদাসীনতা ও সহিংসতার জন্ম দিতে পারে । এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা, নেপথ্যে থাকা সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কারণগুলো চিহ্নিত করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি।
যেভাবে ভোটচুরি হয়
নির্বাচনী শুধু নির্বাচনের দিনে সংঘটিত হয় না। নির্বাচনের আগে, চলাকালীন এবং পরেও বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারে। নির্বাচন শুরুর অনেক আগেই নানা ধরনের জালিয়াতির কৌশলগুলো প্রয়োগ করা হয়, উদ্দেশ্য নির্বাচনী ময়দানকে একটি নির্দিষ্ট প্রার্থীর অনুকূলে তৈরি করা। ভোটার তালিকা কারচুপি একটি অত্যন্ত কার্যকর কৌশল। জীবিত ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া বা মৃত অথবা শতবর্ষী ভোটারদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় । জিম্বাবোয়ের ২০১৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে, বিরোধী দল অভিযোগ করে যে ভোটার তালিকায় ৮,৩৮,০০০ এমন নাম পাওয়া গেছে, যাদের নাম, ঠিকানা ও জন্ম তারিখ এক কিন্তু আইডি নম্বর ভিন্ন। এছাড়াও, ১,০০,০০০-এর বেশি নিবন্ধিত ভোটারের বয়স ১০০ বছরের বেশি ছিল, যার মধ্যে একজন ১৩৫ বছর বয়সি সামরিক কর্মকর্তাও ছিলেন । অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোটার তালিকা শুদ্ধিকরণের নামে কৃষ্ণাঙ্গ ও অ-শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ভোটদানের অধিকার খর্ব করা হয়। এছাড়া, জনসংখ্যার কারসাজির কৌশলে একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় কৃত্রিমভাবে ভোটারের সংখ্যা পরিবর্তন করা হয় । উদাহরণস্বরূপ, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থক গোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে কোনো 'মার্জিনাল সিট'-এ স্থানান্তর করা হয়, যাতে ভোটের ভারসাম্য তাদের পক্ষে আসে। মালয়েশিয়ার 'প্রজেক্ট আইসি' (Project IC) এই ধরনের কারসাজির একটি উদাহরণ, যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আগত অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয় যাতে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল একটি রাজ্যে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। 'প্রোজেক্ট আইসি' ছিল মালয়েশিয়ার সাবাহ রাজ্যে নির্বাচনী কারচুপির একটি গুরুতর অভিযোগ। এই অভিযোগে বলা হয়, শাসক দল একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবৈধ অভিবাসীদের, বিশেষ করে প্রতিবেশী ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা মুসলিমদের, নাগরিকত্ব ও পরিচয়পত্র প্রদান করে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাবাহ রাজ্যের জনবিন্যাস পরিবর্তন করে রাজনৈতিক ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে আনা। মালয় সংস্কৃতির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে এমন মুসলিম অভিবাসীদের লক্ষ্য করা হয়েছিল, যাতে তাদের ভোট ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন জোট বারিসান ন্যাশনাল (Barisan Nasional), বিশেষ করে ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (UMNO), রাজ্যে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
অভিযোগ অনুযায়ী, এই প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার অবৈধ অভিবাসীকে পরিচয়পত্র (MyKad) দেওয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট এবং ইলেকশন কমিশনের মতো সরকারি সংস্থাগুলো জড়িত ছিল বলেও অভিযোগ ওঠে । একজন প্রাক্তন ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট কর্মকর্তা কমিশনকে জানান যে, সাবেক নির্বাচন কমিশন পরিচালক ১৬,০০০ অভিবাসীকে নিবন্ধন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে মুসলিম ভোটারের সংখ্যা বাড়ানো যায় । এই ধরনের কার্যক্রমের ফলে সাবাহ রাজ্যের জনবিন্যাস বদলে যায়, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হয়ে যায়। ব্যাপক জনরোষ এবং বিতর্কের পর, ২০১২ সালে মালয়েশিয়া সরকার সাবাহতে অবৈধ অভিবাসন নিয়ে একটি রয়্যাল তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশন তার রিপোর্টে জানায় যে 'প্রোজেক্ট আইসি'-র অস্তিত্ব থাকতে পারে এবং এই প্রক্রিয়ায় কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা জড়িত ছিল । তবে রিপোর্টে এ-ও বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলো অবৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্ব প্রদানের সঙ্গে জড়িত ছিল না।
নির্বাচনকালীন জালিয়াতি নির্বাচনের দিনে বা ভোটগ্রহণের সময় সংঘটিত হয়। ব্যালট বাক্সে জাল বা অতিরিক্ত ব্যালট ঢুকিয়ে দেওয়া এই পদ্ধতির অন্যতম প্রধান কৌশল। এছাড়াও, জীবিত বা মৃত কোনো ভোটারের নামে অন্য কেউ ভোট প্রদান করলে তা ভোটার ইম্পেরসনেশন হিসেবে গণ্য হয় । ভোটারদের নগদ অর্থ, উপহার বা অন্য কোনো সুবিধা দিয়ে ভোট প্রদানে প্রভাবিত করা হয়। এটি একটি পুরনো কৌশল, এখনও অনেক দেশে প্রচলিত। অন্য দিকে, সহিংসতা, হুমকি বা চাপের মাধ্যমে ভোটারদের ভোটদানে বাধা দেওয়া হয়। কেনিয়ায় ২০০৭ সালের নির্বাচনে এই ঘটনা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।
আরও পড়ুন- মোদিকে সিংহাসনে রাখতেই জাল ভোটার তালিকা?
ভোটচুরি বিষয়ক গবেষণা
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (EVM)-এর সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যারে কারসাজি করে ভোটের ফলাফল পরিবর্তন করা সম্ভব। এছাড়াও, ভোট গণনার ডেটা ইন্টারনেটে প্রেরণের সময় 'ম্যান-ইন-দ্য-মিডল' (man-in-the-middle) আক্রমণের মাধ্যমে ফলাফল পরিবর্তন করা হতে পারে। ২০০৯-১০ সালে হায়দ্রাবাদ-ভিত্তিক নিরাপত্তা গবেষক হরি প্রসাদ এবং মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী জে. অ্যালেক্স হাল্ডারম্যান ভারতীয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন এর ওপর একটি স্বাধীন নিরাপত্তা বিশ্লেষণ পরিচালনা করেন। এই গবেষণার প্রেক্ষাপট ছিল, হরি প্রসাদ এক বছর ধরে নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি স্বাধীন পর্যালোচনার অনুমতি চেয়েছিলেন, কিন্তু কমিশন তাদের ইভিএমকে 'নিখুঁত' এবং 'টেম্পার-প্রুফ' বলে দাবি করে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। এরপর, এক বেনামী সূত্রের কাছ থেকে তিনি একটি মেশিন পেয়েছিলেন, যা নিয়ে তিনি হাল্ডারম্যান এবং নেদারল্যান্ডসের রপ গংগ্রিজপের সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক দল গঠন করে গবেষণা শুরু করেন। ২০১০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত তাদের গবেষণাপত্রটি প্রমাণ করে যে, কমিশনের দাবি সত্ত্বেও ইভিএমগুলোতে গুরুতর নিরাপত্তা দুর্বলতা রয়েছে। এই সুযোগের 'সদ্ব্যবহার' করে নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন করা সম্ভব। তাদের গবেষণায় দুটি প্রধান কৌশল দেখানো হয়, যা ব্যবহার করে অসাধু নির্বাচন কর্মকর্তা বা অপরাধীরা মেশিনে কারচুপি করতে পারে। এই গবেষণার ফলাফলের পর ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অনেকেই এই মেশিনগুলোকে বাতিল করার দাবি জানান। এই ঘটনার পর হরি প্রসাদকে তার বেনামী উৎসের পরিচয় জানতে চাওয়ার জন্য গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু তিনি সেই পরিচয় প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন।
একই ধরনের আরেকটি গবেষণায়, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান দিয়েগো, ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান এবং প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা একটি সিকোইয়া এভিসি অ্যাডভান্টেজ (Sequoia AVC Advantage) ইভিএম হ্যাক করে দেখাতে সক্ষম হন। তারা "রিটার্ন-অরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং" (return-oriented programming) নামক একটি নতুন প্রোগ্রামিং কৌশল ব্যবহার করে ভোট চুরি করে দেখান। এই গবেষণাটি প্রমাণ করে যে, পুরনো বা বিদ্যমান মেশিনগুলোতে এমন ধরনের দুর্বলতা থাকতে পারে যা মেশিন ডিজাইন করার সময় আবিষ্কারই হয়নি। এর বিপরীতে, ভারতের নির্বাচন কমিশন দৃঢ়ভাবে দাবি করেছে যে তাদের ইভিএমগুলো টেম্পার-প্রুফ। কমিশনের যুক্তি, ইভিএমগুলো ইন্টারনেট বা অন্য কোনো নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত নয়, এবং নতুন মডেলগুলিতে হস্তক্ষেপ শনাক্ত করার জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা কাঠামো রয়েছে ।
ভারত-সহ কিছু দেশ ইভিএম ব্যবহার অব্যাহত রাখলেও , অনেক উন্নত দেশ নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা এবং যাচাইযোগ্যতার বিষয়ে উদ্বেগের কারণে এই প্রযুক্তি বাতিল করেছে ।
কেন ইভিএম ব্যবহারে নিমরাজি জার্মানি, আয়ারল্যান্ড
২০০৯ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত ইভিএম ব্যবহারকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। তাদের রায়ের মূল ভিত্তি ছিল পাবলিক নেচার অফ ইলেকশন বা নির্বাচনের জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত থাকার নীতি। আদালত রায় দেয়, ভোট এবং ফলাফল নির্ধারণের মূল ধাপগুলো জনসাধারণের কাছে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ছাড়াই নির্ভরযোগ্য এবং যাচাইযোগ্য হতে হবে। যেহেতু ইভিএমে ভোট শুধুমাত্র ইলেকট্রনিক ভাবে রেকর্ড করা হয়, তাই সাধারণ নাগরিকরা কারচুপি বা ত্রুটি যাচাই করতে পারে না । আদালত স্পষ্ট করে জানায় যে, শুধুমাত্র একটি প্রিন্টআউট বা ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে যথেষ্ট নয়, কারণ এটি একটি বিশ্বাসযোগ্য নিরীক্ষণ বা যাচাই যোগ্যতা নিশ্চিত করে না। এই রায়টি প্রমাণ করে, প্রযুক্তিগত সুবিধা যতই থাকুক না কেন, যদি তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মৌলিক নীতিগুলোকে সমর্থন না করে, তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। জার্মানির মতো, আয়ারল্যান্ডও ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা বাতিল করে । এর প্রধান কারণ ছিল "ব্যয় এবং জনসাধারণের অসন্তোষ" । আয়ারল্যান্ডে ইভিএম ব্যবস্থায় একটি যাচাইযোগ্য পেপার ট্রেইল (VVPAT) বা অন্য কোনো অডিট মেকানিজম ছিল না, ফলে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। ২০০২ সালের একটি গোপন প্রতিবেদনও মেশিনের নিরাপত্তা নিয়ে "গুরুতর উদ্বেগ" প্রকাশ করেছিল। আয়ারল্যান্ডের তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী জন গর্মলি ইভিএম-এর ব্যবহার বাতিলের ঘোষণা দেন, যার প্রধান কারণ ছিল জনগণের অসন্তোষ এবং এই প্রকল্পের পেছনে ৫৪.৬ মিলিয়ন ইউরো ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ। একইভাবে, নেদারল্যান্ডসও স্বচ্ছতা এবং নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগের কারণে ইভিএম-এর ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে।
ইচ্ছাকৃত ভুল গণনা সম্ভব
ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর, ফলাফল প্রকাশ এবং যাচাই-বাছাইয়ের সময় এই ব্যাপক জালিয়াতি ঘটে। ব্যালট নষ্ট করা বা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল গণনা করা এই পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত । ফিলিপাইনে 'দাগদাগ-বাওয়াস' (Dagdag-Bawas) নামক একটি পদ্ধতি খুবই প্রচলিত ছিল, যেখানে একজন প্রার্থীর ভোট থেকে কিছু সংখ্যা 'বাদ' (bawas) দিয়ে অন্য প্রার্থীর গণনায় 'যোগ' (dagdag) করা হতো। সবচেয়ে স্পষ্ট ও নির্লজ্জ ধরনের জালিয়াতি হলো ভোট গণনার প্রকৃত ফলাফল উপেক্ষা করে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি কৃত্রিম ফলাফল ঘোষণা করা । এটি সাধারণত এমন দেশগুলোতে দেখা যায় যেখানে নির্বাচন কমিশন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক ক্ষমতার অধীনে থাকে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের কেস স্টাডিগুলোর মাধ্যমে নির্বাচনী জালিয়াতির প্রকৃতি এবং গণতন্ত্রের উপর এর চূড়ান্ত নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে।
নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ
রাশিয়াতে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভ্লাদিমির পুতিন রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তবে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা এবং রাশিয়ার নিজস্ব পর্যবেক্ষক দল 'গোলোস' এই নির্বাচনকে জালিয়াতি বলে অভিহিত করে। গোলোস কথার অর্থ রাশিয়ান ভাষায় কণ্ঠস্ব। বছরের পর বছর ধরে রাশিয়া ভোট জালিয়াতি রেকর্ড করে আসছে। অভিযোগ ভ্লাদিমির পুতিনের দীর্ঘ শাসনকালে নির্বাচনগুলি নিয়মরক্ষার ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল। গোলোস এর অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ব্যালট স্টাফিং এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য রাশিয়া ১২৯টি দেশ থেকে ১১১৫ জন "ভুয়া পর্যবেক্ষক"কে আমন্ত্রণ জানায়, যাদের মধ্যে অধিকাংশই উগ্র ডানপন্থী দলের স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ। রাশিয়াতে নির্বাচনী জালিয়াতি একটি নতুন স্তরে পৌঁছেছে। এটি এখন কেবল গোপনীয়ভাবে পরিচালিত হয় না, বরং প্রকাশ্যে পরিচালিত হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে একে বৈধতা দেওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল ব্যবহার করা হয়। স্বাধীন ভোট পর্যবেক্ষক গোলোসের সহ-সভাপতি গ্রিগরি মেলকোনিয়ানটস কারাদণ্ডের দু'মাস পর ৮ জুলাই, ২০২৫-এ তাদের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। গোলস এক বিবৃতিতে বলেছে যে সাজা ঘোষণার পর তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না।
জালিয়াতির আরেক নমুনা
নাইজেরিয়ায় ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত মাত্র দুটি নির্বাচিত সরকার দেখেছে, যাদের উভয়কেই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। দেশটির প্রথম নির্বাচন (১৯৬৪) থেকেই ব্যাপক কারচুপি, সহিংসতা এবং জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিভাজন দেখা গেছে। পরবর্তীতে, ১৯৮৩ সালের নির্বাচনেও একই ধরনের সহিংসতা ও জালিয়াতি হয়, যা তৎকালীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার একটি কারণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সশস্ত্র দল বা 'ঠগ'দের ব্যবহার করে ব্যালট বক্স চুরি করা, ভোটারদের ভয় দেখানো এবং ভুয়া ফলাফল ঘোষণার ঘটনা স্বাভাবিক ছিল। যদিও ২০১৫ সালের নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা স্বচ্ছ বলেছেন, তবে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি ব্যবহারে ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
২০১২ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে নাইজেরিয়ার নির্বাচন পদ্ধতির ধারাবাহিক ব্যর্থতা কোনো কারিগরি ত্রুটির কারণে নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার কারণে হয়েছে ।
কেনিয়া
২০০৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে প্রায় ১২০০ জন নিহত হয় এবং ৩ লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়। এই ঘটনাটি দেশের জাতিগত বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সহিংসতায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা বিরোধী দলের সমর্থকদের উপর আক্রমণ করে, যাদের মধ্যে অনেকে প্রাণ হারান । তবে, ২০২২ সালের নির্বাচনে কেনিয়া একটি ভিন্ন পথ অনুসরণ করে। নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের হাতে লেখা ফলাফল অনলাইনে প্রকাশ করে, যা যেকোনো নাগরিককে ভোট গণনা যাচাই করার সুযোগ দেয়। এটি একটি অভূতপূর্ব পদক্ষেপ ছিল, যা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এবং জনগণের আস্থাকে ফিরিয়ে আনে। কেনিয়ার অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে একটি ভয়াবহ সংকটের পর প্রাতিষ্ঠানিক এবং প্রযুক্তিগত সংস্কার সম্ভব। ২০০৭ সালের সহিংসতা ২০২২ সালের ডিজিটাল স্বচ্ছতার জন্য একটি সরাসরি প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এই ঘটনাটি দেখায় যে জনগণের আস্থার পুনরুদ্ধার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার জরুরি।
প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রে বিতর্ক ও সাংবিধানিক সংকট
২০০০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল সাংবিধানিক সংকট তৈরি করে। ফ্লোরিডা রাজ্যে ব্যবহৃত বাটারফ্লাই ব্যালট (butterfly ballot)-এর নকশা এতটাই বিভ্রান্তিকর ছিল যে এটি ২০০০ এরও বেশি ডেমোক্র্যাট ভোটারকে ভুল করে অন্য প্রার্থী (প্যাট বুচানান)-কে ভোট দিতে উৎসাহিত করে । জর্জ ডব্লিউ বুশ মাত্র ৫৩৭ ভোটের ব্যবধানে ফ্লোরিডায় জয়ী হন, যা তাঁকে হোয়াইট হাউসের জন্য প্রয়োজনীয় ২৫টি ইলেক্টোরাল ভোট এনে দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক দুই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন—২০১৬ ও ২০২০—শুধু ভোটের ফলাফলের কারণে নয়, বরং জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগের জন্যও ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। বিশ্বের অন্যতম পুরনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা নাড়িয়ে দিয়েছে এই অভিযোগের ঢেউ, যা কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক বিতর্কে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং মার্কিন সমাজে গভীর রাজনৈতিক মেরুকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সংকটকে উস্কে দিয়েছে। ২০১৬ সালের নির্বাচন ছিল মার্কিন রাজনীতির জন্য এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত বিজয় আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে তীব্র আলোড়ন তোলে। এই নির্বাচনের পরপরই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানায়, রাশিয়া সাইবার আক্রমণ ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল। ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে লক্ষ লক্ষ ভুয়া পোস্ট ও বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়ে, লক্ষ্য ছিল ভোটারদের প্রভাবিত করা এবং ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা। রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছু অঙ্গরাজ্যের ভোটার নিবন্ধন ডেটাবেসেও হ্যাকিংয়ের চেষ্টা চালায়, যদিও সরাসরি ভোট মেশিন বা গণনার ফলাফল বদলে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার তদন্তে বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট মুলারের নেতৃত্বে প্রায় দুই বছরব্যাপী একটি বিস্তৃত অনুসন্ধান হয়। মুলার রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, রাশিয়া বিভিন্ন মাধ্যমে নির্বাচনের পরিবেশে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করলেও ট্রাম্প প্রচারণা টিম ও রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের মধ্যে সরাসরি ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মেলেনি। তবে রিপোর্ট এটাও দেখিয়ে দেয় যে মার্কিন নির্বাচনী কাঠামোর তথ্য-নিরাপত্তা কতটা ভঙ্গুর এবং সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক প্রচার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কতটা বিপদে ফেলতে পারে। ২০২০ সালের নির্বাচন সেই বিতর্ককে আরও তীব্র করে তোলে। করোনা মহামারীর কারণে ডাকযোগে ভোটের হার বেড়ে যায়, যা রিপাবলিকান শিবিরে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর ট্রাম্প ও তার সমর্থকেরা অভিযোগ তোলে যে নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি হয়েছে—ডাকযোগে ভোটে কারচুপি, মৃত ব্যক্তির নামে ভোট দেওয়া, ভোট মেশিনে হ্যাকিং ইত্যাদি।
স্টপ দ্য স্টিল নামে একটি প্রচারণা চালিয়ে এই অভিযোগকে জনমনে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়। কিন্তু রাজ্যভিত্তিক পুনর্গণনা, নিরীক্ষা ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় এসব অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে তথ্য-প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও এই অভিযোগ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বয়ানে রূপ নেয়। ট্রাম্পের বক্তব্য ও রিপাবলিকান দলের একাংশের প্রচারণায় লক্ষ লক্ষ ভোটার বিশ্বাস করতে শুরু করে যে নির্বাচন “চুরি” হয়েছে। এই বিভ্রান্তি ও ক্ষোভই শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেস ভবনে হামলার অনুঘটক হয়ে ওঠে, যেখানে ট্রাম্প-সমর্থক বিক্ষোভকারীরা ইলেক্টোরাল ভোটের অনুমোদন প্রক্রিয়া ঠেকাতে সহিংসতা চালায়। সেই ঘটনায় নিহত ও আহত হন বহু মানুষ, এবং মার্কিন গণতন্ত্রের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফিলিপাইনে দাগদাগ-বাওয়াস
এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ 'যোগ-বিয়োগ', নামক ভোট কারচুপির একটি পদ্ধতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই পদ্ধতিতে একজন প্রার্থীর ভোট কমিয়ে অন্য প্রার্থীর পক্ষে যোগ করা হতো। ১৯৯৫ সালের সেনেট নির্বাচনে এটি ব্যাপক আকারে সংঘটিত হয়, যেখানে একাধিক প্রার্থীর ভোট গণনায় গুরুতর গরমিল পাওয়া যায় এবং পরবর্তীতে আদালত কর্তৃক তা প্রমাণিত হয়। ২০০৪ সালের "হ্যালো গার্সি" কেলেঙ্কারি ছিল হাইলেভেল রাজনৈতিক যোগসাজশের একটি উদাহরণ। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্লোরিয়া মাকাপাগাল আরয়ো (Gloria Macapagal Arroyo) এবং নির্বাচন কমিশনার ভার্জিলিও গার্সিলানো-এর মধ্যে একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়, যেখানে আরয়োকে জিজ্ঞেস করতে শোনা যায়, "হ্যালো গার্সি? আমি কি এখনও ১০ লাখের বেশি ভোটে এগিয়ে থাকব?" এই অডিও টেপগুলো আরয়োর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন। এই ঘটনাটি ১৯৯৫ সালের 'ডাগদাগ-বাওয়াস' (যোগ-বিয়োগ) কেলেঙ্কারির সাথে সম্পর্কিত। ফিলিপাইনের কেসটি নাইজেরিয়ার মতো একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাকে তুলে ধরে, তবে এখানে সহিংসতার চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। দাগদাগ-বাওয়াস প্রমাণ করে যে কীভাবে জালিয়াতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
ইউক্রেন, ২০০৪ : কমলা বিপ্লবের প্রেক্ষাপট
২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রগতিশীল প্রার্থী ভিক্টর ইউশচেঙ্কো (Viktor Yushchenko) এবং রুশ-সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ (Viktor Yanukovych)-এর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় । দ্বিতীয় দফা ভোটের পর ইয়ানুকোভিচ-কে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় । আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল, যেমন OSCE এবং NDI* এই নির্বাচনকে "অবাধ ও নিরপেক্ষ নয়" বলে আখ্যায়িত করে । তাদের প্রতিবেদনে একাধিক জালিয়াতির কথা উল্লেখ করা হয়, যেমন অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ ভোটদানের হার (Donetsk-এ ৯৮.৫% এবং কিছু জেলায় ১২৭% পর্যন্ত) ; ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে ভোটারদের ভয় দেখানো ; "Absentee voting certificates"-এর অপব্যবহার, যার মাধ্যমে এক ব্যক্তি একাধিকবার ভোট দিতে পারে ; এবং ভোট দানকারী কর্মকর্তার অপসারণ ও মিডিয়াতে পক্ষপাতমূলক কভারেজ। এই নির্বাচন জালিয়াতি ইউক্রেনে ব্যাপক গণবিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিদ্রোহ "কমলা বিপ্লব" (Orange Revolution) নামে পরিচিত। জনগণের চাপের মুখে, ইউক্রেনের সুপ্রিম কোর্ট ভোটের ফলাফল বাতিল করে এবং নতুন করে নির্বাচনের নির্দেশ দেয় । এই ঘটনা দেখায় যে, একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং একটি সচেতন নাগরিক সমাজ কীভাবে জালিয়াতি মোকাবিলায় চূড়ান্তভাবে সফল হতে পারে।
লাতিন আমেরিকা জুড়ে চলা কারচুপি
নির্বাচনী জালিয়াতি বা কারচুপির ক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নাম প্রায়ই সংবাদ শিরোনামে স্থান পায়। লাতিন আমেরিকার নির্বাচনী রাজনীতিতে “জালিয়াতি”—কখনো প্রমাণিত, কখনো প্রমাণহীন—একটি পুনরাবৃত্ত থিম। এর রূপ অনেক। ভোটগণনা বন্ধ রেখে “প্রযুক্তিগত ত্রুটি” দেখানো, সরকারি যন্ত্রপাতি ও প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে কাজে লাগানো, বিরোধী প্রার্থী বা পর্যবেক্ষকদের পথ রুদ্ধ করা, আবার কোথাও সরাসরি সংখ্যার হেরফের। একই সঙ্গে, বহু ক্ষেত্রে অভিযোগ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
মেক্সিকোর ১৯৮৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ফল গণনার রাতে আচমকা ঘোষণা আসে—“সে কায়ো এল সিসটেমা” (সিস্টেম ভেঙে পড়েছে)। বিরোধীরা বলেন, তখনই ভোটের স্রোত পাল্টে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ইনস্টিটিউশনাল রেভোলিউশনারি পার্টি বা পিআরআই দলের কার্লোস সালিনাস জয়ী ঘোষিত হন। পরে ওই নির্বাচনের ব্যালটপেপারের বড় অংশই নষ্ট করে দেওয়া হয়—যা সন্দেহ আরও ঘনীভূত করে। বহু গবেষণা ও অনুসন্ধানী লেখায় ১৯৮৮-কে আধুনিক মেক্সিকোর সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচন বলা হয়; একই সঙ্গে এ ঘটনাই দেশটিতে পরবর্তী নির্বাচনী সংস্কারের চাপ বাড়িয়েছিল।মেক্সিকোতে ইনস্টিটিউশনাল রেভোলিউশনারি পার্টি (PRI) প্রায় ৭০ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছিল। ১৯৮৮ সালে সে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনটি ছিল একটি দীর্ঘস্থায়ী একদলীয় শাসনের (ইনস্টিটিউশনাল রেভল্যুশনারি পার্টি) ইতিহাসে প্রথম সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন । যখন প্রাথমিক ফলাফল থেকে বিরোধী দলীয় প্রার্থী কুয়াউতেমোক কার্দেনাস (Cuauhtémoc Cárdenas)-এর বিজয় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তখন হঠাৎ করে কম্পিউটার সিস্টেম ক্র্যাশ (se cayó el sistema) করে এবং ভোট গণনা বন্ধ হয়ে যায় । পরবর্তীতে যখন সিস্টেমটি আবার সচল হয়, তখন পিআরআই প্রার্থী কার্লোস স্যালিনাস ডি গোর্টারি কে ৫১% ভোট পেয়ে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এই "সিস্টেম ক্র্যাশ"টি কেবল একটি প্রযুক্তিগত ত্রুটি ছিল না। বরং, এটি ছিল একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে ক্ষমতা ধরে রাখার একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল। চাপের মুখে সরকার একটি স্বাধীন নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান (Federal Electoral Institute - IFE) গঠন করতে বাধ্য হয়, যা মেক্সিকোর গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য একটি নতুন পথ খুলে দেয় । এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে, চরম জালিয়াতিও কিছু ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ ও প্রতিরোধের স্পৃহা জাগিয়ে তোলে, যা একটি গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের সমালোচনামূলক সন্ধিক্ষণ হিসেবে কাজ করতে পারে ।
ভেনেজুয়েলায় ২০১৭ সালের সংবিধানসভা (Constituent Assembly) নির্বাচনে অভিযোগ শুধু বিরোধীদের মুখে নয়, এসেছে ভোট-প্রযুক্তি সরবরাহকারী কোম্পানি স্মার্টম্যাটিকের কাছ থেকেও। তাদের প্রধান নির্বাহী প্রকাশ্যে বলেন—সরকার ঘোষিত উপস্থিতির চেয়ে কমপক্ষে ১০ লাখ ভোটের ফারাক আছে; অর্থাৎ উপস্থিতির সংখ্যা ম্যানিপুলেটেড।
হন্ডুরাসে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। প্রথমিক গণনায় বিরোধী প্রার্থী এগিয়ে ছিলেন; পরে দীর্ঘ বিলম্ব, সার্ভার ও গণনা-প্রক্রিয়ার বিশৃঙ্খলা, এবং “অস্বাভাবিক” ট্রেন্ডের ভেতর দিয়ে ক্ষমতাসীন হুয়ান অরলান্দো এরনান্দেজ জয়ী ঘোষিত হন। ওই রাতেই ওএএস (অর্গানাইজেশন অফ আমেরিকান স্টেটস)–এর পর্যবেক্ষণ মিশন অনিয়মের বিস্তারিত উল্লেখ করে নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানায়—যা লাতিন অঞ্চলের নির্বাচন ইতিহাসে বিরল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী ও সংবাদমাধ্যমও গণপ্রদর্শন, দমন–পীড়ন ও প্রক্রিয়াগত ঘাটতির কথা নথিবদ্ধ করে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশ ফল মেনে নেয়, তবু এই নির্বাচনের উপর “অনিয়মের ছায়া” থেকে গেছে।
নিকারাগুয়ায় ২০২১ সালের নির্বাচনকে অনেক পর্যবেক্ষক খোলাখুলি “ছদ্মনির্বাচন” বলেছেন। ভোটের আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী শীর্ষ রাজনীতিক, সাংবাদিক ও কর্মীদের গ্রেফতার ও নির্বাসনে ঠেলে দেওয়া হয়; একাধিক দলকে প্রতিযোগিতার বাইরে রাখা হয়। নির্বাচনের পর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বহু দেশ ফলকে অবৈধ আখ্যা দেয়; ওএএস–ও প্রস্তাব গ্রহণ করে যে নির্বাচন “বৈধতা” হারিয়েছে—পরবর্তীতে নিকারাগুয়া ওএএস থেকে বেরোনোর প্রক্রিয়াও শুরু করে। মার্কিন কংগ্রেস গবেষণা পরিষদের নথি, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে এসব ঘটনার সময়রেখা ও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়।
ইকুয়েডরে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী গুইয়েমো লাসো ফল জালিয়াতির অভিযোগ তোলেন এবং রাস্তায় প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। নির্বাচন কমিশন আংশিক পুনর্গণনায় যায়—প্রায় ১০% ব্যালট পুনর্গণনা হয়—কিন্তু সামগ্রিক ফল বদলায়নি এবং লেনিন মোরেনোই জয়ী থাকেন।
উদাহরণগুলো তুলনা করলে কয়েকটি প্যাটার্ন ধরা পড়ে। প্রথমত, “প্রযুক্তিগত ত্রুটি”, গণনা বিলম্ব বা তথ্যের অস্বচ্ছতা—এসব প্রায়ই সন্দেহ বাড়ায়। মেক্সিকো ১৯৮৮–র “সিস্টেম ক্র্যাশ” হোক, হন্ডুরাস ২০১৭–র “ধীরগতি”—গণনা–পর্বে স্বচ্ছতা না থাকলেই জালিয়াতির তত্ত্ব মাথা তোলে। দ্বিতীয়ত, ভোট–প্রযুক্তি ও ডাটার স্বাধীন নিরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভেনেজুয়েলায় স্মার্টম্যাটিক নিজেই সংখ্যা–হেরফেরের ইঙ্গিত দেওয়ায় সংকট তীব্রতর হয়। তৃতীয়ত, প্রাক–নির্বাচনী দমন–পীড়ন বা প্রার্থী–বাছাইয়ের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ—যেমন নিকারাগুয়ায়—বাস্তবে “ভোট–দিনের” অনিয়ম ছাড়াও পুরো প্রক্রিয়াকে অকার্যকর করে দিতে পারে। এখানে আন্তর্জাতিক পরিদর্শন ও আঞ্চলিক সংস্থা–ভিত্তিক বৈধতার ভূমিকা কেন্দ্রীয়। ওএএস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা স্বাধীন প্রযুক্তি–সরবরাহকারীর পর্যবেক্ষণ যখন একই দিকে ইশারা করে—যেমন হন্ডুরাস ২০১৭–তে নতুন ভোটের আহ্বান, বা ভেনেজুয়েলা ২০১৭–তে টার্নআউট–সংখ্যা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন—তখন বৈধতার সংকট সীমানা পেরিয়ে কূটনৈতিক টানাপোড়েন ডেকে আনে। আবার ইকুয়েডরের মতো ক্ষেত্রে, আংশিক পুনর্গণনা যখন মূল ফল ঠিক রাখে, তখন অভিযোগ রাজনৈতিক আখ্যানকে উস্কে দিলেও প্রমাণের দিক থেকে দুর্বল থাকে।
এ কথাও সত্য, জালিয়াতির ভাষ্য সব সময় একরঙা নয়। মেক্সিকো ১৯৮৮–র পর যেমন গভীর নির্বাচনী সংস্কার হয়েছে, তেমনি বহু দেশে ই–ভোটিং, ট্যাবুলেশন ও ট্রান্সমিশন–ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে স্থায়ী বিতর্ক আছে। কোথায় কতটা জালিয়াতি প্রশ্নের উত্তরে তাই একদিকে অকাট্য প্রমাণ (লগ, অডিট ট্রেইল, সমান্তরাল গণনা, ফরেনসিক বিশ্লেষণ), অন্যদিকে স্বাধীন পর্যবেক্ষকের রিপোর্ট—এই দুইয়ের সমন্বয় জরুরি। নির্বাচন–পূর্ব পরিবেশ (বাক–স্বাধীনতা, বিরোধীদের মাঠ, মিডিয়ার স্বাধীনতা) ও নির্বাচন–পরবর্তী বিরোধ নিষ্পত্তির পথ (আদালত, কমিশন, পুনর্গণনা) মিলিয়ে তবেই গণতান্ত্রিক বৈধতা মাপে ধরা যায়।
সব শেষে, লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতা একধরনের সতর্কবার্তা। নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন যেমন প্রয়োজন, তেমনি দরকার সম্পূর্ণ স্বচ্ছভাবে তথ্য–নিরীক্ষা, দ্রুত ও স্বচ্ছ ফল প্রকাশ, সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে অডিট, এবং বিরোধ নিষ্পত্তির স্পষ্ট রোডম্যাপ। যেসব দেশে এগুলো অনুপস্থিত, সেখানে এই ধরনের অভিযোগ মানুষের ভোট–আস্থাকে ক্ষইয়ে দেয়। মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলা, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া ও ইকুয়েডরের ঘটনাগুলি দেখায়—প্রক্রিয়ার ক্ষুদ্র ফাঁকও কত বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত ডেকে আনতে পারে; আবার একই সঙ্গে, স্বচ্ছ পুনর্গণনা বা স্বাধীন পর্যবেক্ষণের শক্তিও প্রমাণ করে—ভোট শুধু সংখ্যার খেলা নয়, বিশ্বাসেরও নির্মাণ।
নাইজেরিয়ার ২০১৫ সালের নির্বাচনে, বায়োমেট্রিক কার্ড ব্যবহার করে ভোটারদের পরিচয় নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল, যা ভোটার জালিয়াতি কমানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল । একইভাবে, কেনিয়া ২০২২ সালের নির্বাচনে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের হাতে লেখা ফলাফল অনলাইনে প্রকাশ করে এক ধরনের ডিজিটাল স্বচ্ছতা তৈরি করে, যা জনগণের আস্থা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আরও পড়ুন-ভোটার অধিকার যাত্রা বুঝিয়ে দিল মোদি বিরোধিতার প্রধান মুখ রাহুলই
তবে নির্বাচনী জালিয়াতি এখন শুধু ব্যালট বাক্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ডিজিটাল নির্বাচন হস্তক্ষেপ এবং সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্য (misinformation) ও মিথ্যা তথ্য (disinformation) ছড়িয়ে জনগণের মতামতকে প্রভাবিত করা এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা । রাশিয়া ও চিনের মতো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নির্বাচনে সাইবার হামলা এবং তথ্য যুদ্ধের মাধ্যমে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে । এর ফলে, ভোটাররা সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে। ২০১৭ সালের ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে সাইবার ও তথ্য যুদ্ধের অন্যতম বড় উদাহরণ তৈরি হয়েছিল। এই নির্বাচনে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে রাশিয়ান সাইবার গ্রুপগুলোর কার্যক্রম চিহ্নিত হয়, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর বহিরাগত প্রভাবের স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়।হামলার ধরন ও কৌশল : APT28 বা “Fancy Bear” নামে পরিচিত রাশিয়ান হ্যাকিং গ্রুপ ম্যাক্রোঁর প্রচার শিবিরে ফিশিং ইমেইল পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ নথি, আর্থিক তথ্য এবং ব্যক্তিগত ইমেইল হাতিয়ে নেয়। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে এই নথিগুলো “MacronLeaks” নামে ফাঁস করা হয়, যাতে ভুয়া তথ্য মিশিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। সামাজিক মাধ্যমে বট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই ফাঁস হওয়া নথিগুলো ভাইরাল করে তোলার চেষ্টা হয়। নির্বাচনের আগে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হলেও ফরাসি গণমাধ্যম ও সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায় এবং অধিকাংশ ভুয়া তথ্যকে প্রকাশ্যে মিথ্যা প্রমাণ করে। শেষ পর্যন্ত এই প্রচেষ্টা নির্বাচনের ফলাফল বদলাতে পারেনি, এবং ম্যাক্রোঁ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা ANSSI এবং সরকার প্রকাশ্যে রাশিয়ান গ্রুপের সম্পৃক্ততার কথা জানায়। ফ্রান্স নির্বাচন কমিশন সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের বিস্তার ঠেকাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। পরবর্তী বছরগুলোতে ফ্রান্স নির্বাচনী সুরক্ষার জন্য বিশেষ সাইবার প্রতিরক্ষা টাস্কফোর্স গঠন করে। এই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেন যে সাইবার হস্তক্ষেপ কেবল প্রযুক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিক অস্ত্র, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশ গবেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী থমাস রিডের ভাষায়,"রাশিয়া ভোট পরিবর্তনের চেষ্টা করছে না; গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আস্থা নষ্ট করে মন পরিবর্তনের চেষ্টা করছে।" (Russia isn’t trying to change votes; it’s trying to change minds—by undermining trust in democratic systems.”)
তাইওয়ান চিনের কাছে একটি কৌশলগত এবং রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর এলাকা। তাইওয়ানের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চিনের তথ্য ও সাইবার যুদ্ধের অন্যতম বড় পরীক্ষাগার হিসেবে দেখা যায়, যেখানে প্রো-চায়না প্রার্থীদের পক্ষে জনমত গড়ার জন্য ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছিল। নির্বাচনের আগে প্রতিদিন গড়ে ২০ লক্ষের বেশি সাইবার আক্রমণ শনাক্ত হয়, যার বড় অংশ চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে আসে। এসব আক্রমণ সরকারের ডাটাবেস, নির্বাচনী রেজিস্ট্রি ও গণমাধ্যমের সার্ভারকে লক্ষ্য করে করা হয়। সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া খবর, ডিপফেক ভিডিও এবং বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা এবং প্রো-চায়না প্রার্থী হান কুও-ইউকে সমর্থন বাড়ানো। ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে সাই ইং-ওয়েনের নীতিগুলোকে “চীন-বিরোধী” ও “অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী” হিসেবে তুলে ধরা হয়, পাশাপাশি অর্থনৈতিক মিথ প্রচার করে জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়। প্রাথমিকভাবে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হলেও তাইওয়ানের তরুণ প্রজন্ম এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দ্রুত ফ্যাক্ট-চেকিং করে এসব মিথ ভেঙে দেয়। এই প্রতিরোধমূলক প্রচারণা সাই ইং-ওয়েনের সমর্থন আরও সুদৃঢ় করে এবং তিনি রেকর্ড সংখ্যক ভোটে পুনর্নির্বাচিত হন। সরকার সাইবার সুরক্ষা উন্নত করতে নতুন আইনি কাঠামো চালু করে এবং ফেক নিউজ শনাক্ত করার জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে। বেসরকারি ফ্যাক্ট-চেকিং সংগঠনগুলো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মিলে সচেতনতা প্রচার চালায়, যা জনগণকে ভুয়া তথ্য জানার সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হয়।
এটা স্পষ্ট যে নির্বাচনী জালিয়াতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা যার প্রকৃতি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং জনগণের আস্থা নষ্ট করে (যেমন, রাশিয়া, মেক্সিকো)। অপরদিকে, দুর্বল ও নতুন গণতন্ত্রগুলোতে জালিয়াতি ও সহিংসতাকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যা প্রায়শই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মানবিক সংকটের জন্ম দেয় (যেমন, নাইজেরিয়া, কেনিয়া)। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রে সমস্যাগুলো আরও সূক্ষ্ম, যেমন পদ্ধতিগত ত্রুটি বা ভোটার দমন (যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন)। সর্বজনীনভাবে, জালিয়াতি কেবল নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন করে না, বরং এটি পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা টলিয়ে দেয়।
*(OSCE, অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপ এবং NDI, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার বিষয়ে তৎপর। OSCE একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা যা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, মানবাধিকার ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করে। অন্যদিকে, NDI হল একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যা গণতান্ত্রিক নির্বাচন এবং শাসনব্যবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করে)
Whatsapp
