যে লড়াই লড়ছি, সেটাও স্বাধীনতারই লড়াই

Umar Khalid: ফলত, প্রান্তিক মানুষদের ভোটার তালিকায় আনার যে চেষ্টা, দেশের নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার- তার একেবার মূলে গিয়ে আঘাত করা হচ্ছে।

প্রিয়জন বিনা বিচারে জেলে বন্দি থাকলে স্বাধীনতা দিবসের মতো দিনগুলি কঠিন হয়ে যায়। হঠাৎ করে এই দিনগুলিতেই শাসক শ্রেণির লোকজন খুব স্বাধীনতার বুলি আওড়ায়। আমি দিল্লিতে থাকি। আর দিল্লিই মোটামুটি স্বাধীনতার উৎসবের প্রাণ কেন্দ্র। প্রতিবার এখান থেকেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা ইত্যাদি হয়। কিন্তু প্রতিদিন আমরা যেভাবে স্বাধীনতা খর্ব হতে দেখছি, বিনা বিচারে জেলে বন্দি রাখতে দেখছি, এমনকি এখন এসআইআর-এর নামে নানাভাবে যে ভোট লুট চলছে, ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে যে ভাবে আমরা হারিয়ে ফেলছি, সেখানে স্বাধীনতা এখন শুধু উৎসবেই সীমিত হয়ে গিয়েছে।

এখন স্বাধীনতার উদযাপন দেখলে হাসি পায়। পাশাপাশি এটাও মনে হয় সত্যি তো কত লড়াই, বলিদানের পর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। সেটাও তো ভুলে যাওয়া উচিত নয়। সেই লড়াইটাকেও নতুন করে মনে করার একটা জায়গা থেকেই যায়। কিন্তু আমরা এখনও যে লড়াই লড়ছি, সেটাও একদিক থেকে স্বাধীনতারই লড়াই। কাজেই স্বাধীনতার লড়াই তো চলছেই। আমাদের স্বাধীনতা দিবস তো এখনও আসেনি। আমাদের এই লড়াই চলবে।

আরও পড়ুন- বিচারের আগেই মিডিয়া যে ভাবে ‘অপরাধী’ বানিয়েছে উমর খলিদকে

এখন নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ভোটদানের স্বাধীনতাটুকুও কি তবে মিথ্যে ছিল? গণতন্ত্রের প্রথম দিন থেকে ভোটদানের অধিকার ছিল। সংবিধান লাগু হওয়ার পর থেকে আমাদের ভোটদানের অধিকার ছিল। এটা গণতন্ত্রের মূলগত জায়গা। গণতন্ত্র অনুযায়ী, সবার যেমন ভোট দেওয়ার অধিকার আছে তেমনই সবার নির্বাচিত হওয়ার অধিকারও আছে। সেখানে কোনোরকম ভেদাভেদ করার জায়গা নেই। আগে নির্বাচন কমিশন চেষ্টা করত, প্রান্তিক মানুষদের কীভাবে বেশি করে ভোটদানের আওতায়  নিয়ে আসা যায়। সমাজের একদম প্রান্তিক যাঁরা- যাঁর কোনো স্থায়ী বাড়ি নেই বা একজন যৌনকর্মী, যাঁরা সমাজের মূল স্রোত থেকে ছিটকে গেছে, তাঁদের কীভাবে ভোটদানের আওতায় নিয়ে আসা যায় তার চেষ্টা করত নির্বাচন কমিশন।

কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসেছে মানুষের ভোটদানের অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বিরোধী দল নেতা রাহুল গান্ধী দেখালেন সিস্টেমেটিক ভাবে ভুয়ো ভোটারদের নাম তালিকায় আনা হয়েছে। শুধু তাই নয় আমরা দেখতে পেলাম— নির্বাচন কমিশনের সাহায্য নিয়ে ভুয়ো ভোটারদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে আবার এইএসআইআর-এর মাধ্যমে ন্যায্য ভোটারদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কাউকে বাংলাদেশী বলে দাবি করা হচ্ছে, কাউকে আবার ফরেন ন্যাশনাল বলা হচ্ছে। যদিও এ ব্যাপারে কোনো রকম তথ্য এখনও অবধি নির্বাচন কমিশন দিতে পারেনি।

উমর খলিদ

ইতিমধ্যেই বিহারে এসআইআর হয়েছে, ফলে প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষ ভোটাধিকার হারিয়েছেন। ভোটার তালিকায় প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষের নাম নেই। সিস্টেমিকভাবে ডিসএনফ্রাঞ্চাইজমেন্ট বা ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া, এটা ভারতবর্ষে প্রথমবার হল। ফলত, প্রান্তিক মানুষদের ভোটার তালিকায় আনার চেষ্টা এবং দেশের নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার- তার একেবার মূলে গিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। এরপর আমরা হয়তো ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকেই হারিয়ে ফেলব।

আরও পড়ুন- সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছরের, তাও কেন বিনা বিচারে ৪ বছর বন্দি উমর খালিদ?

যেমন উমর খলিদের ঘটনার বিচার প্রক্রিয়াটিও ঝুলছে। মামলার ট্রায়াল এখনও শুরুই হয়নি। পাঁচ বছর আগে এই মামলা শুরু হয়েছিল এফআইআর ফিফটি নাইন (FIR59)- এ। শেষে চলতি বছরে ট্রায়ালের আগের ধাপ শুরু হল। উমরের উপর যে চার্জগুলি গঠিত হয়েছিল তা নিয়ে এখন নিম্ন আদালতে বাদানুবাদ চলছে। পাশাপাশি জামিনের জন্য বারবার আর্জি জানানো হয়েছে। উচ্চ আদালতে এখন রায় রিজার্ভ করা আছে, অন্য সকলের সওয়াল-জবাব হয়ে গিয়েছে।

স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের মেয়েদের বা দলিত সমাজকে স্বাধীনতার জন্য আলাদা করে লড়তে হয়নি। আমরা সবাই একসঙ্গে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম ব্রিটিশদের থেকে। স্বাধীনতার পর সবাইকে ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশের নাগরিকদের যে শুধু ভোট দেওয়ার অধিকার আছে তা কিন্তু নয়, ভোট দেওয়ার পাশাপাশি সবারই ক্ষমতায় আসারও অধিকার আছে। অর্থাৎ, যে কেউ যেমন ভোট দিতে পারবেন, তেমনই নির্বাচিতও হতে পারবেন। যে কোনো প্রান্তিক সমাজের মানুষ হোক বা মহিলা সবার এই অধিকার আছে। তার তাত্ত্বিকভাবে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৭৯ বছরে আমরা দেখিছি সবথেকে বেশি হিংসার সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রান্তিক সমাজের মানুষদের এবং মহিলাদের। প্রতিনিয়ত তাঁদের হিংসার সম্মুখীন হতে হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও প্রান্তিক সমাজের হাতে ক্ষমতা পৌঁছায়নি। কাজেই এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মনে হয়, আমরা অনেক আগে থেকেই এগিয়ে থাকার চেষ্টা করলেও, আসলে আমরা অনেকটা পিছিয়ে এসেছি।

More Articles